গত মার্চ মাসে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যা গ্রহণ করেছে ভারত-সহ ১৯৫টি দেশের সরকার। ফাইল ছবি।
তাপপ্রবাহের জন্য যখন সন্তানের লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে, তখন বুঝতে হবে, সময় এসেছে জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে এখনই কিছু করার দাবি তোলার। আমি জলবায়ু বিজ্ঞানী, এবং দুই শিশুসন্তানের মা। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের যে সংগঠনটি (আইপিসিসি) গত মার্চ মাসে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যা গ্রহণ করেছে ভারত-সহ ১৯৫টি দেশের সরকার, আমি তার সদস্য ছিলাম। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, তাপপ্রবাহ এত তীব্র হবে যা মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে আমরা এ বছর তেমন তাপপ্রবাহ দেখলাম, যার ফলে সরকার স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিল। অতিমারির জন্য দীর্ঘ ছুটিতে কয়েক লক্ষ পড়ুয়া স্কুলছুট হওয়ার পর, আবার অসময়ে স্কুল বন্ধ হল। আমাদের সন্তানরা আমাদের চাইতে অনেক উষ্ণ এক গ্রহে জন্মেছে, যে উষ্ণতার কারণ মানুষের কার্যকলাপ। আজ আমরা যা করব, তার উপর নির্ভর করছে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ। সরকার, নাগরিক সমাজ, এবং ব্যক্তি হিসাবে আমরা কী করতে পারি, পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে রেখে যেতে?
পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১০.৭ গিগাওয়াট, যার প্রায় ৯৫ শতাংশ আসে কয়লা থেকে, যা উষ্ণায়নের এক প্রধান কারণ। ২০৩০ সালের মধ্যে সৌর, বায়ু, প্রভৃতি উৎস থেকে অন্তত ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়েছে রাজ্য। তাতে অতি বিলম্বে, অতি সামান্য কাজ হবে। এখনই ভারতের বেশ কিছু রাজ্য তাদের বিদ্যুতের ৪০-৪৫ শতাংশ উৎপাদন করে সৌর, বায়ু প্রভৃতি থেকে, পশ্চিমবঙ্গ পারবে না কেন? সে প্রযুক্তি তেমন ব্যয়সাধ্যও নয়। যা নেই, তা হল সৌরবিদ্যুতে বিনিয়োগকে আকর্ষণীয় করে তোলা। যেমন, প্রতিষ্ঠান বা গৃহস্থ বাড়িগুলি সৌর প্যানেল বসালে তাদের বিদ্যুৎ বিলে ছাড় দেওয়া, বা স্কুল-কলেজের ছাদে সৌর প্যানেল বসানোয় বিনিয়োগে সহায়তা করা। তাতে সুলভ এবং স্বচ্ছ বিদ্যুতের জোগান দ্রুত বাড়তে পারে। বর্তমানে রাজ্যে আড়াই লক্ষ থেকে তিন লক্ষ সেচ পাম্প রয়েছে। সেগুলিকে সোলার বিদ্যুৎ-চালিত করা যায়, এবং চাষিদের বিদ্যুৎ গ্রিডে সৌরবিদ্যুৎ বিক্রির সুযোগ করে দেওয়া যায়।
আসলে, যাঁরা বিদ্যুতের ক্রেতা, তাঁরাই আবার বিদ্যুৎ উৎপাদক, এটা সহজে মানতে পারে না সরকার। এমন মনোভাব থেকে সরে এসে বাস্তবকে মেনে নেওয়াই ভাল। বাস্তব এই যে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ দ্রুত কমাতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ যদি এ বিষয়ে আপৎকালীন তৎপরতায় কাজ না করে, তা হলে স্বচ্ছ জ্বালানিতে সরে আসার জন্য প্রাপ্য আন্তর্জাতিক অনুদান হারাতে পারে।
পরিবহণের চিত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা অনেক রাজ্যের তুলনায় ভাল, কারণ কলকাতায় রয়েছে সব চাইতে বেশি বিদ্যুৎ-চালিত বাস। এ রাজ্যে মাথাপিছু প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যাও ভারতের গড়ের চাইতে কম। আমাদের গণপরিবহণকে আরও উন্নত করতে লোকাল ট্রেন এবং বিদ্যুৎ-চালিত বাসের সংখ্যা আরও বাড়ানো চাই। ট্রামকে আবার ফিরিয়ে আনাই ভাল। প্রাইভেট গাড়ির ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ-চালিত গাড়িকে আরও সুলভ করা, এবং চার্জিং স্টেশন আরও বেশি করা দরকার। তবে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো লক্ষ্য নয়, আসল সমাধান গণপরিবহণের প্রসার।
হুগলি নদীর কাছে অবস্থান, এবং চার পাশে জলাভূমি থাকায় কলকাতা সহজেই জল ধরে রাখতে পারত, বন্যা প্রতিরোধ করতে পারত। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ নগর পরিকল্পনার ফলে এই মহানগর সে ক্ষমতা হারিয়েছে। সঙ্গে, অতি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের মোকাবিলা করার ক্ষমতাও হারিয়েছে। জলাভূমিকে রক্ষা করতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে সবুজ পরিসর, সম্ভব হলে নগর-অরণ্য তৈরি করতে হবে। আমাদের সন্তানদের জন্য আরও পরিষ্কার, আরও সবুজ শহর তৈরির দাবি রাখতে হবে পুরসভার কাছে, পাড়া প্রতিবেশীর কাছে।
যে পাঠক এসি-শীতল গাড়িতে বা বৈঠকখানায় বসে এই কাগজ পড়ছেন, তিনি প্রায় অবধারিত ভাবে আয়ের নিরিখে দেশের শীর্ষ এক শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশ মানুষের মধ্যে পড়েন। এই পাঁচ শতাংশ ভারতীয়ের ‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট’ বাকি পঁচানব্বই শতাংশের চাইতে বড়। ফলে আমাদেরও সতর্ক হতে হবে, উপভোক্তা হিসাবে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। ভোগ্যদ্রব্যের ব্যবহার কমাতে হবে, পুনর্ব্যবহার করতে হবে, ‘রিসাইকল’ করতে হবে। মিডিয়া এবং সমাজ যে ভাবে তারকাদের ভোগসর্বস্ব জীবনশৈলীকে লোভনীয় বলে তুলে ধরে সবার সামনে, তা থামাতে হবে। আমি অন্তত ভারতের সব চাইতে ধনী ব্যক্তির ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের এলাহি আয়োজন এবং অজস্র অপচয় দেখতে চাই না। বরং দেখতে চাই, এ বিশ্বকে আরও বাসযোগ্য করার জন্য সাধারণ নাগরিক কী কী অসাধারণ উদ্যোগ করছেন।
গত কাল ছিল অতিমারি, আজ তাপপ্রবাহ, এর পর হয়তো আসবে বিধ্বংসী বন্যাবা ঝঞ্ঝা, আবার বন্ধ হবে স্কুল। আমাদের সন্তানরা এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর মূল্য চোকাচ্ছে। তাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত রাখার উদ্যোগ এখনই করতে হবে।