আবার: নতুন তৃণমূল কংগ্রেস ভবনের ভূমিপুজো করছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ১ জানুয়ারি
ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবস। নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানানোর সঙ্গে ওই দিন দলীয় নেতৃত্বের কিছু রাজনৈতিক বার্তাও তাই শোনা যায়। এ বার তৃণমূলের পঁচিশ বছরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তাটি গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, নানা দিক থেকে তার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী।
পঞ্চায়েত ভোট কার্যত দুয়ারে এসে পড়েছে। পাশাপাশি লোকসভা ভোটের হিসাব কষাও শুরু। এমন একটি সময়ে তৃণমূলের ‘দুর্নীতিমুক্ত’ ভাবমূর্তি তুলে ধরার লক্ষ্যে ভেবেচিন্তেই কঠোর পদক্ষেপ করার ঘোষণাটি করেছেন অভিষেক।
পঞ্চায়েত এবং দুর্নীতি শব্দ দু’টি এই রাজ্যে সমার্থক বললে অত্যুক্তি হবে না। তার চরিত্র বদলেছে। ছিঁচকেরা চোর হয়েছে, চোরেরা ডাকাত! বাম আমলে এক ভাবে দুর্নীতি করা হত। এখন তৃণমূলের পদ্ধতি ভিন্ন। তবে মূলে ‘ব্যাধি’ থেকেই গেছে। যেমন, আগে মাস্টার রোলে ভুয়ো ‘টিপছাপ’ দিয়ে পঞ্চায়েত নেতারা ধারাবাহিক ভাবে ‘অবোধ’ উপভোক্তাদের প্রাপ্য টাকা আত্মসাৎ করতেন। এখন সরকারি প্রকল্পে যোগ্য প্রাপকের নামই ওঠে না তালিকায়। পরিবর্তে ক্ষমতাশালীদের ঘনিষ্ঠরা ‘অভাবী’ সেজে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ঘরে তোলেন! হাতেকলমে তার অনেক প্রমাণও মিলছে।
পঞ্চায়েতের চেয়ারে বসতে পারলে জীবনযাপনের মান তখনও রাতারাতি বদলে যেত, এখনও যায়। তখন গ্রামের লোক ‘জাদুমন্ত্রে’ হাড় জিরজিরে সাইকেলকে ঝাঁ-চকচকে মোটরবাইক হয়ে যেতে দেখত। টালির চাল হয়ে উঠত পাকা দালান কোঠা। লোকজন আড়ালে বলত ‘পঞ্চুবাবু’। এখন তো বহু পঞ্চায়েত-নেতার ‘প্রাসাদ’! দামি গাড়ি। মাঝে মাঝে যার বহর দেখে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রশ্ন না-তুলে পারেন না।
কলকাতার লাগোয়া রাজারহাট-নিউ টাউন বিধানসভা কেন্দ্রের বালিগড়ি এলাকায় কয়েক দিনের মধ্যেই ‘এমএলএ কাপ’ ফুটবল টুর্নামেন্ট হবে। ‘ব্যবস্থাপনায়’ নাম রয়েছে এক পঞ্চায়েত সদস্যের। মমতা এবং অভিষেকের ছবি-সহ ব্যানারে জানানো হয়েছে, সেই খেলার প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কার দু’টি মোটরগাড়ি! কে জোগায় এত টাকা?
সিপিএমের আমলে পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদায় এক গ্রাম-পঞ্চায়েত সভাপতি দুর্নীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বুঝিয়েছিলেন, কেউ হয়তো পাঁচ হাজার টাকার প্রলোভন সামলাতে পারেন। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার বা পাঁচ লাখের হাতছানি তিনি সামলাতে পারবেন কি না, সেই ‘পরীক্ষা’ না-হলে সততা যাচাই হবে কী করে! তাঁর মতে, সব ক্ষেত্রেই একটা মানদণ্ডে ভাবতে হয়। অতএব ‘নিখাদ সততা’ বলে আদৌ কিছু হয় কি না, বলা কঠিন!
তবে শুধুই তো টাকা নয়। ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে, সঠিক প্রাপকদের বঞ্চিত করে নিজেদের আত্মীয়-পরিজন বা কাজের লোকেদের নামে জমি, বাড়ি, আর্থিক অনুদান বাগিয়ে নেওয়া তো আরও বড় দুর্নীতি। সংগঠিত অপরাধও বলা যায়। কারণ, তখন পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে ‘বিষ’ ঢোকাতে হয়। সম্প্রতি ‘আবাস’ প্রকল্প নিয়েও অভিযোগ এমনই।
সবাই জানেন, গ্রামে রাজনৈতিক ভিত কায়েম করার প্রধানতম হাতিয়ার পঞ্চায়েত। তার রাজনৈতিক ফসল প্রায় সবটাই শাসকের ঘরে ওঠে। কারণ, তাদের হাতে যেমন ‘পাইয়ে’ দেওয়ার ক্ষমতা, তেমনই ভয় দেখানোর শক্তিও। সিপিএম ছিল তার পথপ্রদর্শক, তৃণমূল এখন কার্যত অনুসারী।
এ কথা ঠিক, কোনও দলেই সবাই দুর্নীতির আশ্রয় নেয় না। পঞ্চায়েতের মতো নিচুতলায় ক্ষমতায় বসে কোথায় কে কী ভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, সব সময় উপরতলায় তার নির্দিষ্ট খবর না-পৌঁছনোও হয়তো খুব অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এগুলি কতটা ‘বিপদ’ ডেকে আনে তৃণমূল তার ভুক্তভোগী।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কার ময়নাতদন্তে নেমে তৃণমূল নেতৃত্ব সম্যক বুঝেছিলেন, পঞ্চায়েতের দুর্নীতি কী ভাবে বাসা বেঁধেছে। ‘দিদিকে বলো’ ছিল সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য মমতার প্রথম প্রয়াস। ক্ষুব্ধ মানুষ কী ভাবে অভিযোগ জানাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তা-ও ভোলার নয়।
এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই এল ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’। এক অর্থে, এটি তৃণমূল নেতৃত্বের অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা। তাই কর্মসূচি ঘোষণা করতে গিয়ে মমতা নিজেই বলেছেন, “ধান গাছে একটা পোকা হলে সেই পোকা সমূলে ধ্বংস করতে হয়। নইলে সেটা সব ধান নষ্ট করবে।”
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যে এক প্রকার স্বীকারোক্তি স্পষ্ট। যাতে বোঝা যায়, ‘পোকা’ এখনও তার কাজ করছে। কিন্তু অসুখ ধামাচাপা না রেখে সরাসরি মোকাবিলা করার একটি উদ্যোগও এর মাধ্যমে বোঝানো যাচ্ছে। বিরোধীদের অভিযোগের পরিসর কিছুটা সঙ্কুচিত করে দেওয়ার এবং জনমনে শাসকের দুর্নীতি-বিরোধী ভাবমূর্তি তুলে ধরার এটি এক সচেতন কৌশল বলা যায়। পরিকল্পনাটি প্রধানত অভিষেকের। মমতা সিলমোহর দিয়ে ‘নবীন’কে মান্যতা দিলেন।
বেশ কিছু দিন ধরেই দলের ভিতরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিষেক সরব। বিশেষ করে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নগদ-কেলেঙ্কারির সময় থেকে নিয়মিত এটা তিনি বলছেন। পঞ্চায়েত ভোট সুষ্ঠু করার ব্যাপারেও তিনি প্রকাশ্যে যে আপসহীন অবস্থান নিয়েছেন, অনুব্রত মণ্ডল জেলে যাওয়ার পর সেটা আরও অর্থবহ হয়ে উঠেছে।
‘সদা সত্য কথা বলিবে’র মতো দুর্নীতি বা অনিয়মের বিরুদ্ধে সরব হওয়াও দলনির্বিশেষে রাজনীতিকদের স্বাভাবিক ধর্ম। আর একটি মজার বিষয়, যারা যখন বিরোধীপক্ষ, তারাই তখন সততার প্রতিমূর্তি! ক্ষমতায় থাকলে যারা দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক বলে চিহ্নিত হয়, বিরোধী হয়ে গেলে দেখা যায় নয়া ভূমিকায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারাই সবচেয়ে বেশি সরব!
কিন্তু শাসক দল নিজেরাই যদি তাদের বিভিন্ন পদাধিকারীর দিকে আঙুল তুলতে শুরু করে, তখন আপাত ভাবে বিষয়টি কিছুটা ব্যতিক্রমী লাগে। হয়তো ভিন্ন বার্তা বলে মনে হয়। তৃণমূলের শীর্ষনেতা হিসাবে অভিষেক সেই পথ নিচ্ছেন।
বহু পুরনো একটি ঘটনা মনে পড়ছে। চাকরির গোড়ার দিক। ১৯৮২-র বিধানসভা ভোটের আগে সিপিএমের রাজ্য দফতরে প্রমোদ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ওই দলের এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিধায়কের কথা উঠল। তাঁর বিরুদ্ধে তখন জুলুম, তোলাবাজির গুচ্ছ-গুচ্ছ অভিযোগ শোনা যেত।
ওই ব্যক্তিকে ফের প্রার্থী করা নিয়ে প্রশ্ন করায় প্রমোদবাবু দৃঢ় ভাবে বললেন, “দল তদন্ত করে দেখেছে। অভিযোগ ঠিক নয়।” কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। একটু চুপ থেকে প্রমোদ দাশগুপ্তের পরবর্তী সংযোজন, “হাতের পাঁচটা আঙুল সমান হয় না। সেটা নিয়েই হাত। নইলে তো হাতটাই কেটে ফেলতে হয়। এ সব আবার লিখো না।”
আজও সেই প্রয়াত নেতার নাম করব না। তবে আজকের শাসক শিবিরের ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে সেই স্মৃতি কিছুটা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। কারণ, এখনকার শাসক দলে নতুন প্রজন্মের প্রধান নেতা অভিষেক ‘দুর্নীতিমুক্ত’ ও ‘সক্রিয়’ তৃণমূল গড়তে চেয়ে রাখঢাক করছেন না। বরং, প্রথম রাতেই বিড়াল মারা শুরু করে দিয়েছেন ঢাক পিটিয়ে। বিপুল সম্পত্তি করার অভিযোগে ইতিমধ্যেই সরানো হয়েছে তমলুকের এক পঞ্চায়েত প্রধানকে। দায়িত্ব পালনে ঘাটতির অভিযোগে পদত্যাগ করতে হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর ও নদিয়ার আরও কয়েক জন গ্রাম-পঞ্চায়েত প্রধান, উপপ্রধানকে।
দুর্নীতিগ্রস্তদের দল থেকে ‘ঘাড়ধাক্কা’ দেওয়ার নীতিতে অভিষেক প্রকৃতই অটল থাকলে তালিকা দীর্ঘ হতে বাধ্য। জেলা পরিষদ পর্যন্ত। শোনা যাচ্ছে, গ্রামের পরে শহরও আসবে।হতে পারে, ‘ঘাড়ধাক্কা’ খেয়ে একাংশ হয়তো বিকল্প রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজবেন। কেউ কেউ হয়তো চেষ্টা করবেন সাধ্যমতো ‘সাবোতাজ’ করে ঝাল মেটাতে।
কাঁটা-পথে হাঁটার ঝুঁকি নিয়ে অভিষেক কী ভাবে এগোবেন, তাঁর ব্যাপার। তবে যুক্তি বলে, তিনি কয়েকটি কঠোর উদাহরণ তৈরি করতে পারলে তৃণমূলের ‘ভাবমূর্তি’ তুলে ধরার বাইরে দলে তাঁর কর্তৃত্বের রাশও আরও মজবুত হতে পারে।