সময়ের ইতিহাস।
মেরি কন্ডো মানুষকে ঘর গোছাতে শেখান— যা কিছু বাড়তি, যা মনকে আনন্দ দেয় না, তা বাড়িতে রাখার দরকার নেই। তাঁর পদ্ধতিতে মেতেছেন পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ। সমাজমাধ্যমে অগণন অনুসারী, নেটফ্লিক্সে তাঁর শো, তাঁর লেখা চারটি বই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়ে দুনিয়া জুড়ে বেস্টসেলার। তোশকের তলায় প্লাস্টিকের প্যাকেট গুঁজে রাখা বাঙালি পরিবারে বড় হয়ে মেরি কন্ডোকে যেন কিছুতেই ভাল বুঝতে পারি না। মনে প্রশ্ন জাগে: যা ব্যবহার হয় না বা ‘ইউটিলিটি’ জোগায় না, তা-ই কি বাড়তি? ফেলে দেওয়ার যোগ্য? জিনিসের সঙ্গে জুড়ে থাকা স্মৃতির কি মূল্য নেই তবে? অবান্তর স্মৃতির ভিতর অশ্রুঝলোমলো যে খোলামকুচি পড়ে থাকে, তার সর্বাঙ্গে অনেক সময় লেখা থাকে পরিবারের, সময়ের ইতিহাস।
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ও যোগপ্রশিক্ষক প্রগতি টিপনিসের ছেলেবেলার স্মৃতির বড় অংশ জুড়ে রয়েছে দুটো কাঠের বাক্স। তাঁর লখনউয়ের বাড়িতে বাক্স দু’টি এসেছিল তাঁর দিদিমার হাত ধরে। একটা বাক্সকে টেবিল বানিয়ে প্রগতির দাদু তাঁদের দেশের বাড়ির বিষয়সম্পত্তি, জমিজমার হিসাব রাখতেন। দাদু মারা যাওয়ার পর দিদিমা আর বাক্সদ্বয়, উভয়েরই ঠিকানা হয় লখনউয়ের কায়সার বাগে। একটা বাক্সের উপর খাতা রেখে লেখাপড়া করতেন প্রগতি। বাড়ির বড় টেবিল ছিল বাবা গুরুপ্রসাদের দখলে— তিনি স্বাধীনতার সময়ে উত্তর ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম মুখ। আর একটা ছোট টেবিলে প্রগতির স্কুলশিক্ষিকা মা খাতা দেখতেন। দেশের কাজ আর সংসারের ভরণপোষণে যখন ব্যবহার হত বাড়ির পড়ার টেবিল দু’টি, তখন কাঠের বাক্সে স্তরে স্তরে জমা হচ্ছিল লেখা-পড়া, বিনোদন আর কৈশোরের রোমাঞ্চকর নানা অভিজ্ঞতা। প্রগতি থাকেন এখন মস্কোতে। কাঠের বাক্স দু’টি রয়ে গিয়েছে লখনউয়ে, বাপের বাড়িতে। বাক্স দু’টির কথা মনে পড়লে তাঁর মনে পড়ে একটা অন্য সময়ের কথা, যখন তাঁর বাবা সংগঠনের কাজে ব্যস্ত, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত। মনে পড়ে বাবার কমরেডদের, কর্মরতা মা, বিধবা ধার্মিক দিদিমা আর ছোট ভাইবোনেদের দৈনন্দিন জীবনের কথা।
প্রগতি সেই বাক্স দু’টির কথা লিখেছেন তাপ্তী রায় সম্পাদিত ফ্ল্যাশব্যাক: অবজেক্টস, মেমোরিজ় অ্যান্ড দি আর্ট অব স্টোরিটেলিং (২০২২) বইটিতে। আরও ১৬টি প্রবন্ধ রয়েছে বইটিতে। নানা মানুষ তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত নানা আপাত-তুচ্ছ পারিবারিক সামগ্রী ঘিরে স্মৃতিচারণ করেছেন এই লেখাগুলিতে। ইন্দিরা চৌধুরীর লেখাটি যেমন তাঁর বাবার ভারত-পাকিস্তান বিশেষ পাসপোর্টকে ঘিরে। অন্য অনেক বাঙাল পরিবারের মতোই, ইন্দিরার পারিবারিক ইতিহাস রাষ্ট্রের সীমানা উপচে দুই বাংলায় বিস্তৃত। ইন্দিরার বাবাদের দেশ পূর্ববঙ্গের কুমিল্লায়, ‘বাসা’ পশ্চিমবঙ্গের বার্নপুরে। বাড়ি আর বাসার মধ্যে ১৯৪৭-এ আন্তর্জাতিক সীমানা টানা হয়। ১৯৫২ সাল থেকে নিয়ম হয়, এই সীমানা পারাপারে লাগবে পাসপোর্ট-ভিসা। ১৯৫৩ সালে ভারত-পাকিস্তান বর্ডার পেরোনোর জন্য বিশেষ পাসপোর্ট চালু হয়। ইন্দিরাদের মতো যাঁদের বাড়ি-বাসা দুই দেশে পড়েছে— পরিবারের কেউ রয়েছেন সীমানার এ পারে কেউ ও পারে, তাঁদের সুবিধার্থে এই পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টের পাতায় লেখা রয়েছে কবে, কোন পথে ইন্দিরার বাবা গিয়েছিলেন কুমিল্লা। পাসপোর্ট আবার রাষ্ট্রের স্মৃতিরক্ষকও বটে, রাষ্ট্রের নজরদারির প্রমাণ। কিন্তু পাসপোর্টে লেখা নানা সন তারিখ, সেটা ঘিরে পারিবারিক স্মৃতিচারণ ও পুরনো সাদা-কালো ছবির বুনটে জন্ম নেয় আর এক রকমের মহাফেজখানা। সেই মহাফেজখানা রাষ্ট্রের সীমানাকে প্রশ্ন করতে শেখায়।
ঝুমা সান্যালের দিদিমার এমব্রয়ডারির নানা নিদর্শন বা তপতী গুহঠাকুরতার মায়ের ছোট বয়সের পুতুল হাতে ছবিও প্রশ্ন করে ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রের সীমানাকে। ঢাকা-কুমিল্লায় শৈশব, কৈশোর কাটানো হিরন্ময়ী বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পূর্ব বাংলাকে ভুলতে পারেননি। জীবনের সায়াহ্নে এসে তাঁর প্রেসিডেন্সিতে ইতিহাস পড়া নাতনি ঝুমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, “দেশভাগ হল কেন, বলতে পারিস? গান্ধীজি তো চাননি।” তপতীর মা তাঁর নাতনির প্রশ্নের উত্তরে জানান, তাঁর দেশ চাটগাঁ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দেশভাগ তাঁকে দেশান্তরি করলেও, তাঁর দেশের ধারণা আন্তর্জাতিক সীমানায় বাঁধা পড়েনি।
আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ জ্যানেট হসকিন্স ‘বায়োগ্রাফিক্যাল অবজেক্ট’ বলে এক রকম ধারণা ব্যবহার করেন এমন জিনিস বোঝাতে, যা নানা পারিবারিক স্মৃতির ধারক, আর সেই কারণে তা কোনও পরিবার বা ব্যক্তিবিশেষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন প্রগতির বাড়ির দু’টি বাক্স, পুরনো ছবি, বাতিল পাসপোর্ট বা হাতে তৈরি কাঁথা। ২০১৯ সালে, অ্যামনেস্টির তরফে চিত্রসাংবাদিক আহমের খান কক্সবাজারের কাছে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে গিয়ে কিছু ছবি তোলেন। ছবিগুলির বিষয় ছিল এমন কিছু জিনিস, যা মায়ানমার থেকে প্রাণ হাতে করে পালানোর সময়ে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন রোহিঙ্গারা। তেমনই এক ছবিতে খালি গা, রাগী অধৈর্য মুখের ছ’বছরের তসলিমার হাতে ধরা সবুজ রঙের একটা মুখে-মাখার ক্রিমের কৌটো। সেনাবাহিনী-পরিচালিত নৃশংস হত্যালীলা থেকে পালানোর সময়ে ক্রিমের কথা কেন মনে পড়েছিল তার, সে ছাড়া তা কে-ই বা জানে? কিন্তু ছবির বর্ণনায় যখন পড়ি ক্রিমের কৌটোটা কাউকে সে দেবে না বলেছে, তখন আন্দাজ করতে পারি, জিনিসটা তার কাছে কতটা জরুরি। হিংসা, ধ্বংস, দারিদ্র, দিনের পর দিন শিবিরে দিনাতিপাত করার সময়েও রোজ মুখে ক্রিম লাগানোর মধ্যে হয়তো আছে এক শিশুর প্রতিবাদ, তার স্বাভাবিক দৈনন্দিনের স্মৃতি আঁকড়ে থাকার জেদ বা তার স্থিতি খোঁজার চেষ্টা।
বিয়ের জন্য স্টুডিয়োতে তোলা ছবিতে চোয়াল শক্ত, মুখ গম্ভীর বাড়ির মেয়ের অসহযোগের গল্প তো নানা পারিবারিক স্মৃতিচারণেই উঠে আসে। আর এই ধরনের ছবিতেই ‘স্মল অ্যাক্টস অব রেবেলিয়ন’, অর্থাৎ বিদ্রোহের ছোট নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন জেরাল্ডিন ফোর্বসের মতো ইতিহাসবিদরা। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, এই ধরনের ছবি এবং তাকে ঘিরে স্মৃতিচারণ হয়ে উঠেছে প্রান্তিকের প্রতিবাদকে বোঝার মূল্যবান উপাদান। তসলিমার ক্রিমে যদি লুকিয়ে থাকে তার শৈশবের স্মৃতি, হিংসার ভয়াবহতা, দেশত্যাগের অভিজ্ঞতা আর পুরনোকে আঁকড়ে রাখার জেদ, হয়তো তার ছবি তোলার ভঙ্গিতে রয়েছে অসরকারি সংস্থার দাপট বা দাক্ষিণ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়ার ছোট নিদর্শন।
সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও অবশ্য বায়োগ্রাফিক্যাল অবজেক্ট থাকে, সামাজিক বা সরকারি স্মৃতি তৈরি হয় যাকে ঘিরে। মন্দির, মসজিদ, পুজো প্যান্ডেলকে তো সমাজের স্মারক হিসাবে দেখা যেতেই পারে। এক ভাবে দেখতে গেলে রাষ্ট্রের দলিল দস্তাবেজ, জাতীয় পতাকা, চরকা বা অশোক স্তম্ভ সবই তাই— যাকে ঘিরে এক রকম সরকারি স্মৃতি তৈরি হয়েছে এত দিন, আর এখন ব্যবহারের ধরন পাল্টে সেই স্মৃতির ধরনকে পাল্টানোর চেষ্টা চলেছে। দেশভাগের সময়ে হরপ্পা মহেঞ্জোদরো থেকে পাওয়া সব নিদর্শন দু’ভাগ করেছিলেন ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা। নৃত্যরতা রমণী পড়েছিল ভারতের ভাগে, পুরোহিতের মূর্তি পেয়েছিল পাকিস্তান, ভাগাভাগি হয়েছিল বাসন, বালা, ব্রোচ ইত্যাদি। মহেঞ্জোদরোর ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া পাথর বসানো একটি সোনার হারকে দু’টুকরো করেছিলেন দেশভাগের কান্ডারিরা। ভারত-পাকিস্তান উভয়েরই প্রাচীনত্ব প্রমাণের প্রয়াসের কেন্দ্রে ছিল এগুলি। পরিবারের মধ্যে কাঠের বাক্স যেমন বিশেষ অর্থবহ হয়ে ওঠে, তেমন রাষ্ট্রের পরিসরে হরপ্পা সভ্যতার হারের টুকরো নির্দিষ্ট স্মৃতি তৈরি করে।
পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় স্মৃতিচারণের ধরন অবশ্য আলাদা আলাদা। হলদে হয়ে যাওয়া ছবি, পোকা কাটা বই বা বাতিল পাসপোর্ট ঘিরে স্মৃতির মহাফেজখানা সব সময়ই এলোমেলো, উপচে পড়া। রাষ্ট্র তালিকা বানিয়ে, ফাইল করে, প্রয়োজনে ভেঙে টুকরো করে নির্দিষ্ট খোপে খোপে ঢুকিয়ে রাখে তার বিষয়সম্পত্তি, স্মারক বস্তু। অন্তত সে রকমটাই করতে চায়, সেটাই আদর্শ। মেরি কন্ডো প্রতিটি জামা একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ভাঁজ করে বাক্সবন্দি করতে শেখান। তাঁর দর্শন রাষ্ট্রীয় দর্শনের মতোই বোধ হয়— নির্লিপ্ত, প্রয়োজনের হিসাবে মশগুল। তিনি বার বার মনে করিয়ে দেন স্মৃতি ও বস্তু এক নয়। সব জিনিস, যার সঙ্গে আবেগ জড়িয়ে রয়েছে, তা রাখার দরকার নেই, সংসারে আবর্জনা বাড়ে। কিন্তু উপচে পড়া, এলোমেলো, অতিরিক্তের মধ্যেই ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার যে সম্ভাবনা রয়ে যায়, এ কথা স্বীকার না করে উপায় কী? তবে এ কথাও না মেনে উপায় নেই যে, আজকের ভারতে বসে সমাজ ও রাষ্ট্রের স্মারক ও স্মরণের মধ্যকার সীমারেখা মুছে যাওয়ার প্রবণতা দেখে দুশ্চিন্তা হয়। বার বার মনে হয়— পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্মৃতিচারণের মধ্যে সহজ সরলরৈখিক সম্পর্ক না থাকাই গণতন্ত্রের জন্য ভাল।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা