—প্রতীকী চিত্র।
বাড়ির লোকের কাছে স্ত্রী সুমির যৌন-পরিচয় জানাজানি হয়ে গেলে শার্দূল সিংহ পড়ে মহাবিপদে। ভয়ে, লজ্জায় সে সিঁটিয়ে যায়, কারণ তারা এত দিন প্রচলিত অর্থে দম্পতি ছিল। যদিও আসলে দু’জনেই সমকামী, ‘গে’ এবং ‘লেসবিয়ান’ যৌনপরিচয়ের ব্যক্তি। সমাজে হেনস্থা-হিংসার আতঙ্কে বিসমকামী বিবাহিত দম্পতির অভিনয় করছিল, কারণ সমাজ মনে করে বি-সমকামিতাই বিধি, যাকে বলে ‘হেটেরোনর্ম্যাটিভ’। সুমির চরিত্রে ভূমি পেডনেকর এবং শার্দূলের চরিত্রে রাজকুমার রাও-ও একে অপরের যৌন-পরিচয় নিজেদের মতো করে সুরক্ষিত করবার জন্য দাম্পত্যের প্রত্যাশিত ধাঁচা সামনে রেখেছিল। কিন্তু শার্দূল এক জন ডাকাবুকো পুলিশ অফিসার হলেও নিজের সমকামী যৌন-পরিচয় ফাঁস হয়ে পড়ার আতঙ্কে নীল হয়ে যায়। ভারতীয় সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের ভবিতব্য নিয়ে ছবি হর্ষবর্ধন কুলকার্নির বধাই দো (২০২২)। বাণিজ্যিক মোড়কের এই ছবি সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের সমস্যার খুব কাছাকাছি পৌঁছেছে।
প্রসঙ্গত আমরা মনে করতে পারি, গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ধারা ৩৭৭ অবলুপ্তির পাঁচ বছর পূর্তি হল। ব্রিটিশ সরকার ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ যৌনাচারকে শাস্তি দিতে এই আইন করেছিল। কোন যৌনাচার আসলে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’, তা কখনওই ওই ধারায় স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু স্বাধীন ভারতেও ওই ধারা রয়ে গেল। এর প্রয়োগ করেই ভারতের সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের অযথা হেনস্থা করেছে পুলিশ, তাঁদের অকারণ অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। ২০১৮-তে এসে নবতেজ সিংহ জোহর বনাম ভারত সরকার ঐতিহাসিক মামলায় ৩৭৭ ধারা অবলুপ্ত হল।
এই কুখ্যাত ধারাটির বিরুদ্ধে ভারতের সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের সংগ্রাম চলছে প্রায় অর্ধশতক ধরে। সে জন্যই পাঁচ সদস্যের যে বেঞ্চ এই ধারা বিলোপ করে, তার অন্তর্ভুক্ত এক জন মাননীয় বিচারপতি বলেন যে, এই ধারার দৌলতে যে-ভাবে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা বছরের পর বছর হেনস্থা-হিংসার শিকার হয়েছেন, তাতে ভারতের উচিত তাঁদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এর সঙ্গে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সম্মিলিত ভাবে এও বলেছিল, কেন্দ্রীয় সরকার যেন টিভি, রেডিয়ো, খবরের কাগজ তথা অন্যান্য গণমাধ্যমে দেশে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের অধিকার সম্বন্ধে সকলকে অবগত করে। বিভিন্ন দফতরে, বিশেষত পুলিশের মধ্যে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের অধিকার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। এক জন সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষও যেন সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন। সমাজে যেন সমতা বজায় থাকে।
কিন্তু এই পাঁচ বছরে সেই সব নির্দেশের একটি শব্দও পালন করতে কেন্দ্রীয় সরকার সচেষ্ট হয়নি। উল্টে এমন কিছু কর্মসূচি নিয়েছে, যাতে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের এ দেশে দম বন্ধ হয়ে এসেছে, এবং সমাজে মারাত্মক বৃদ্ধি পেয়েছে সমকাম-বিদ্বেষ। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের বিবাহের-সমতা মামলায় বিবাদী পক্ষ হয়ে বলেছে, সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের কখনওই বিবাহের অধিকার পাওয়া উচিত নয় কারণ তা ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির পরিপন্থী। কোন সমাজ বা সংস্কৃতির কথা তারা বলছে, এবং কবেই বা সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা ভারতের সমাজ-সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তা তারা স্পষ্ট করেনি। যে সরকার ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ স্লোগান দিয়ে একটি সর্বব্যাপী সমাজ গড়ে তুলতে চায়, সেই সরকারই কী ভাবে একটি প্রান্তিক গোষ্ঠীর অধিকার খর্ব করতে চায়, তা-ও আশ্চর্যের।
কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রেও আইন এনে (সারোগেসি আইন, ২০১৮) সন্তান লাভও কেবলমাত্র বি-সমকামী নারী এবং পুরুষ (তা-ও যৌথ, বিবাহিত জীবনে আছেন এমন মানুষদেরই) কুক্ষিগত করেছে সরকার। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ, একক মানুষ এ দেশে প্রযুক্তির সহায়তায় সন্তান উৎপাদনের অধিকার থেকে আজ বঞ্চিত। কেন্দ্রীয় সরকারের নিদান মানলে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের এ দেশে ভালবাসার অধিকার, সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার, সঙ্গীকে নিয়ে যৌথ জীবনের অধিকার, তথা সন্তান উৎপাদন-পালনের অধিকার না থাকাই উচিত। যাঁরা নারী-পুরুষ দ্বৈত, এবং বিসমকামিতা-বৃত্তের বাইরে, তাঁদের অবমানব হয়ে থাকাই যেন সমীচীন।
সেই জন্য আমাদের দেশে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা যে-ভাবে হেনস্থা-হিংসার ক্রমাগত শিকার, তা বন্ধ করতে কোনও আইনের কথা সরকার ভাবেনি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্মক্ষেত্রে শুধুমাত্র ‘ভিন্ন’ লিঙ্গ-যৌনতার কারণে প্রতি দিন এ দেশে বিভাজন, অত্যাচার ও হেনস্থা-হিংসার মুখোমুখি হচ্ছেন অগণিত মানুষ কিন্তু তাঁদের সুরক্ষায় কোনও আইন নেই। এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগত ভাবে সংখ্যালঘু— সকলের সুরক্ষায় আইন থাকলেও যৌন-সংখ্যালঘু মানুষদের সুরক্ষায় কোনও আইন প্রণয়নের কথা কোনও আলোচনাতেই আসে না। আজও বহু ভারতীয় তাই নিজের যৌন-পরিচয় গোপন করে, না-মরে বেঁচে থাকতে বাধ্য হন।
টিভি চ্যানেলে বসে নানা ধর্মের প্রচারকরা অনেক সময়ে অপমানজনক ভাবে বলে চলেন, সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা আসলে ‘রোগ’ এবং এঁরা তা সারিয়ে দিতে পারেন! সরকার এর বিরুদ্ধে কখনওই কোনও ব্যবস্থা করে না। শুধু তা-ই নয় ‘কনভার্শন থেরাপি’ বলে একটি অপচিকিৎসা এখনও বিভিন্ন শহর-গ্রাম-মফস্সলে গোপনে চালু আছে, যাতে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের ‘শক’ পর্যন্ত দেওয়া হয় তাঁদের ‘স্বাভাবিক’ বানানোর জন্য। ভারতে এই অপচিকিৎসা নিষিদ্ধ করেছে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল। অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এই অপচিকিৎসা চালাবার মারাত্মক অভিযোগ থাকলেও, আজ অবধি পুলিশ কোনও আইনি ব্যবস্থা করেছে বলে শোনা যায়নি।
অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট যখন ধারা ৩৭৭ বিলোপ করে, তখন খুশির হাওয়া ভারত জুড়ে বয়ে গিয়েছিল। সেটি ছিল প্রকৃত অর্থে ভারতের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী দিন। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষরা ভেবেছিলেন, দেশ থেকে সমকাম-বিদ্বেষ দূরীভূত হল। যৌন-পরিচয়ের ভিন্নতার কারণে আর কোনও মানুষকে এই দেশে হেনস্থা-হিংসার শিকার হতে হবে না। তাঁরা স্বস্তি ও সম্মানের জীবন যাপন করতে পারবেন ভারতে। সকল অধিকারের সমতা আসবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের প্রতি কর্তব্য পালন করেনি।
দক্ষিণপন্থী রাজনীতি কোনও ভিন্নতাকেই সম্মান করে না। তাদের চাহিদা একরৈখিক একটি সমাজ, যেখানে সবাই এক ভাষা বলবে, এক ধর্ম, একই জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে। বলা বাহুল্য, লিঙ্গ-যৌনতার ক্ষেত্রেও সবাই এক রকম হবেন, না হলেই তাঁরা হবে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ বা ‘সমাজ-সংস্কৃতির পরিপন্থী’। এতে জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে দেশ শাসন করতে সুবিধা হয়। কিন্তু বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে যে বৈচিত্র, বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্য, তাকে না মানলে সরকারে থাকার যোগ্যতা তৈরি হয় না কোনও দলের, সে যে দলই হোক।
বধাই দো ছবিতে দেখেছিলাম, শার্দূল পরিশেষে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে পরিবারের মুখোমুখি হয়। তার স্ত্রী সুমি যদি ‘লেসবিয়ান’ হয় তবে সেও যে ‘গে’ তা সে সবাইকে জানিয়ে দেয়, এবং শপথ করে আর যা-ই করুক সে আর নিজেকে নিয়ে লজ্জা পাবে না। আজ ভারতীয় সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা যদি এ ভাবে সব বাধা পেরোবার অঙ্গীকার করেন, আর যদি বিচার ব্যবস্থা তাঁদের পাশে থাকে, তবে দেশের সরকার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কেন? ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ স্লোগান যে ভারতের ছবি তুলে ধরে, তা থেকে কি তবে সমকামী-রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠী বাদ থাকবে?