সংবাদপত্রে শিরোনাম হচ্ছে প্রায় প্রতি মাসেই— ‘খাবার মিলছে না অঙ্গনওয়াড়িতে’। মানবোন্নয়ন সূচকে ভারত এমনিতেই পিছিয়ে, তার মধ্যেও সবচেয়ে লজ্জাজনক অবস্থা শিশুপুষ্টিতে। অতিমারিতে শিশুপুষ্টি বজায় রাখতে বাড়তি উদ্যমের প্রয়োজন ছিল। সেটা তো দেখা যাচ্ছেই না, উল্টে যে খাবারটুকু নিয়মিত পাওয়া যেত, তা-ও উধাও! গত পাঁচ মাস এ রাজ্যের অঙ্গনওয়াড়ি থেকে চাল-ডাল-সয়াবিন, কিছুই মিলছে না। অথচ, পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের প্রতি তিন জনের মধ্যে অন্তত এক জন পুষ্টির অভাবে দৈর্ঘ্যে খাটো (‘স্টান্টেড’), প্রায় ততগুলি শিশুরই ওজন বয়স অনুপাতে কম। পাঁচ জনে এক জন শিশুর ওজন তার উচ্চতার অনুপাতে কম (‘ওয়েস্টেড’)। এক কথায়, পুষ্টির অভাবে আমাদের শিশুদের দেহ-মনের বিকাশ আটকে যাচ্ছে। আরও আক্ষেপ, পাঁচ বছরের ব্যবধানে একই সমীক্ষা (জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা, ৪ এবং ৫) দেখাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গে শিশু-অপুষ্টি কমেনি— বরং অপুষ্টির কিছু লক্ষণ (‘স্টান্টিং’, ‘ওয়েস্টিং’) অল্প হলেও বেড়েছে।
এই পটভূমিকায় অতিমারির সময়ে শিশুদের পুষ্টির একটু বেশি নজর প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু খবরে দেখছি, আধিকারিকরা জানিয়েছেন যে, ভারতীয় খাদ্য নিগমের থেকে খাদ্যশস্য চেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না সময়মতো। অথচ, সরকারের ভাঁড়ারে এত খাদ্যশস্য আগে কখনও মজুত ছিল না। অসন্তুষ্ট কৃষকদের তুষ্ট করতেই হোক, বা প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা রূপায়ণের তাগিদেই হোক, ২০২১ সালের ১ মে রাষ্ট্রের ভাঁড়ারে ১০ কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুত ছিল, যা স্বাধীন ভারতে এযাবৎ সর্বাধিক। গত বছরও যত খাদ্য মজুত ছিল, তা ছিল অতীতের নিরিখে রেকর্ড। অতিরিক্ত শস্য গুদামজাত করে রাখার খরচ কিলোগ্রাম প্রতি ৫.৪০ টাকা। অর্থাৎ বিনামূল্যে বিলি করলেও সাশ্রয় হবে সরকারের। স্রেফ লাল ফিতের ফাঁসে এই খাদ্যশস্য আটকে রাখলে অডিটের সময় সংশ্লিষ্ট দফতর অকারণ ব্যয়বৃদ্ধির দায়ে পড়তে পারে। তা সত্ত্বেও দেখা গেল— খাবার রইল গুদামে, শিশুরা পেল না।
মনে হতে পারে যে, না-ই বা এল সরকারের চাল, বাজারে তো চাল কম নেই। চালে টান পড়লে সেখান থেকে কিনে দেওয়া হয় না কেন? আরও কয়েকটা বড় রাজ্যের মতো, পশ্চিমবঙ্গেরও প্রয়োজন অনুযায়ী অঙ্গনওয়াড়ির খাদ্যশস্য বাজার থেকে সংগ্রহ করার স্বাধীনতা আছে। তা হলে সমস্যা কোথায়? এর কোনও স্পষ্ট উত্তর দেওয়ার দরকার মনে করেনি রাজ্য বা কেন্দ্র।
সন্দেহ হয়, সমস্যা কি তবে টাকা বরাদ্দে? ২০২১-২২ সালের বাজেটে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার আগের নানা প্রকল্পকে মিলিয়ে দিয়ে এখন দু’টি প্রকল্প চালাচ্ছে— ‘সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি’ এবং ‘পোষণ ২’। এ দু’টি স্কিমে ২০২১-২২ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ২০,১০৫ কোটি টাকা। কিন্তু পূর্বসূরি প্রকল্পগুলোতে আগের বছরের বরাদ্দকৃত টাকা যোগ করে পাচ্ছি ২৪,৫৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বরাদ্দ কমেছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।
কার্পণ্য কেবল শিশুর খাদ্যেই নয়। ২০১৯-২০ সালে নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের ৩৯,৭২২ কোটি টাকা চাহিদা মেটাতে বরাদ্দ হয়েছিল ২৬,১৮৫ কোটি টাকা— চাহিদার ৬৬%। তার পরের বছর বরাদ্দ আরও কমে দাঁড়িয়েছে চাহিদার ৬২%।
শিশু ও মায়েদের পুষ্টির খামতি মেটাতে উপযুক্ত খাদ্য দিতে (‘সাপ্লিমেন্টারি নিউট্রিশন’) কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয়ই টাকা বরাদ্দ করে। একটি গবেষণা সংস্থা দেখাচ্ছে যে, যদি হিসেবের খাতিরে ধরা যায় যে, রাজ্যগুলি তাদের ভাগের সব টাকাই দিয়েছে, তা হলেও জনসংখ্যা অনুযায়ী যত শিশু থাকার কথা, এবং কেন্দ্রীয় সরকার মাথাপিছু যে হারে টাকা বরাদ্দ করেছে, তা ভারতের শিশু ও মায়েদের প্রয়োজনের অর্ধেকেরও কম (৪৭ শতাংশ)। কোভিড অতিমারিজনিত বিপুল বেকারত্ব ও অর্থাভাবের পরিস্থিতিতেও তা বাড়েনি। ২০১৯-২০ সালের এপ্রিল-ডিসেম্বরে পুষ্টির খাতে যত টাকা দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে ২০২০-২১ সালের এপ্রিল-ডিসেম্বরে দেওয়া টাকার তুলনা করলে পাওয়া যাচ্ছে যে, সর্বভারতীয় স্তরে সামান্য বেশি টাকা দেওয়া হলেও, আগের বারের তুলনায় কম পেয়েছে ৯টি রাজ্য। তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ— এ রাজ্য প্রায় ২৮ শতাংশ টাকা কম পেয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার পৌষ্টিক আহারের জন্য মোট বরাদ্দের প্রায় সবটাই পাঠিয়ে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে, তুলনায় ২০২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঠিয়েছে ৬৪ শতাংশ। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বেতন এবং আনুষঙ্গিক খরচের টাকাতেও কার্পণ্য করেছে কেন্দ্র।
টাকা বরাদ্দে আঁটিসাঁটির প্রভাব কর্মসূচির তদারকিতেও পড়েনি কি? ২০২০-র মার্চে গোটা দেশে পরিদর্শক পদগুলির (সুপারভাইজ়ার এবং সিডিপিও) ২৮ শতাংশ ফাঁকা ছিল। নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক তথ্যের অধিকার আইনের অধীনে একটি প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছে, ৩০ জুন, ২০২০ তারিখে পশ্চিমবঙ্গে দশটি সুপারভাইজ়ার পদের সাতটিই ছিল শূন্য।
অন্যান্য অনেক রাজ্যের অবস্থাও একই রকম। শিশু-অপুষ্টি নিবারণের প্রকল্পকে বস্তুত কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্র, সন্দেহের অবকাশ নেই।
কেরল বা গোয়ার মতো গুটিকয়েক রাজ্য বাদ দিলে দেশ জুড়ে শিশুদের পুষ্টির প্রতি এক ভয়ানক, ধারাবাহিক অবহেলা চলছে। অতিমারি সেটাকে আরও প্রকট করেছে মাত্র।