ঔপনিবেশিক মত ছিল, প্রাচীন ভারতে ইতিহাস রচনা হয়নি
History

‘হিস্ট্রি’ বনাম ‘ইতিহাস’

ভারতীয়দের বাস্তব, রাজনৈতিক জগৎ সম্পর্কে নিস্পৃহতা ও অজ্ঞতা ভারতে ‘ঔপনিবেশিক শাসনের উপযোগিতা’কেই তুলে ধরে।

Advertisement

কণাদ সিংহ

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৫৬
Share:

সাধনা: উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার স্মারক মূর্তি । ফাইল চিত্র।

আধুনিক জ্ঞানচর্চায় যাকে ‘হিস্ট্রি’ বলে— অর্থাৎ অতীতের তথ্যনিষ্ঠ, কালানুক্রমিক পুনর্নির্মাণ— প্রাচীন ভারতে তেমন কিছু ছিল কি? বিষয়টির জন্ম যদিও আধুনিক ইউরোপে, তবু প্রাচীন গ্রিস, রোম এবং চিনে, মধ্যযুগের খ্রিস্টীয় ও ইসলামি জগতে ‘হিস্ট্রি’-র অনুরূপ সাহিত্য ছিল। অথচ, একাদশ শতকে আরব পর্যটক আল-বেরুনি ভারতে ‘ইতিহাসচেতনার অভাব’ লক্ষ করেছেন। এই সমালোচনা ছিল ঔপনিবেশিক রাজনীতিরও সহায়ক। ঔপনিবেশিক ইতিহাস প্রাচীন ভারতকে দেখাতে চায় বাস্তববোধহীন, ধর্মকেন্দ্রিক, অধ্যাত্মবাদী সভ্যতা হিসেবে। ভারতীয়দের বাস্তব, রাজনৈতিক জগৎ সম্পর্কে নিস্পৃহতা ও অজ্ঞতা ভারতে ‘ঔপনিবেশিক শাসনের উপযোগিতা’কেই তুলে ধরে। প্রাচীন ভারতীয় সমাজের বস্তুজগৎ সম্পর্কে উদাসীনতার সাক্ষ্য হিসাবে তুলে ধরা হয় ইতিহাসচেতনার অভাবকে। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসবিদ এ এ ম্যাকডোনেল ঘোষণা করেন, “আদিযুগের ভারত কোনও ইতিহাস লেখেনি, কারণ তা কোনও ইতিহাস সৃষ্টি করেনি।” কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া-র সম্পাদক ই জে র‌্যাপসন বলেন যে, প্রাচীন ইউরোপে রচিত হেরোডোটাসের ‘হিস্ট্রিজ়’ (গ্রিক ও পারসিকদের লড়াইয়ের কথা) বা লিভির ‘অ্যানাল্‌স’ (রোমান শক্তির বিকাশের বিবরণ)- এর মতো ইতিহাসধর্মী লেখা প্রাচীন ভারতীয় ব্রাহ্মণ, জৈন ও বৌদ্ধদের বিপুল সাহিত্যের মধ্যে একটিও খুঁজে পাওয়া যায় না।

Advertisement

এই ঔপনিবেশিক তত্ত্ব মেনে নিয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদদের অধিকাংশ। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব এনশ্যেন্ট ইন্ডিয়া-র শুরুতেই আছে খেদোক্তি যে, গ্রিসের থুসিডিডিস বা রোমের ট্যাসিটাসের মতো কেউ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লিখে যাননি। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতেও, দ্বাদশ শতকের কাশ্মীরে লেখা কলহনের রাজতরঙ্গিণী-র আগে ইতিহাসপদবাচ্য গ্রন্থ নেই ভারতে। এই বদ্ধমূল ধারণাকে কার্যত স্বীকার করেই তার কারণ খুঁজেছেন উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদী পণ্ডিতরাও।

সত্যিই কি ইতিহাসচেতনা ছিল না প্রাচীন ভারতে? ব্যতিক্রমী ঔপনিবেশিক পণ্ডিত এফ ই পার্জিটর দেখিয়েছিলেন বৈদিক সাহিত্যের সমান্তরালে ‘ইতিহাস-পুরাণ’ নামক একটি পরম্পরার অস্তিত্ব। পুরাণগুলি এবং মহাভারত এই পরম্পরাভুক্ত। পার্জিটরের দাবি, ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় সাহিত্যে ইতিহাসচেতনা না থাকলেও, ক্ষত্রিয়দের কীর্তিকাহিনি সংরক্ষণের জন্য চারণকবিদের এই পরম্পরা ইতিহাস-সচেতন, অতএব নির্ভরযোগ্য। পার্জিটর খেয়াল করেননি যে, কালক্রমে এই পরম্পরাও ব্রাহ্মণ্য নিয়ন্ত্রণে আসে। মহাভারত-রামায়ণের মূল কাহিনিধারা অপরিবর্তিত থাকলেও, তাতে ব্রাহ্মণ্য পরিমার্জন ও সংযোজন ঘটেছে। লিখিত পুরাণগুলি গুপ্ত বা গুপ্ত-পরবর্তী যুগে ব্রাহ্মণদেরই রচিত ধর্মগ্রন্থ। ফলে, পৌরাণিক বংশতালিকার ভিত্তিতে প্রাচীন ভারতের যে ইতিহাস পার্জিটর রচনা করেন, তা অভিলেখ, মুদ্রা প্রভৃতি সমকালীন উপাদানের নিরিখে ঐতিহাসিক-প্রত্নতাত্ত্বিক পরীক্ষার সামনে ভেঙে পড়ে।

Advertisement

ধর্মীয় সাহিত্যমাত্রই কি ইতিহাসচেতনাবিহীন? এই জরুরি প্রশ্ন প্রথম তোলেন উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল, যদিও তাকে তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছে রোমিলা থাপরের বই পাস্ট বিফোর আস। পাশ্চাত্যে ‘হিস্ট্রি’ লেখার পদ্ধতি চিরকাল এক থাকেনি। তা ছাড়া ‘হিস্ট্রি’ ইতিহাসচেতনার বহিঃপ্রকাশের একটি মাধ্যম হলেও একমাত্র মাধ্যম কি? ইউরোপকেন্দ্রিক ইতিহাসভাবনার একদেশদর্শিতা তুলে ধরে রোমিলা বলেন, বিভিন্ন প্রাগাধুনিক সংস্কৃতি তাদের অতীতচেতনার প্রকাশ ঘটায় বিভিন্ন ভাবে। সেগুলো পদ্ধতিগত ভাবে ‘হিস্ট্রি’-পদবাচ্য না হলেও, তাদের মধ্যে অতীত-বিবরণ সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন, অতীতকে কার্যকারণ-সম্পর্কযুক্ত কালানুক্রমে সাজানো, এবং সমসাময়িক সমাজের কাছে অতীতের তাৎপর্য নিয়ে সচেতনতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য যদি থাকে, সেগুলিকে ‘ঐতিহাসিক পরম্পরা’ বলা যায়। সব ঐতিহাসিক পরম্পরা তথ্যগত ভাবে ‘হিস্ট্রি’-র মতো নির্ভরযোগ্য নয় ঠিকই, কিন্তু এগুলি কোনও সমাজ তার অতীতকে কী ভাবে এবং কেন মনে রেখেছে, তার সাক্ষ্য দেয়। প্রাচীন ভারতে প্রথম দিকের ঐতিহাসিক পরম্পরাগুলি ছিল ধর্মীয় সাহিত্যে অন্তর্নিহিত, অর্থাৎ ‘এম্বেডেড হিস্ট্রি’।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম সাহিত্য ঋগ্বেদ-সংহিতা মূলত দেবতাদের বন্দনা হলেও তার মধ্যে উঁকি মারে মানুষের বিবরণও। ‘দানস্তুতি’ মন্ত্রগুলিতে যেমন ঋষি-কবিরা স্তুতি করছেন তাঁদের পৃষ্ঠপোষক বৈদিক গোষ্ঠীপতিদেরও। গোষ্ঠীপতিদের কীর্তিকাহিনি, দানধ্যান, যুদ্ধজয়ের বিবরণ তাঁদের স্মৃতিকে দিত অমরত্ব। কৃপণ গোষ্ঠীপতির নিন্দা তাঁকে করে রাখত চিরকলঙ্কিত। দানস্তুতি ‘হিস্ট্রি’ নয়— দানের বিবরণ অনেক সময়ই অস্বাভাবিক, অতিরঞ্জিত। কিন্তু এগুলি সমসাময়িক গোষ্ঠীপতিদের সামনে অতীতের দৃষ্টান্ত তুলে ধরার ইতিহাসচেতনাসম্পন্ন চেষ্টা। পরবর্তী বৈদিক-পরম্পরায় গাথা, নারাশংসী, আখ্যান অংশগুলিও বিভিন্ন যাগযজ্ঞের ব্যাখ্যা, উপযোগিতা ইত্যাদি তুলে ধরে অতীতের দৃষ্টান্ত দিয়ে।

বেদের পাশাপাশি, ইতিহাস-পুরাণ পরম্পরায় পাওয়া যায় রাজাদের (কাল্পনিক বা ঐতিহাসিক) বংশলতিকা ও কিংবদন্তি। অবশ্য, প্রচলিত ভাবে ‘হিস্ট্রি’-র প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ‘ইতিহাস’-পরম্পরা পদ্ধতি ও উদ্দেশ্যগত ভাবে ‘হিস্ট্রি’-র চেয়ে আলাদা। তা ছাড়া, চারণকবিদের মৌখিক পরম্পরা লিখিত রূপ পায় বহু শতাব্দীর বিবর্তনের পর, ব্রাহ্মণদের হাতে। মহাভারত, পুরাণ, রামায়ণের বর্তমান রূপ আর প্রাচীন ঐতিহাসিক পরম্পরার সম্পর্ক জটিল।

বৌদ্ধদেরও ছিল বিকল্প ঐতিহাসিক পরম্পরা। প্রাচীন পালি বৌদ্ধসাহিত্যে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের জীবন ও সমকালের বিচ্ছিন্ন স্মৃতি, বৌদ্ধসঙ্ঘে বিতর্ক-নিরসনের জন্য আয়োজিত সম্মেলনগুলির বিবরণ। একচেটিয়া রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরের মহাবিহারের অতীত-বিবরণ সঙ্কলিত হয়েছে দীপবংশ ও মহাবংশ-তে। সেখানে বৌদ্ধ পরম্পরার কল্পকাহিনিগুলির সঙ্গে মিশেছে ভারত থেকে আসা রাজপুত্র বিজয়ের শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিস্থাপনের কিংবদন্তি, মৌর্যসম্রাট অশোক-আয়োজিত তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতিতে থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য, অশোকের পুত্র মহিন্দ-র শ্রীলঙ্কায় এসে রাজা তিষ্যকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাদান, তামিল আক্রমণকারী এলারের বিরুদ্ধে স্থানীয় নায়ক দুট্ঠগামনীর জয়লাভের ইতিহাস। আবার, মহাবিহারের বদলে প্রতিদ্বন্দ্বী অভয়গিরি বিহারকে পৃষ্ঠপোষকতাদানের চেষ্টা যে প্রজাবিদ্রোহ ডেকে এনেছিল, জানায় মহাবংশ। এই পরম্পরাগুলির তথ্যনিষ্ঠ ‘হিস্ট্রি’ লেখেনি, অতীতকে ঢেলে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ধর্মের প্রয়োজনীয় ছাঁচে। তাই থেরবাদী বৌদ্ধপরম্পরায় আদর্শ রাজা অশোক, উত্তর ভারতের মহাযান বৌদ্ধপরম্পরার সংস্কৃত অবদানসাহিত্যে হয়ে ওঠেন কখনও বিধর্মীদের হিংস্র হত্যাকারী, কখনও তরুণী স্ত্রী তিষ্যরক্ষার বশীভূত দুর্বলচিত্ত রাজা, যাঁকে বার বার রক্ষা করে বৌদ্ধধর্মে অনুরাগ। এই অশোক, অভিলেখ-এর দৃঢ়মনা ঐতিহাসিক সম্রাট নন। যে কলিঙ্গ যুদ্ধের অভিঘাতে অশোকের নীতিপরিবর্তন, অবদানসাহিত্যে তা অনুপস্থিত— সন্ন্যাসী উপগুপ্তের প্রভাবে চণ্ডাশোক হন ধর্মাশোক। কুষাণ রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত-এ অরাজতান্ত্রিক শাক্য গণসঙ্ঘে জন্মানো বুদ্ধ হয়ে যান রাজপুত্র। রাজতন্ত্রের সার্বিকতা যত প্রসারিত হয়, মহাবস্তু-ললিতবিস্তরের মতো বুদ্ধজীবনীগুলিতে তত গুরুত্ব পায় বুদ্ধের রাজপরিচয়। হেমচন্দ্র, মেরুতুঙ্গদের লেখা জৈন ঐতিহাসিক পরম্পরাতেও ধরা থাকে মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ও গুজরাতের চালুক্যদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার বৃত্তান্ত।

আদিমধ্যযুগে অতীত-বিবরণ আর নিহিত থাকে না ধর্মগ্রন্থে, প্রকাশ্যে আসে ‘এক্সটার্নালাইজ়ড হিস্ট্রি’ হিসেবে। রাজসভার কবিরা রাজাদের বিতর্কিত সিংহাসনারোহণকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে লেখেন জীবনচরিত। যেমন, বাণভট্টের হর্ষচরিত, বিলহনের বিক্রমাঙ্কদেবচরিত, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত। রাজাদের অভিলেখতে ঐতিহাসিক বংশপঞ্জি পরিবেশনের পাশাপাশি সভাকবিরা ভুঁইফোঁড় রাজবংশকেও জুড়ে দেন পৌরাণিক কিংবদন্তির সূর্যবংশ বা চন্দ্রবংশের সঙ্গে। প্রান্তিক অঞ্চলের রাজবংশগুলির ধারাবাহিক বিবরণ (পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক) একত্রিত করে বংশাবলি-পরম্পরা আবার উপমহাদেশীয় রাজনীতির মূলস্রোতে জুড়তে চান সেই অঞ্চলকে। প্রান্তিক কাশ্মীরের বংশাবলি রাজতরঙ্গিণী-ও ভারতীয় ইতিহাসচেতনার এই দীর্ঘ বিবর্তনেরই ফসল— আকস্মিক ভাবে উদিত হওয়া কোনও নতুন ধারার প্রথম ইতিহাসগ্রন্থ নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement