সঙ্কটের পিছনে আছে এক মৌলিক সংঘাত।
মাসখানেকের ব্যবধানে দু’টি ঘটনা। গত ২৮ জুন কেন্দ্রীয় সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। বেসরকারি প্রকল্পের প্রয়োজনে বনভূমি কেটে ফেলতে হলে স্থানীয় আদিবাসী মানুষের অনুমোদন নেওয়ার আইনি দায় ছিল। ওই বিজ্ঞপ্তিতে সেই দায় থেকে উদ্যোগীদের কার্যত অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যার ফলে সরকারি অনুমতি পেলেই তারা অরণ্য নির্মূল করতে পারবে। বনভূমিতে আদিবাসীদের অধিকার হরণের পথে এই ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’-এর চার সপ্তাহ পরে, ২৫ জুলাই রাইসিনা পাহাড়ের শৃঙ্গে অধিষ্ঠিতা হলেন দ্রৌপদী মুর্মু, ভারতের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপ্রধান।
এক দিকে আদিবাসী মানুষের অধিকার হরণ, অন্য দিকে ‘প্রথম নাগরিক’-এর ভূমিকায় আদিবাসী মানুষের আবির্ভাব— এই দুই ঘটনার পারস্পরিক বিরোধ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু সত্যই কোনও বিরোধ আছে কি? আদিবাসী ভারতীয়দের অধিকার, সুযোগ এবং মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার যে প্রক্রিয়া ধারাবাহিক ভাবেই চলছে, যার মধ্য দিয়ে তাঁদের উত্তরোত্তর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, আদিবাসী রাষ্ট্রপতির অধিষ্ঠান কি সেই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ নয়? রাষ্ট্রপতি ভবনে মাননীয়া দ্রৌপদী মুর্মুর প্রবেশ নিজগুণেই ঐতিহাসিক, তার প্রতীকী গৌরব অনস্বীকার্য, তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের ইতিবৃত্ত যেমনই হোক না কেন; কিন্তু এ দেশে আদিবাসীর অবস্থান যদি প্রান্তিক না হত, তা হলে আলাদা করে রাষ্ট্রপ্রধানের আদিবাসী পরিচয়কে দেশ ও দুনিয়ার সামনে তুলে ধরার দরকার হত না।
অনুষ্টুপ পত্রিকার ‘আদিবাসী ভারত বিশেষ সংখ্যা’টি (অতিথি সম্পাদক: কুমার রাণা ও বড়ো বাস্কি) দেখতে দেখতে কথাগুলো নতুন করে মনে হল। চারটি বিভাগে সুবিন্যস্ত আটাশটি প্রবন্ধ, কিছু বিশদ পরিসংখ্যান এবং একটি গল্প নিয়ে তৈরি এই সঙ্কলনকে মূল্যবান বললে কম বলা হবে। মূল বাংলা লেখা এবং তর্জমার কুণ্ঠাহীন সহাবস্থানে সমৃদ্ধ সংখ্যাটির অধিকাংশ প্রবন্ধের পিছনে আছে সুদীর্ঘ চর্চা, মৌলিক গবেষণা ও প্রত্যক্ষ কাজের অভিজ্ঞতা।
এ-দেশের আদিবাসীদের স্বভূমি থেকে উৎখাত করার, ‘উন্নয়ন’-এর বুলডোজ়ার দিয়ে ক্রমাগত তাঁদের উচ্ছেদ করে চলার ইতিহাস আমাদের অজানা নয়, এই সংখ্যার বিভিন্ন লেখাও নানা দিক থেকে সেই ইতিহাসে আলো ফেলে। উন্নয়ন-উচ্ছেদের প্রকোপে দেশের (জনসুমারির হিসাবে) দশ কোটি আদিবাসীর এক বিপুল অংশ আর্থিক স্বক্ষমতায়, পুষ্টিতে, স্বাস্থ্যে, শিক্ষায়, জীবনের আরও নানা ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হয়ে চলেছেন, সেই বঞ্চনাই আবার তাঁদের সমস্ত সুযোগ ও সম্ভাবনা থেকে বহু যোজন দূরে সরিয়ে রাখছে। রাষ্ট্রের নিরাবরণ মদতে অতিকায় পুঁজির দিগ্বিজয়ী অভিযান যত প্রবল হয়ে উঠছে, ততই রচিত হচ্ছে নতুন নতুন উৎখাত-কাহিনি। সেই অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যত দুর্বল হবে ততই দেখা যাবে যে আদিবাসীরা যেটুকু রক্ষাকবচ পেয়েছিলেন সেটুকুও অপহৃত হচ্ছে, জুন মাসের বিজ্ঞপ্তি যার একটি নিদর্শনমাত্র। ভারতীয় অর্থনীতি ও রাজনীতি এখন যে মাৎস্যন্যায়ের পথে প্রলয়বেগে ধাবমান, আদিবাসী ভারতের ক্রমশ বেড়ে চলা দুর্দশা তারই একটি অঙ্গ।
কিন্তু শুধুমাত্র দারিদ্র এবং আর্থিক দুরবস্থা দিয়ে আদিবাসী ভারতের সঙ্কটের সম্পূর্ণ বৃত্তান্তকে ধরা যাবে না। সেই বৃত্তান্তে নিহিত আছে এক সমৃদ্ধ জীবনধারার প্রাণরস শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্কট, এক ঐশ্বর্যবান জীবনাদর্শের শিকড়ে প্রচণ্ড আঘাত পড়ার সঙ্কট। এবং এই সঙ্কটের পিছনে আছে এক মৌলিক সংঘাত। আদিবাসী মানুষ প্রকৃতিকে, বনভূমিকে, নদী ও পাহাড়কে যে ভাবে দেখে এসেছেন, যে ভাবে নিজেদের সেই প্রতিবেশের অঙ্গ বলে জেনে এসেছেন, তা এই জীবনচর্যা ও তার অন্তর্নিহিত আদর্শেরই অনুশীলন। আজও অপারগ না হলে তাঁরা কাঁচা গাছ কাটেন না, শুকনো কাঠের খোঁজে মাইলের পর মাইল পাড়ি দেন। ‘প্রকৃতির সঙ্গে সহজীবী’ হয়ে থাকার এই দর্শন আমাদের ধারণার জগৎ থেকে অনেক দূরে, আমরা প্রকৃতিকে দেখতে শিখেছি ‘সম্পদ’ হিসাবে, যে সম্পদ ব্যবহার করে এবং ভোগ করে আমাদের উন্নয়নের ফসল ওঠে, আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ে। এই দূরত্বের প্রসঙ্গেই সাহিত্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মী জি এন দেবীর মন্তব্য: “তাঁদের যাপিত জীবন এবং আমাদের জ্ঞান এখনও পরস্পর-বিরোধী।” ‘এখনও’ শব্দটি পড়লে মনে হয়, আমরা বুঝি এক দিন এই না-জানাকে অতিক্রম করব। কিন্তু তার ভরসা কতটুকু? আমরা তো মনে করি, অগ্রগতির পথ আমরাই জানি, ওঁরা জানেন না।
অথচ এই অহঙ্কার পরিত্যাগ করে ওঁদের কাছে শিক্ষার্থী হওয়া জরুরি। আমাদের নিজস্ব স্বার্থে, এমনকি একেবারে অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থে জরুরি। কেন জরুরি, সেটা স্পষ্ট করে বলা আছে জঁ দ্রেজ়-এর লেখাটির উপসংহারে। তাঁর বক্তব্য, ‘মানবসভ্যতা’ নিজেকে সর্বনাশের কিনারায় এনে ফেলেছে, আমরা প্রজাতি হিসাবে বাঁচব কি না, বাঁচলে কত জন কী অবস্থায় বাঁচব, তার কিছুই আজ আর পরিষ্কার নয়। পারমাণবিক যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, অতিমারি, বিশ্বব্যাপী আর্থিক বিপর্যয়— নানা ভাবেই শেষের সে দিন (কিংবা দিনগুলো) ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। দ্রেজ় বলছেন, “এই বিপদ এড়াতে হলে বিশ্ব জুড়ে সমবায় ও সহযোগিতার এক নতুন সংস্কৃতির প্রয়োজন।... এই সমবায় ও সংহতির সংস্কৃতি যদি তৈরি করতে চাই, তা হলে আদিবাসী জীবনধারা থেকে শিক্ষা নেওয়াই শ্রেয়।” সেই জীবনধারার নানা দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এই সমাজবিজ্ঞানী, যিনি এ-দেশে সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রপথিক।
এখান থেকেই দ্রেজ় গণতন্ত্রের প্রশ্ন তোলেন, যে গণতন্ত্র এখন ভারতে চরম বিপদের কবলে। সেই বিপদের মোকাবিলাতেও আদিবাসী সমাজের কাছ থেকে আমরা আত্মশক্তি সংগ্রহ করতে পারি। সেখানে পরস্পরকে সম্মান করবার, পরস্পরের কথা শোনবার, যথার্থ কথোপকথনের ভিত্তিতে সামাজিক সিদ্ধান্ত স্থির করবার যে রীতি এখনও সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়নি, তাকে স্বীকৃতি দিয়েই তিনি লেখেন, “কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আদিবাসী জীবনধারাকে কোন একটি শব্দে ধরা যায়... আমি বলব ‘গণতন্ত্র’।” যে সম্পৃক্ত জীবনযাপনের শৈলীকে (অ্যাসোসিয়েটেড মোড অব প্রোডাকশন) আম্বেডকর যথার্থ গণতন্ত্রের স্বধর্ম বলে চিহ্নিত করেছিলেন, আদিবাসী সমাজে সেটাই স্বাভাবিক বলে গণ্য। তাকে কোনও আদর্শ সমাজ বলে আকাশে তোলার কারণ নেই, কালবৈগুণ্যে তার দেহে ও মনে নানা সামাজিক ব্যাধির সংক্রমণও ঘটেছে, কিন্তু তার কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার ছিল এবং আছে, যা শিখলে আমাদেরই মঙ্গল।
এই মূল কথাটা অনেকগুলি লেখাতেই নানা ভাবে ফিরে আসে। যেমন, অর্থনীতিবিদ দেব নাথন ও গোবিন্দ কেলকর বিশ্বায়িত পুঁজির পরিসরের ভিতরেই নানা ধরনের উদ্যোগের সম্ভাবনা যাচাই করতে গিয়ে বলেন জনজাতির মানুষের জীবনধারা থেকে ‘সহভাগী গণতন্ত্র, সমষ্টিবাদ ও সমতাবাদ’-এর ধারণাগুলিকে আহরণ করে বিকল্প উন্নয়নের উদ্যোগ কি গড়ে তোলা যায় না? প্রসঙ্গত, ফরাসি অর্থশাস্ত্রী টমাস পিকেটি যখন প্রধানত ইউরোপের ইতিহাস থেকে আহৃত ‘সহভাগী সমাজবাদ’ (পার্টিসিপেটরি সোশ্যালিজ়ম)-এর কথা বলেন, আমরা তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি, কিন্তু সেই আলোচনায় আদিবাসী সমাজের সহভাগী জীবনচর্যার কথা আসে না। আসে না, কারণ তাঁদের আমরা প্রান্তিক করেই রেখেছি। কেবল সমাজে অর্থনীতিতে রাজনীতিতে নয়, চিন্তার ভুবনেও তাঁরা প্রান্তিক। ইউরোপ তথা বহির্বিশ্ব সেই ভুবন জুড়ে বিরাজ করে, সেটা দুঃখের নয়, গোটা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের শেখবার আছে; দেব নাথনদের লেখাতেও চিনের নগর ও গ্রাম-ভিত্তিক সংস্থা (টিভিই) বা স্পেনের মন্দ্রাগন সমবায়ের সসম্মান উল্লেখ আছে; কিন্তু ঘরের মানুষেরা আমাদের ভাবনায় অন্ত্যেবাসী— এই দূরত্ব উদ্বেগের কারণ বইকি।
বস্তুত, দূরত্ব ঘোচানোর তাগিদ বহির্বিশ্ব থেকেও সংগ্রহ করতে পারতাম আমরা। দুনিয়ার, বিশেষত লাটিন আমেরিকার নানা অঞ্চলে, কর্পোরেট পুঁজি এবং দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রশক্তির আগ্রাসনকে প্রতিহত করে সামাজিক ন্যায়ের লক্ষ্যে চালিত প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির যে সাফল্য আমরা দেখছি, তার পিছনে খুব বড় ভূমিকা নিয়েছে আদিবাসী মানুষের সহভাগী জীবনাদর্শ। বামপন্থী দল এবং সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের গভীর সংযোগ প্রতিস্পর্ধী রাজনীতিকে এমন একটা জোর দিয়েছে, যা প্রায় গোটা মহাদেশ জুড়ে নানা ধরনের বিকল্প শাসনতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চিলির নতুন সংবিধান প্রবর্তনের উদ্যোগ যার সাম্প্রতিকতম নিদর্শন। এই পরিবর্তন আসছে জনজীবনের অভ্যন্তরীণ সংযোগ থেকে, ক্ষমতার গূঢ় কৌশলে নয়। আদিবাসী মানুষকে সর্ব অর্থে প্রান্তিক করে দেওয়ার অভিশাপ আমাদের জন-বিচ্ছিন্নতার একটি দিক। এই বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়ে যথার্থ সংযোগের সেতু যদি বাঁধতে পারতাম, তা হলে রাইসিনার পাহাড়ে আদিবাসী ভারতের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হত না।