৫জি পরিষেবার সূচনা উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত কুমারমঙ্গলম বিড়লা ও মুকেশ অম্বানী, নয়াদিল্লি। ছবি: পিটিআই।
বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভ হয় বটে, কিন্তু লক্ষ্মীলাভের বহর সব ব্যবসায়ীর জন্যে সমান নয়। এখন ভারতে একেবারে উপরের দিকে যাঁদের কথা শোনা যায়, তাঁরা হলেন গৌতম আদানি (মোট সম্পদের পরিমাণ ১৩,৫৮০ কোটি ডলার), মুকেশ অম্বানী (৯,১০০ কোটি ডলার), এবং শিব নাদার (২,৫৫০ কোটি ডলার)। এঁদের নামের সঙ্গে যে ধরনের ব্যবসায়িক সংগঠন জড়িত রয়েছে, সেগুলিকে বলা হয় ‘ব্যবসায়িক গোষ্ঠী’, যাদের গোষ্ঠীবদ্ধতার মূলে রয়েছে পারিবারিক সম্পর্ক। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে এ ধরনের সংস্থার উত্থান— যেমন টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা, মফতলাল ইত্যাদি। কিন্তু গত তিন দশকে অম্বানী বা আদানির মতো গোষ্ঠী যে ভাবে সবাইকে ছাপিয়ে দ্রুত উঠে এসেছে, তা অভূতপূর্ব। বিশ্বের ধনকুবেরদের মধ্যে এখন গৌতম আদানি তৃতীয় স্থানে— এলন মাস্ক এবং জেফ বেজ়োস-এর পরেই।
এই গোষ্ঠীভুক্ত সংস্থাগুলি পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যদিও সে সব সংস্থার সম্পূর্ণ মালিকানা সংশ্লিষ্ট পরিবারের হাতে নয়। শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত যে কোনও কর্পোরেট সংস্থার মতোই অজস্র শেয়ার মালিকও এক অর্থে সংস্থাগুলির মালিক। কিন্তু গরিষ্ঠ মালিকানা হাতে রাখা মালিকরা এই ক্ষুদ্র মালিকদের স্বার্থ সর্বদা রক্ষা করে চলেন, তা বলা যায় না। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর ব্যবসা থাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়ানো। যেমন, টাটা গোষ্ঠীর ব্যবসা ছড়ানো আছে ইস্পাত, মোটরগাড়ি, ইলেক্ট্রনিক্স, তথ্যপ্রযুক্তি, রাসায়নিক, এ রকম ২৯টি ক্ষেত্রে। এ ভাবে ব্যবসা ছড়ানোর ফলে গোষ্ঠীগুলি কিছু বিশেষ সুবিধা ভোগ করে। যেমন, কোনও একটি ক্ষেত্রে যদি ব্যবসায় ক্ষতি হতে থাকে, তখন যেখানে বেশি লাভ হচ্ছে এমন ক্ষেত্র থেকে পুঁজি বার করে এই ক্ষেত্রে লাগানো হয়। ফলে গোষ্ঠীর সার্বিক সাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ থাকে। একে পরিভাষায় বলে ‘টানেলিং’। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই প্রবণতাকে খুব ভাল ব্যাপার বলে মনে করা হয় না।
এর পাশাপাশি অন্য ধরনের ব্যবসায়িক সংগঠনও রয়েছে, যেগুলি পরিবারকেন্দ্রিক নয়। তিন দশক আগের আর্থনীতিক সংস্কারের সময় থেকে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানও বেশি সংখ্যায় উঠে আসতে থাকে। এদের বলা যায় ‘একক উদ্যোগ’। এক বা একাধিক ব্যক্তি পুঁজি সংগ্রহ করে উদ্যোগ শুরু করেন, পরে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তও হয় কিছু সংস্থা। এমন সংস্থার সংখ্যা গত তিন দশকে যথেষ্ট বাড়লেও সামগ্রিক ভাবে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর— বিশেষত চূড়ায় থাকা কয়েকটির— গুরুত্ব কমেনি। একক উদ্যোগগুলির— অর্থাৎ, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীভুক্ত নয়, এমন ব্যবসার— সম্পদের পরিমাণ এখনও মোট সম্পদের মাত্র ১৩ শতাংশ, বাকিটা বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে। বিনিয়োগ করতে যে অর্থ লাগে, তা আসে এক দিকে ব্যাঙ্ক বা অন্য ঋণদাতা সংস্থার থেকে, অন্য দিকে শেয়ার বাজার থেকে। যদি ধরে নিই যে, ঋণের বাজার বা শেয়ার বাজার ‘অনুন্নত’ থাকার কারণে অতীতে এমন পরিবারকেন্দ্রিক সংগঠনের উদ্ভব, তা হলে আর্থিক সংস্কার-পরবর্তী সময়ে তাদের গুরুত্ব কমে যাওয়ার কথা, কারণ ফিনান্সের বাজার এখন অনেক উন্নত। কিন্তু তা হয়নি। ভারতীয় অর্থনীতিতে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলির ব্যাপক প্রভাবের ফলে কিছু বিপজ্জনক পরিণতি দেখা যায়, যার গুরুত্ব অসীম, কিন্তু জনপরিসরে নীতি আলোচনায় তা নিয়ে বিশেষ কিছু শোনা যায় না।
প্রথমত, গোষ্ঠীর হাতে সংস্থার সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার থাকার কারণে সংস্থাগুলির পরিচালনায় সেই গোষ্ঠীগুলি সম্পূর্ণ কর্তৃত্বের জায়গায় থাকে। অন্য শেয়ার মালিকরা সংখ্যায় বেশি হলেও তাঁদের প্রত্যেকের শেয়ারের পরিমাণ কম। যদিও নিয়ম অনুসারে সব শেয়ার মালিকেরই যথোচিত গুরুত্ব পাওয়া উচিত গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থায়, বাস্তবে তা হয় না। এও এক ধরনের অসাম্য, যার সঙ্গে সামগ্রিক আর্থনীতিক বৃদ্ধি এবং বৈষম্য সম্পর্কহীন নয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যে দেশগুলিতে পারিবারিক গোষ্ঠীর গুরুত্ব কম এবং একক উদ্যোগের গুরুত্ব অনেক বেশি, সেখানে গড়পড়তা হিসাবে আর্থিক বৃদ্ধির হারও বেশি। তাই একক উদ্যোগপতিদের বেড়ে ওঠার দিকে নজর দিলে অর্থব্যবস্থার লাভ। অথচ সরকারি নীতিচিন্তায় অনুমান করে নেওয়া হয় যে, নতুন উদ্যোগ স্থাপনের প্রধান বাধা যেন উদ্যোগ ও উদ্যোগীর অভাব, তাই সম্ভাব্য উদ্যোগী তৈরিতে ট্রেনিং-এর উপর জোর দেওয়া হয় বেশি। কিন্তু আসল বাধা যে অসম প্রতিযোগিতা, যার কেন্দ্রে রয়েছে বৃহদাকার ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলি, তা নীতিচিন্তায় আসে না। নতুন উদ্যোগ বাজার থেকে সহজে পুঁজি তুলতে পারে না, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আনুকূল্যও তেমন পায় না। ভারতে ‘স্টার্ট আপ’ থেকে ‘ইউনিকর্ন’— অর্থাৎ, যে সংস্থার সম্পদমূল্য ১০০ কোটি ডলারের বেশি— হয়ে ওঠার রাস্তাটি অতি বন্ধুর।
দ্বিতীয়ত, প্রভাবশালী হওয়ার কারণে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের দখল পেয়ে থাকে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে, ভারতে উপরের দিকে থাকা বড় সংস্থাগুলির মুনাফার প্রধান উৎস খনিজ ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণ, এবং বিশেষ বিশেষ বাজারে একচেটিয়া ক্ষমতার ব্যবহার। পশ্চিমি দুনিয়ায় যেমন আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার বলে বলীয়ান হয়ে বাজার দাপাতে দেখা যায়, এ দেশে কিন্তু সে রকম নয়। অনিশ্চিত নতুন প্রযুক্তিতে তেমন বিনিয়োগ না করেও যে-হেতু বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাই ভারতে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে কর্পোরেট বিনিয়োগও তুলনায় অনেক কম। রাজনীতির সঙ্গে পুঁজিপতিদের আঁতাঁতের বিষয়টি সারা পৃথিবীতেই কম-বেশি দেখা যায়। নির্বাচন লড়া একটি খরচসাপেক্ষ ব্যাপার, ফলে রাজনৈতিক দলগুলিকে সাদা-কালো অনুদানের উপর নির্ভর করতেই হয়। কিন্তু মাত্র গুটিকয়েক গোষ্ঠী যাবতীয় সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে এবং প্রায় একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করছে, অর্থব্যবস্থার পক্ষে তা ভাল নয়, রাজনীতির পক্ষেও নয়। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীদের মধ্যে একটা স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার পরিবেশ থাকলে ভারসাম্য রক্ষা পায়।
পুঁজির নিয়ন্ত্রণে এই চরম অসাম্য কিছুটা ঢাকা দিতেই বোধ হয় ‘কর্পোরেট ফিলানথ্রপি’ অর্থাৎ কর্পোরেট সংস্থার জনহিতৈষী কাজকর্ম নিয়ে প্রভূত প্রচার করা হয়। খবরে দেখি, কোন পুঁজিপতি কোন কল্যাণমূলক কাজে অর্থ নিয়োগ করছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে একটু সম্ভ্রমের ভাবও দেখা যায়। ভারতে এই ধরনের কল্যাণকর্মে বিনিয়োগে টাটা গোষ্ঠীর দীর্ঘ ইতিহাস আছে; সাম্প্রতিক কালে আজ়িম প্রেমজির। এ ছাড়া অন্যরাও কম-বেশি আছেন। প্রতি বছর কে কত দানখয়রাত করেছেন, ‘হুরুন ইন্ডিয়া ফিলানথ্রপি লিস্ট’ তার তালিকা দেয়। দেখা যাচ্ছে যে, গত তিন বছরে মোট দানের পরিমাণে আজ়িম প্রেমজি রয়েছেন শীর্ষে, তার পর শিব নাদার, মুকেশ অম্বানী তৃতীয়। কিন্তু ধনীতম গৌতম আদানি এই তালিকায় অনেক নীচে।
ভারতই প্রথম দেশ যেখানে ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’ (সিএসআর)-কে আইন করে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভারতের সব সংস্থাকে তাদের মুনাফার একটি অংশ সিএসআর-এ ব্যয় করতে হয়। অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই, তেমন কোনও আইন না থাকলেও, প্রচুর পরিমাণে কল্যাণমূলক ব্যয়ের পরম্পরা আছে অতি ধনীদের মধ্যে। ভারতে এক দিকে বাধ্যতামূলক সিএসআর, অন্য দিকে কর্পোরেট মুনাফায় কর বাড়ানোয় অনীহা। আর্থনীতিক অসাম্য কমানো যদি উদ্দেশ্য হয়, সিএসআর কিংবা জনহিতৈষী দাতব্য কখনও করের বিকল্প হতে পারে না। তাই সিএসআর আইন নিয়ে তেমন আপত্তি হয়নি, কিন্তু কর্পোরেট কর বাড়ানোর সদিচ্ছা কোনও সরকারই দেখায় না। বস্তুত, ২০১৯ সালে বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার অজুহাতে কর্পোরেট করের হার কমিয়ে ফেলা হয়েছিল, এবং তার ফলে ২০১৯-২০’তে কর্পোরেট করবাবদ সরকারের আয় কমেছিল এক লক্ষ কোটি টাকা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই পরিমাণ টাকার ফাঁক কর্পোরেট ফিলানথ্রপি দিয়ে ভরানো যায় না।
সাম্প্রতিক কালে অসাম্যের অভূতপূর্ব বৃদ্ধি নিয়ে লেখালিখি কম হয়নি। কিন্তু ভারতের পরিবারভিত্তিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে অন্য ব্যবসায়িক সংগঠনগুলির ক্ষমতার বৈষম্যের বিষয়টি সে আলোচনার কেন্দ্রে আসেনি। সরকারের যে নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মধ্যে ব্যবসা পরিচালন হয়ে থাকে, তার সংস্কারের সময়ে এই অসাম্য দূর করার লক্ষ্যটি সরাসরি নিয়ে আসা প্রয়োজন। সরকারের ‘প্রতিযোগিতা কমিশন’ কিংবা এ-যাবৎ পাশ হওয়া কোম্পানি আইনগুলি এই বৈষম্যকে কমাতে ব্যর্থ।