—প্রতীকী ছবি।
জুন মাস তথা ‘প্রাইড মান্থ’ চলে গেল। ১৯৬৯-এর ২৮ জুন আমেরিকায় স্টোনওয়াল নামে রেস্তরাঁয় পুলিশি নির্যাতনের স্বীকার হন সমকামীরা। এর পর থেকে তাঁরা সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করেন। পরের বছর ২৮ জুন তাঁদের প্রতিরোধের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে ‘গে লিবারেশন ফ্রন্ট’ একটি মিছিলের আয়োজন করে। সেই সময় এটি পরিচিত হয় ‘গে লিবারেশন মার্চ’ নামে, পরে ‘প্রাইড প্যারেড’ নামে। এই পদযাত্রাগুলিতে যৌন সংখ্যালঘু মানুষেরা সরবে সগৌরবে প্রকাশ করেন নিজেদের অস্তিত্ব। কিন্তু তার পর? রোজকার জীবনে সমাজ তাঁদের কোন চোখে দেখে? তাঁদের ভালবাসার অধিকার কি গ্রহণযোগ্য হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে?
যে কোনও সংখ্যালঘুর মতো এঁদের সঙ্গেও ওতপ্রোত ‘ওরা’ শব্দটি। এক দিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে পার্থক্য বোঝাতে তার ব্যবহার, প্রচ্ছন্ন ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নির্দেশ করতেও। ধর্ম ভাষা জাতিগত সংখ্যালঘুর সঙ্গে যৌন সংখ্যালঘুদের পার্থক্য এই যে, তা মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি বা অভিমুখিতার সঙ্গে সম্পর্কিত, মানুষের ধর্ম জাতি বর্ণের উপর ভিত্তি করে তা গড়ে ওঠে না, সে দিক থেকে যৌন সংখ্যালঘুরা বিভিন্ন ধরনের সংখ্যালঘুদের মধ্যেও সংখ্যালঘু।
ভারতের ইতিহাসে যুগান্তকারী দিন ২০১৮-র ৬ সেপ্টেম্বর, যে দিন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩৭৭ ধারা বাতিল হয়। এর আগে এই ধারায় ‘সমকামী প্রেম’ অপরাধ বলে গণ্য হত। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলে, দু’জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে হওয়া সমকামী ক্রিয়াকলাপকে অপরাধ বলা যাবে না। যৌন সংখ্যালঘু মানুষেরা যে বহুকাল ধরে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের বৈষম্যের শিকার তা স্বীকার করে শীর্ষ আদালত বলে, যৌন সংখ্যালঘু মানুষেরা সমাজে সম মর্যাদা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অধিকারী। অস্বীকার করার উপায় নেই, ভারতে সমকামী সম্পর্ককে বৈধ সম্পর্ক হিসাবে স্বীকার অতি প্রগতিশীল এক পদক্ষেপ। কিন্তু সঙ্গে এটাও উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট ২০২৩ সালে সমলিঙ্গ বিবাহের স্বীকৃতি দেয়নি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, একুশ শতকে যেখানে নরওয়ে সুইডেন নিউ জ়িল্যান্ড জার্মানি কিউবা চিলি আয়ারল্যান্ড তাইওয়ান সমলিঙ্গ বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে, সে পথে এগোচ্ছে তাইল্যান্ডও, তখন ভারতের সমস্যা কোথায়? সমস্যার শিকড় সমকামিতাকে সমাজে ‘গ্রহণযোগ্য’ করে তোলায়। যত দিন না সমকামিতা সমাজে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করছে, তত দিন পর্যন্ত সমলিঙ্গ বিবাহের প্রসঙ্গটিও শুধু আলোচনার বিষয় হয়েই থাকবে। বর্তমানে হয়তো শহুরে শিক্ষিত নাগরিক গোষ্ঠীর একটি অংশের সমর্থন পাওয়া গেছে, কিন্তু সমাজের অধিকাংশ লোকের কাছে সমকামিতা এখনও ‘ট্যাবু’। অধিকাংশ মানুষই সমকামী উভকামী ও রূপান্তরকামীদের মধ্যে মূলগত পার্থক্য সম্পর্কেই সচেতন নয়, তাঁদের কাছে সব যৌন সংখ্যালঘু এক।
যে কোনও সমাজের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তার প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের উপর। ভারতের সামাজিক মূল্যবোধে সমকামিতার চর্যা নিন্দনীয় ও অস্বাভাবিক বলে মনে করা হয়, তাই আইনের চোখে তা স্বীকৃত হলেও বাস্তবে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। সমকামিতা যে কোনও বিকৃতি, অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতা নয়, বিজ্ঞানের চোখে তা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও কেন সমাজের এই আচরণ? এখনও পর্যন্ত ভারতের সমাজকাঠামো ও মূল্যবোধে বিয়ে হল সেই প্রতিষ্ঠান যার অন্যতম উদ্দেশ্য বংশবৃদ্ধি। বিয়ের সময় বংশ, জাত, পরিবার, ধর্মকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়, কারণ সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে কুলমর্যাদা রক্ষাই ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্ব। এ কালে হয়তো কিছু পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু বিয়ের মূল উদ্দেশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখনও প্রজননকেন্দ্রিক। যে বিষয়টি দু’জন মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়, তাকে ভাবা হচ্ছে সামাজিক দায়বদ্ধতা, বাধ্যতামূলক কর্তব্য। ব্যক্তি মানুষের যৌনতা বৈধতা বা স্বীকৃতি পায় বিয়ের মাধ্যমে; সমকামী সম্পর্কে সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র না থাকায় এই সম্পর্ক সম গুরুত্ব পায় না। বিষমকামী দম্পতিদেরই এখনও সন্তান দত্তক নিতে গিয়ে বহু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়, সমকামীদের পক্ষে তা আরও কঠিন।
সমাজের একটা বড় অংশ ‘কনফার্মেশন বায়াস’-এ ভোগেন। এটা এমন এক ধরনের চিন্তাধারা, যেখানে মানুষ সেই তথ্যগুলি দ্বারাই প্রভাবিত হয় যেগুলো তার ইতিমধ্যে গড়ে ওঠা বিশ্বাসকেই সমর্থন করে। যে তথ্যগুলি তার বিশ্বাসের সঙ্গে মেলে না, সেগুলিকে তাঁরা সন্তর্পণে এড়িয়ে যান। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাধীন মত বলে যা প্রকাশ করা হয় তা হয়ে দাঁড়ায় এত দিন ধরে গড়ে ওঠা তাঁদের বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি। সর্বোপরি আছে শিক্ষার অভাব। কোনও বিষয় নিয়ে জানতে যেখানে আঙুল ছোঁয়াই যথেষ্ট, সেখানে সমকামিতা নিয়ে রয়ে গেছে ছুতমার্গ, অজ্ঞানতা।
সমাজের একটা অংশ এখন সমকামিতার বাস্তবতা সম্বন্ধে সচেতন, এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ নবীন প্রজন্ম। এই বিষয়ে নানা ছবি, ওয়েব সিরিজ় হচ্ছে এখন। তাদের গুণমান ও বাস্তবিকতা নিয়ে প্রশ্ন অন্য কথা, কিন্তু এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে চিরাচরিত সম্পর্কের গণ্ডি ভেঙে বেরোনোর সাহস দেখিয়েছে এরা।
অনেকেই বলেন সমাজ এখন অনেক বেশি সহিষ্ণু। বিশেষত ৩৭৭ ধারা বাতিলের পরে সমকামীরা নিজেদের অধিকার নিয়ে আরও সচেতন, নিজেদের দাবি জোরালো ভাবে উপস্থাপন করছেন। এটাই, এটুকুই কি সহিষ্ণুতা? সহিষ্ণুতায় অনেক সময় এও বোঝায়, আমি তোমাকে ‘সহ্য’ করছি অর্থাৎ আমার উদারতার দরুন তোমাকে মেনে নিচ্ছি। কিন্তু মেনে নেওয়া আর স্বীকার করা কি এক? তুমি যে রকম, সে ভাবেই আমি তোমাকে সমাজে গ্রহণ করছি— এটাই গ্রহণযোগ্যতা।
জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল সংখ্যালঘুদের নিশ্চিত করতে পারা যে সমাজে ও রাষ্ট্রে তাঁদেরও সমান অধিকার। মূলত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে বলা হলেও, যে কোনও সংখ্যালঘুর ক্ষেত্রেই কি তা প্রযোজ্য নয়? চাই সহমর্মিতা, তা-ই খুলে দেবে গ্রহণযোগ্যতার পথ।
কারও যৌনতাকে স্বীকার না করার অর্থ তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা তথা মানবাধিকার অস্বীকার করা। মানুষের হাতেই মানুষের অধিকার খর্ব হয়, আবার মানুষকে সঙ্গে নিয়েই সেই অধিকার অর্জন করে মানুষ। বহু মানুষ সেই পথে সাথি হয়েছে তা নিজেদের কর্তব্য ভেবে। গত লোকসভা নির্বাচনে অনেকগুলি রাজনৈতিক দল নির্বাচনী ইস্তাহারে যৌন সংখ্যালঘুদের নানা সমস্যা তুলে ধরে তা সমাধানের দাবি জানিয়েছে। ‘পরিবর্তন’ একটা হয়েছে, এখন দরকার তাকে ঠিক পথে চালিত করার।