প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
স ংবাদ শিরোনাম সচরাচর জিডিপির বৃদ্ধির হারের দখলে থাকে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, সেই বৃদ্ধি কী ভাবে সাধারণ মানুষের জীবনের উন্নতি ঘটাচ্ছে। ভারতের বেশির ভাগ মানুষেরই রোজগারের প্রায় পুরোটা আসে শ্রম থেকে— পুঁজি বা জমির মালিকানা থেকে নয়— ফলে, শ্রমের বাজারে কী ঘটছে, সে দিকে নজর দেওয়া জরুরি। নতুন কাজ তৈরি হচ্ছে কি? আগের চেয়ে ভাল কাজ তৈরি হচ্ছে? মজুরির হার বাড়ছে?
বার্ষিক পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস)-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান দেখলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে পারে যে, সত্যিই উন্নতি ঘটছে।
শ্রমের বাজারের দুটো মূল সূচক হল লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট (এলএফপিআর) বা শ্রমের বাজারে যোগদানের হার, এবং আনএমপ্লয়মেন্ট রেট বা বেকারত্বের হার। এলএফপিআর হল দেশে কর্মক্ষম বয়সের মোট জনসংখ্যার মধ্যে যত শতাংশ শ্রমের বাজারের সঙ্গে যুক্ত (যাঁরা কর্মরত এবং যাঁরা বেকার কিন্তু কাজ খুঁজছেন, দুই গোষ্ঠী মিলে), সেই হার। আর মোট যত মানুষ শ্রমের বাজারে যোগ দিয়েছেন, অর্থাৎ কাজ খুঁজছেন বা কর্মরত, তাঁদের যত শতাংশ কাজ খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না, সেই হারটি হল বেকারত্বের হার। নতুন কাজ তৈরি হচ্ছে কি না, তার সঙ্গে এই হারটির সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে— অনেকেই কাজের বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। অতএব, শুধু বেকারত্বের হার দেখলেই চলবে না, শ্রম বাজারের অবস্থা বুঝতে এলএফপিআর-এর দিকেও নজর রাখতে হবে।
এখন যদি এলএফপিআর দেখি, ২০১৭-১৮ সালে এই হার ছিল ৫২.৩৫%, ধারাবাহিক ভাবে বেড়ে ২০২১-২২ তা দাঁড়িয়েছে ৫৮.৩৫%। গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা আগের তুলনায় অনেক বেশি কাজের বাজারে যোগ দিতে চাইছেন, এটাই এই বৃদ্ধির পিছনে একটা বড় কারণ। এর আগে প্রায় এক দশক ধরে এলএফপিআর নিম্নগামী ছিল, সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে প্রবণতাটি পাল্টেছে। আর যদি বেকারত্বের হার দেখি, ২০১৭-১৮’র তুলনায় ২০২১-২২’এ সার্বিক ভাবে বেকারত্বের হার কমেছে— ৬.২% থেকে ৪.২%। তরুণদের ক্ষেত্রে এই হারটি তুলনায় বেশি (১২% ও ৮.৫%), তবে সার্বিক প্রবণতাটি নিম্নমুখী। কিন্তু কেমন কাজ তৈরি হচ্ছে, মজুরির হারের কী অবস্থা, এই খোঁজগুলি না রাখলে উপরের পরিসংখ্যান ভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। মৃণালিনী ঝা ও জিতেন্দ্র সিংহের সঙ্গে একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধে আমি এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজেছি। সেই উত্তরে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে।
নিয়মিত মজুরি বা বেতনের কাজ, ঠিকা কাজ এবং স্বনিযুক্তি— কর্মসংস্থানের এই তিনটি শ্রেণির পরিসংখ্যান দেখলে স্পষ্ট হয় যে, এলএফপিআর বৃদ্ধি এবং বেকারত্বের হার কমার পিছনে প্রধান কারণ স্বনিযুক্তির পরিমাণ বৃদ্ধি। এই শ্রেণিটিকে তিনটি গোত্রে ভাগ করা যায়— এক, যাঁরা নিজেদের ব্যবসায় বাইরের শ্রমিক নিয়োগ করেন; দুই, যাঁরা নিজেরাই নিজের ব্যবসা চালান; এবং তিন, যাঁরা অবৈতনিক পারিবারিক শ্রমে নিযুক্ত। ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২’এর মধ্যে এই গোত্রগুলির মধ্যে প্রথমটির অনুপাত বেড়েছে এক শতাংশ-বিন্দুরও কম (৩.৭৮% থেকে ৪.৫৭%); তৃতীয় অর্থাৎ পারিবারিক ক্ষেত্রে অবৈতনিক শ্রমে নিযুক্তদের অনুপাত বেড়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ-বিন্দু (২৬% থেকে ৩১.৪%)।
অর্থাৎ, যার জোরে এলএফপিআর বেড়েছে এবং বেকারত্বের হার কমেছে, তা হল মূলত অবৈতনিক পারিবারিক শ্রমে যোগদানের প্রবণতা বৃদ্ধি; অন্য দিকে, কর্মসংস্থানের অন্যান্য ক্ষেত্রে— অর্থাৎ নিয়মিত বেতনের চাকরি, ঠিকা শ্রম, শ্রমিক নিয়োগকারী স্বনিযুক্ত ব্যক্তি ও নিজে কাজ করা স্বনিযুক্ত ব্যক্তি— কর্মসংস্থান কমেছে, বা অতি সামান্য বেড়েছে। সব মিলিয়ে, দেশে কাজের সার্বিক গুণগত মান কমেছে। যদিও কর্মসংস্থানের সার্বিক হার বেড়েছে, সেই কাজ তৈরি হয়েছে পারিবারিক অবৈতনিক শ্রমিক হিসাবে— যেমন, পরিবারের মালিকানাধীন মুদিখানায় কর্মী হিসাবে। যাঁরা স্বনিযুক্ত হিসাবে নিজেই কাজ করেন, পারিবারিক সদস্য ছাড়া অন্য কোনও শ্রমিক নিয়োগ করেন না— যেমন চা বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা ইত্যাদি— দেশের কর্মরত জনসংখ্যায় তাঁদের অনুপাতই সর্বাধিক, প্রায় ৩৫%।
আলোচ্য সময়কালে কাজের বাজারে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যাবৃদ্ধির হার তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেশি। এর আগের এক দশক ধরে কাজের বাজারে মেয়েদের যোগদানের হার কমছিল। কিন্তু, এই কর্মসংস্থানও মূলত ঘটেছে পারিবারিক অবৈতনিক শ্রমের শ্রেণিতে, অর্থাৎ কাজের গুণগত মান কমেছে।
ভারতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির আপাত-উজ্জ্বল প্রবণতাটি যে-হেতু ‘স্বনিযুক্ত’ শ্রেণিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কারণেই ঘটছে, এবং সেই ক্ষেত্রটি যে-হেতু ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে যা আয় বা কৰ্মনিরাপত্তা কোনও দিক থেকেই আদর্শ নয়, ফলে এই প্রবণতাটি উদ্বেগজনক।
আয়ের ছবিটি কেমন? ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২ সালের মধ্যে সর্বভারতীয় গড় প্রকৃত আয় (টাকার অঙ্কে আয়ের থেকে মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ বাদ দিলে যা থাকে) বেড়েছে দশ টাকার কাছাকাছি (২০১০ সালের মূল্যস্তরে)। অর্থাৎ, ৪% বৃদ্ধি। সেই মূল্যস্তরে গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মজুরির হার বেড়েছে যথাক্রমে গড়ে ১০ ও ১৪ টাকার মতো।
কিন্তু, সব গোত্রের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি সমান নয়। গড় আয় সবচেয়ে বেশি নিয়মিত বেতনের কাজে নিযুক্তদের ক্ষেত্রে; তার পরে রয়েছেন স্বনিযুক্তরা; সবার শেষে ঠিকা শ্রমিকরা। আলোচ্য সময়কালে নিয়মিত বেতনের কর্মী ও স্বনিযুক্তদের প্রকৃত আয় বাড়েনি বললেই চলে।
ঠিকা শ্রমিকদের আয় বেড়েছে। ২০১৭-১৮ সালে দৈনিক গড় মজুরি ছিল ১৬২ টাকা; ২০২১-২২’এ তা বেড়ে হয়েছে ১৯৬ টাকা। প্রায় ২০% বৃদ্ধি। দেশে সার্বিক যে ৪% মতো আয়বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তা ঘটেছে মূলত এই শ্রেণির আয়বৃদ্ধির কারণেই। এই প্রবণতাটি ইতিবাচক, সন্দেহ নেই, কিন্তু তাকে সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা জরুরি— যদি কোনও ঠিকা শ্রমিক মাসে ৩০ দিনই কাজ পান, তবুও তাঁর মাসিক আয় ২০১০ সালের মূল্যস্তরে ৬০০০ টাকার কম (২০২১ সালের মূল্যস্তরে তা ১১,৫২০ টাকা)। টাকার অঙ্কটি যৎসামান্য, দারিদ্ররেখার চেয়ে সামান্যই বেশি। ২০১১-১২ সালের মূল্যস্তরে ভারতের গ্রামাঞ্চলে দারিদ্ররেখা হল ৪,০৮০ টাকা; শহরাঞ্চলে ৫,০০০ টাকা।
কল্যাণ অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেশের সার্বিক আয়বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমের বাজারে কাজের গুণগত মান ও মজুরির বর্তমান চিত্রটি উদ্বেগজনক। অন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ হল ভারতের শ্রম বাজারের বিভিন্ন গোত্রের অনুপাত। এ দেশে কোনও শ্রমিক নিয়োগ না করা স্বনিযুক্ত কর্মী, ঠিকা শ্রমিক ও অবৈতনিক পারিবারিক শ্রমে নিযুক্ত কর্মীরা দেশের মোট কর্মরত জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ। অর্থাৎ, দেশের ৭৫% শ্রমিক স্বল্প উৎপাদনশীল কাজে নিযুক্ত। জিডিপির বৃদ্ধির হার বা বেকারত্ব কমার পরিসংখ্যান দিয়ে দেশের সিংহভাগ মানুষের এই উদ্বেগজনক ছবিটিকে ঢাকা যাবে না।