দেশপ্রেমের সাঁড়াশি আক্রমণে দেশের বিজ্ঞানচর্চার অবস্থাও বেহাল।
যারা ব্রত নিয়েছে তারা বিব্রত করবারই ব্রত নিয়েছে”— ঘরে বাইরে (১৯১৬) উপন্যাসে চন্দ্রনাথ মাস্টারমশাই এই কথা বলেছিলেন ভণ্ড দেশপ্রেমিকদের উদ্দেশে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির অমৃতোৎসবের তুমুল হট্টগোলের মধ্যেও গভীর হতাশার সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা বিব্রত করার ব্রত থেকে আজও চ্যুত হননি। অবস্থা এমনই যে, দেশপ্রেমের সাঁড়াশি আক্রমণে দেশের বিজ্ঞানচর্চার অবস্থাও বেহাল। এই সাঁড়াশির একটি বাহু যদি হয় বর্ধিত জিএসটি, তা হলে অপরটি হল জিইএম (গভর্নমেন্ট ই-মার্কেটপ্লেস), যাকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের হাতিয়ার বলা যেতে পারে। তবে এই দু’টি বিষয় বিজ্ঞানের গবেষণাকে কী ভাবে প্রভাবিত করছে, তা বুঝতে গেলে বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারের ভূমিকাটা একটু সংক্ষেপে জেনে নিতে হবে।
বিজ্ঞানের গবেষণা বেশ একটা খরচসাপেক্ষ ব্যাপার। তার জন্য নানারকম যন্ত্রপাতি ও তাদের নিয়মিত দেখাশোনা, রাসায়নিক পদার্থ, কম্পিউটার, কিছু জীবজন্তু, গবেষণায় নিযুক্ত ছাত্রদের বৃত্তি, এ সব মিলে বেশ বড় অঙ্কের টাকা চাই। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা চলে মূলত সরকারি অনুদানে; কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ‘ডিপার্টমেন্ট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ (ডিএসটি)-র অনুমোদিত বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সেই অনুদানের সিংহভাগ পৌঁছয় বিজ্ঞানীদের কাছে। এর মধ্যে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য বরাদ্দ টাকার অঙ্ক সবচেয়ে বেশি। গত ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে সেই টাকার উপর জিএসটি ৫% থেকে বেড়ে হয়েছে ১২-১৮%। অর্থাৎ, ১০ লক্ষ টাকার অনুদানে প্রায় দু’-লক্ষ টাকা কর দিতে হচ্ছে।
গবেষণা প্রকল্প কোনও লাভজনক ব্যবসা নয়। তাই গবেষণার অনুদানে এই পরিমাণ কর চাপানোর অর্থ হল অনুদানের পরিমাণ এতখানিই কমে যাওয়া। এর উপরে আবার দেশের বাইরে থেকে আনা যন্ত্রের উপর আমদানি শুল্ক আছে। আমাদের জাতীয় আয়ের মাত্র ০.৬৬% বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যয় হয় (চিন ও জাপানে অনুপাতটি যথাক্রমে ২.২ ও ৩.৫%); এই সামান্য বরাদ্দ থেকেও যদি কিছুটা ঘুরপথে কোষাগারে ফিরিয়ে আনার বাসনা থাকে, তা হলে বুঝতে হবে গবেষণা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আর বেশি দেরি নেই। গত কয়েক বছরে সরকার অনুমোদিত প্রকল্পের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে কমে গিয়েছে, সরকারি বৃত্তির সংখ্যাও কমেছে (এবং অনিয়মিত হয়ে পড়েছে) আনুপাতিক হারে— ফলে ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। বিজ্ঞানীদের মতে, সর্বস্তরে সমান শুল্ক বজায় রাখার নীতি গবেষণা প্রকল্পেও বজায় রাখতে গেলে শুধু জিএসটির জন্যই কিছুটা আলাদা অনুদান মঞ্জুর করা উচিত।
কিন্তু গবেষণার যন্ত্রপাতি যদি বিদেশ থেকে না কেনা হয়, তা হলে তো আমদানি শুল্ক লাগবে না, আর দেশি সংস্থা থেকে কিনলে মোটের উপর দামও অনেক কমই পড়বে। মানে, ঘরের টাকা ঘরেই রইল, গবেষণাও চলল— যাকে বলে সস্তায় পুষ্টিকর। এই উদ্দেশ্যে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের উদ্যোগে একটি পোর্টাল খোলা হয়েছে, যেটা হল ওই জিইএম, যাকে আন্তর্জালে যন্ত্রপাতি কেনাকাটার একটা দোকান বলে ভাবা যায়। সেখানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা তাদের তৈরি নানা রকম যন্ত্র ও যন্ত্রাংশের কথা জানাবে, যাতে বিজ্ঞানীরা তাঁদের দরকারমতো যন্ত্রপাতি কিনতে পারেন। এখানে নাম লেখানো সব সংস্থাকে উল্লেখ করতে হয় যে, তারা কোন দেশের সংস্থা; তাদের বিপণনযোগ্য যন্ত্রের ভারতীয় অংশ কিছু থাকলে সেটাও জানাতে হয়। যে সব যন্ত্রের শতকরা ৫০ ভাগ বা তার বেশি অংশ ভারতে তৈরি, বিপণনের ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার পায়। বিজ্ঞানীরা যখন প্রকল্পের টাকা থেকে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনতে চান, তখন তাঁদের এই পোর্টালের মাধ্যমে কেনাকাটা করতে উৎসাহিত (পড়ুন, বাধ্য) করা হয়। অর্থাৎ, যন্ত্র কিনতে গেলে আগে আপনাকে এই পোর্টালে খোঁজ করতে হবে; দরকারমতো যন্ত্র এই ই-মার্কেটপ্লেসে পাওয়া না গেলে তবেই আপনি সরাসরি নিজের পছন্দমতো সংস্থার কাছ থেকে কিনতে পারেন। এই ভাবে দেশের মাটিতে তৈরি যন্ত্রে দেশের কাজ (মানে বিজ্ঞানচর্চা) হইহই করে এগোবে, আর ‘ভারত গড়ো’ (মেক ইন ইন্ডিয়া) উদ্যোগ সফল হয়ে উঠবে, এটাই সরকারের মনোবাসনা।
কিন্তু মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তোলা যত সহজ, গায়ে জড়ানো ততটা সহজ নয়। গবেষণার যন্ত্রপাতির কাজও ঠিক বাড়ির ফ্রিজ বা টেলিভিশন সেটের মতো নয় যে, কম দামে পাওয়া গেলে কর্মক্ষমতার সঙ্গে সমঝোতা করা যায়। কারণ, গবেষণা শুধুমাত্র ‘দেশের কাজ’ নয়, এখানে লড়াইটা আন্তর্জাতিক ময়দানে, বিজ্ঞান যেখানে তীব্র বেগে দৌড়চ্ছে। দেশে তৈরি যন্ত্রপাতি যদি বিশ্বমানের ফলাফল দিতে না পারে, তবে তার উপর ভিত্তি করে বিশ্বমানের গবেষণা হবে কী করে, আর উঁচু দরের গবেষণা পত্রিকা তাদের ছাপবেই বা কেন! অপ্রিয় হলেও যে কথাটা এখানে স্বীকার করতেই হয়, তা হল, ভারতে তৈরি বেশির ভাগ যন্ত্রের মান এখনও আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক পিছনে। দেশীয় সংস্থায় অনেক সময়েই বিভিন্ন জায়গায় তৈরি কিছু যন্ত্রাংশ জুড়ে একটা বড় যন্ত্র তৈরি করা হয়। এই রকম যন্ত্র হয়তো ‘ব্র্যান্ডেড’ যন্ত্রের চেয়ে অনেক কম দামে পাওয়া যায়, কিন্তু কাজের সময়ে সেই যন্ত্র গড়বড় করলে (প্রায়ই করে) সেই ক্ষতির মূল্য টাকায় মেটানো যায় না। তাই পরীক্ষানির্ভর গবেষণায়— পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ভূবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানের কিছু শাখায়— এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, যেখানে যন্ত্রের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে জিইএম-এর মাধ্যমে নিম্নমানের দেশীয় যন্ত্র কিনতে বাধ্য হওয়ার কারণে বিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে।
যাঁরা পরীক্ষামূলক গবেষণায় সরাসরি যুক্ত আছেন, তাঁরা হাড়ে হাড়ে জানেন যে, পরীক্ষার ফলাফলে খুব সামান্য ত্রুটিও (ধরুন ০.১%) কখনও কখনও গোটা পরীক্ষাটা বানচাল করে দিতে পারে। কিন্তু এ কথাটা নীতিনির্ধারকরা বোঝেন না। তাই জিইএম পোর্টালে তালিকাভুক্ত দেখে তাঁরা বিজ্ঞানীদের কম (প্রায় ১০%) দামে দেশীয় যন্ত্র কিনতে বাধ্য করেন, কিন্তু অন্য কোনও সাহায্যের ব্যবস্থা করেন না। যন্ত্রের গুণমান বা নির্ভরযোগ্যতা, পরবর্তী দেখাশোনা (মেন্টেন্যান্স) এমনকি খারাপ হলে সারিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে এখানে কোনও স্পষ্ট নির্দেশ নেই। সেই যন্ত্র যদি প্রতিশ্রুতিমতো কাজ না করে, নিখুঁত ফলাফল না দেয়, খারাপ হয়ে গেলে সারিয়ে দেওয়ার জন্যও যদি লোক পাওয়া না যায় (এ সবই ঘন ঘন ঘটে), তখন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী কী করবেন? গবেষণা করবেন, না সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকতে আদালতে যাবেন! এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। ক্রেতাদের পক্ষে তাই ই-মার্কেটপ্লেস আদৌ সুবিধাজনক নয়।
বাস্তব চিত্রটা হল, সরকারি প্রকল্পের টাকায় গবেষণার যন্ত্র কিনতে গেলে আপনাকে আগে জিইএম পোর্টালে নাম লিখিয়ে, কোন যন্ত্র চাই তা জানিয়ে দেশীয় সংস্থার কাছে দরপত্র চাইতে হবে। তারা এই যন্ত্র দিতে পারলে সেখান থেকেই কিনতে হবে; তারা সরবরাহে অক্ষম, এটা নিশ্চিত করতে পারলে তবেই আপনি বাইরে থেকে কেনার ছাড়পত্র পাবেন। এই গোটা পদ্ধতির জন্য বেশ কিছু সময় যাবে ও প্রচুর চিঠিপত্র চালাচালি করতে হবে। এর পর শুরু হবে বিদেশ থেকে যন্ত্র কেনার আসল পদ্ধতি, সেও আর একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এই ভাবে ক্রমাগত সময় নষ্ট হওয়ার ফলে গবেষণার কাজের তো ক্ষতি হচ্ছেই, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হছে প্রজেক্টের অধীনে রিসার্চ স্কলারদের, কারণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাঁরা পিএইচ ডি ডিগ্রি পাচ্ছেন না, যেটা তাঁদের কেরিয়ারের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। অর্থাৎ, কিছু টাকা সাশ্রয় করতে গিয়ে সরকার সব দিক থেকে অনেক বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে ই-মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে কেনাবেচার পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে— শুধু ২০২১-২২ আর্থিক বছরেই এই লেনদেন হয়েছে এক লক্ষ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু দেশসেবার এই বহর বিজ্ঞানীদের কাজের ক্ষতি ও হতাশার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
অর্থাৎ, উদ্দেশ্য যদি বা সাধুও হয়, মেক ইন ইন্ডিয়া উদ্যোগের এই অংশটা গবেষকদের ক্রমাগত বিব্রত করে চলেছে। তার কারণ হল, গবেষণার উপযোগী যন্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশের ক্ষমতা কতটা, তা না মেপেই এই উদ্যোগ করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেশীয় সংস্থার তৈরি খুবই উন্নতমানের যন্ত্র পাওয়া সম্ভব। সে সব ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরাও দেশীয় যন্ত্রই কিনতে চান; কারণ তাতে যে টাকার সাশ্রয় হয়, সেটা গবেষণার অন্য খাতে ব্যয় করার সুযোগ থাকে। কিন্তু সেটা সর্বত্র সম্ভব নয়, আর কোথায় সম্ভব বা অসম্ভব সেটা একমাত্র সেই গবেষণায় নিযুক্ত বিজ্ঞানীই জানেন। তাই এই ব্যাপারটায় বিজ্ঞানীদের উপরে বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়ে প্রকল্পের টাকাপয়সা যেন ঠিক সময়ে পৌঁছয়, সেটা নিশ্চিত করলেই গবেষণার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হয়। কিন্তু সরকারকে সে কথা বোঝাবে কে!
আত্মনির্ভর হওয়ার উদগ্র তাগিদে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কাজটা যেন গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার মতো হয়ে না দাঁড়ায়, সেটা খেয়াল রাখা দরকার। ভারত থেকে কেন বিজ্ঞানে নোবেল আসে না, এই প্রশ্নটা প্রায়ই শোনা যায়— এর উত্তরও কিন্তু লুকিয়ে আছে সরকারের এই অবস্থানের আড়ালেই।