শাসক: আলাউদ্দিন খিলজির রণথম্ভোর গড় বিজয়। আঠারো শতকের কাংড়া চিত্র। উইকিমিডিয়া কমনস।
মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক আজকাল প্রায়ই আলোচনায় আসে। কেউ জোর দেন আকবরের উদারপন্থী নীতিতে, কেউ ঔরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসে। অথচ মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর যখন ভারত আক্রমণ করেন, তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইব্রাহিম লোদীও ছিলেন মুসলমান। আফগান লোদীদের আগেও প্রায় তিন শতাব্দী দিল্লির মসনদে বসেছেন বিভিন্ন রাজবংশের মুসলমান শাসকেরা। অষ্টম শতকে আরবরা সিন্ধু আক্রমণ করলেও উপমহাদেশের গভীরে প্রবেশ করেননি। কিন্তু আরবদের সঙ্গে গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল ভারতের পশ্চিম উপকূলের। দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটরা আরবদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্বও তুলে দিয়েছিলেন। বাণিজ্যিক সহযোগী আর সাম্রাজ্য বিস্তারকারী শাসক এক নয়, তাঁদের ধর্মবিশ্বাস এক হলেও।
১১৯২-এ তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মহম্মদ ঘুরীর জয়লাভের ফল ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত তুর্কি-আফগান শাসন, যার কেন্দ্রে ছিল দিল্লি। ভারতে ইসলামি রাজতন্ত্রের প্রকৃতি বুঝতে মোগল শাসন-পূর্ব ইতিহাস বুঝতে হবে।
ইসলাম প্রতিষ্ঠালগ্নে রাজতান্ত্রিক ছিল না। হজ়রত মহম্মদের পর ইসলামের নেতৃত্বভার যে খলিফাদের হাতে যায়, তাঁরাও বংশানুক্রমিক রাজা ছিলেন না। কালক্রমে খলিফা পদ রাজতান্ত্রিক হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক সম্প্রসারণের ফলে বিশাল ইসলামি জগতের উপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণও খলিফার পক্ষে ছিল অসম্ভব। নববিজিত অঞ্চলগুলির শাসকেরা কার্যত ছিলেন স্বাধীন রাজা— তাঁদের উপাধি হয় ‘সুলতান’ শব্দটি। ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিকরা নবগঠিত সুলতানির রূপরেখা বিধিবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। আবু হামিদ আল-গজালির মতে, সুলতানের প্রধান কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ধর্মের উন্নতিসাধন, প্রজাপালন, ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা, ইসলামি শাসনের প্রসার, ধর্মযুদ্ধ করা। আবার সমসাময়িক বাস্তববাদী তাত্ত্বিক নিজাম-উল-মুলক তুসি সিয়াসতনামা-য় লেখেন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাই সুলতানের প্রধান কাজ, ধর্মরাষ্ট্র স্থাপন নয়। দিল্লির সুলতানেরা কোন পথে গিয়েছিলেন?
সুলতানি আমলের গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসী ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন বরণীর মতে, দীনদারি (ধর্মীয় শাসন) নয়, দিল্লির সুলতানরা বেছে নিয়েছিলেন দুনিয়াদারি বা জাহানদারি-র (বাস্তবসম্মত শাসন) পথ। তা ছাড়া, ধর্মগুরুদের নিয়ন্ত্রণ এড়াতে তাঁরা প্রায়ই সুফি দার্শনিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতেন। দিল্লি ও সংলগ্ন অঞ্চলে বেশি প্রভাব বিস্তার করে চিশতি সিলসিলা। মইনুদ্দিন চিশতি, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী, বাবা ফরিদ, নিজামুদ্দিন আউলিয়া, নাসিরুদ্দিন চিরাগ-ই-দিল্লির মতো ধর্মগুরুদের আশ্রমে সব ধর্মের অবারিত দ্বার; এঁরা রাজসভা থেকে দূরত্বরক্ষা, সহজ-সরল জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন যোগী ও ভক্তিবাদী সাধকদের সঙ্গে চিশতিদের ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। মইনুদ্দিনের দার্শনিক ভাবনার সঙ্গে ঔপনিষদিক একেশ্বরবাদের মিল লক্ষ করা যায়। নিজামুদ্দিন ঘোষণা করেন, সব ধর্মের মানুষের নিজস্ব বিশ্বাস ও উপাসনাপদ্ধতি থাকতেই পারে।
মহম্মদ ঘুরীর আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে উত্তরাধিকারের লড়াই শুরু হয়, তাতে অংশগ্রহণকারী কুতুবউদ্দিন আইবকের ঘাঁটি ছিল প্রথমে লাহোর, পরে দিল্লি। কুতুবউদ্দিনের অকালমৃত্যুর পর তাঁর দাস ইলতুৎমিস দিল্লির স্বাধীন সুলতানের স্বীকৃতি আদায় করেন স্বয়ং খলিফার থেকে। রাজার স্বাধীন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ইলতুৎমিস গোঁড়া ধর্মগুরুদের কতখানি অগ্রাহ্য করতেন, তার প্রমাণ তাঁদের বিরোধিতা সত্ত্বেও কন্যা রাজিয়াকে উত্তরসূরি নির্বাচন। রাজিয়ার শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে ইলতুৎমিসের পূর্বতন দাস গিয়াসুদ্দিন বলবন ক্ষমতা দখল করেন, তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল দিল্লির সুলতানের পূর্ণ রাজমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা। পূর্ণ রাজতন্ত্রের ধারণা বলবন ধার করেন প্রাক্-ইসলামি পারসিক সাম্রাজ্য থেকে। প্রাচীন সম্রাটদের মতো নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি দাবি করে তিনি জাঁকজমকপূর্ণ রাজসভা ও রাজার সামনে নতিস্বীকারের প্রথা প্রচলন করেন। ছেলেকে তাঁর উপদেশ ছিল ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের অনুশীলন, রাষ্ট্রশাসনে গোঁড়া ধর্মগুরুদের থেকে দূরত্ব রাখা।
বলবনের মৃত্যুর অল্প পরে তুর্কি শাসনের অবসান ঘটান জালালুদ্দিন ফিরোজ খিলজি। খিলজিরা তুর্কি বংশোদ্ভূত হলেও বহুকাল ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশেরই বাসিন্দা। বলবনের দৃষ্টিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিমরাও ছিলেন নিম্নশ্রেণিভুক্ত। খিলজি প্রশাসনে ভারতীয় মুসলিম ও অ-মুসলিমরা জায়গা করে নেন। হিন্দুদের বলপূর্বক ধর্মান্তরণ ও অবমাননার যে পরামর্শ ধর্মান্ধ উলেমারা দিয়েছিলেন, তাকে নাকচ করে জালালুদ্দিন হিন্দুদের মূর্তিপুজো, ধর্মপ্রচার, রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে যমুনায় মূর্তি-বিসর্জনের অধিকার দেন। জালালুদ্দিনকে হত্যা করে ক্ষমতা দখলকারী আলাউদ্দিন, ষোড়শ শতকের এক কাল্পনিক সুফি কাব্য ও তার আদলে নির্মিত জনপ্রিয় সাহিত্য-চলচ্চিত্রের কল্যাণে এখন নারীলোলুপ, আক্রমণকারী রূপে চিত্রিত। ইতিহাসের আলাউদ্দিন অবশ্য একাধিক মোঙ্গল আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন দেশকে, কঠোর হাতে বাজারদর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যকে রেখেছিলেন প্রজার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। ধর্মগুরুকে তিনি জানান, রাজ্যশাসনে রাজার সিদ্ধান্তই সর্বোচ্চ, তার ভিত্তি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ও জনকল্যাণ। তিনিই প্রথম বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে রাজপুতদের শাসনব্যবস্থার অংশীদার করতে চান। রাজা রামচন্দ্রের মেয়ে ঝাতিয়াপালি ছিলেন তাঁর অন্যতম স্ত্রী। গুজরাতি রানি কমলাদেবী আলাউদ্দিনের হারেমে স্থান পেয়ে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেন, তাঁর মেয়েকে বিবাহ করেন আলাউদ্দিনের সম্ভাব্য উত্তরসূরি খিজ়র খান। রাজস্ব আদায়ে আলাউদ্দিনের কঠোর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে হিন্দু ভূস্বামী ও গ্রামীণ নেতৃবর্গের দুরবস্থার কথা বরণী জানান। বোঝা যায়, এই সব পদ মূলত হিন্দুদের হাতেই ছিল।
খিলজি-পরবর্তী তুঘলক আমলে চিশতিদের রাজসভার আনুগত্য মানতে অনীহা গিয়াসুদ্দিন ও মহম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গে তাঁদের সংঘাত বাধায়। তবে প্রশাসনে অ-মুসলিম কর্মচারীদের নিয়োগ বহাল থাকে। ইসলামি শাস্ত্রে সুপণ্ডিত মহম্মদ বিন তুঘলক হোলিতে যোগ দিতেন, ধর্মালোচনা করতেন জৈন পণ্ডিতদের সঙ্গেও। ফিরোজ় শাহ তুঘলকের শাসনের প্রথম দিকও ছিল অনুরূপ। কৃষি ও সেচ সংস্কার, শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতি করে দিল্লির আর্থিক সমৃদ্ধি ব্যাপক হারে বাড়ানো ফিরোজ়ের রাজত্বে বহু সংস্কৃত গ্রন্থের পারসিক অনুবাদ হয়। কিন্তু রাজত্বের শেষ পর্বে তিনি মৌলবাদী হয়ে ওঠেন, ব্রাহ্মণদের উপর ধর্মকর আরোপ, মূর্তিপুজোর অভিযোগে ব্রাহ্মণহত্যা, ইসমাইলি শিয়া ধর্মগুরুদের মৃত্যুদণ্ড, নির্মীয়মাণ মন্দির ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর ধর্মান্ধতা হয়তো ছিল দিল্লি সুলতানির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
১৩৯৮-এ তৈমুরের আক্রমণে বিধ্বস্ত দিল্লি তার হৃতগৌরব ফিরে পায়নি সৈয়দ বা লোদী শাসনে। আফগান জনজাতিভুক্ত লোদী রাজত্বকে সাম্রাজ্যের রূপ দিতে চাওয়া সিকন্দর লোদী উলেমাদের চেয়েছিলেন সহযোগী রূপে। তাঁর রাজত্বেও তাই গোঁড়া ধর্মীয় শাসনের কিছু লক্ষণ দেখা যায়। একক রাজতন্ত্রে লোদী প্রশাসনের পরিবর্তন অবশ্য মেনে নিতে পারেননি লোদীদেরই একাংশ। বাবরকে ভারত আক্রমণে ডাকেন ইব্রাহিম লোদীর আত্মীয়রাই!
ভারতে ইসলামি রাজতন্ত্র ধর্মীয় রাষ্ট্র হতে পারে না, এই আদর্শের ভিত্তি স্থাপিত সুলতানি আমলেই। দিল্লির থেকে স্বাধীন হওয়া অনেক আঞ্চলিক সুলতানিও মেনে চলেন এই আদর্শ। তুর্কি-বিজেতাদের হাতে নালন্দা-বিক্রমশিলা ধ্বংস যেমন সত্য, তেমনই বাংলার ইলিয়াসশাহি-হুসেনশাহি সুলতানির ছত্রছায়াতেই কৃত্তিবাস ওঝা, মালাধর বসু, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দীরা রচনা করেন রামকথা, ভাগবত, মহাভারত। সুলতানি যুগেই ইন্দো-ইসলামীয় মিশ্র সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপনা। ত্রয়োদশ শতকের সংস্কৃত লেখও তাই বলেছে: ভূভার রক্ষার দায় দক্ষ হাতে তুলে নিয়েছেন গয়সংদীন (গিয়াসুদ্দিন বলবন), নিশ্চিন্তে তাই বিষ্ণুর শয্যায় ফিরে যেতে পারেন শেষনাগ!