২০২২ সালের মধ্যে কী করে কৃষকের মাসিক আয় বেড়ে ১৬১১৮ টাকা হতে পারে, মন্ত্রী সে ব্যাখ্যা দেননি। ফাইল ছবি।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা হবে। সেই লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হল, আন্তঃমন্ত্রক কমিটিও তৈরি হল। ২০১৮-র সেপ্টেম্বর মাসে বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৪ খণ্ডের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। তার পর কী হইল, জানে শ্যামলাল। গত বছর জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর সংসদে দাবি করলেন, কৃষকদের আয় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। তোমর নিজের বক্তব্যের সপক্ষে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ’-এর প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে বললেন, ৭৫০০০ কৃষিখামারের আয় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। দেশের মোট কৃষি জোতের মাত্র ০.০৫ শতাংশের পরিসংখ্যান থেকে এই দাবি করা যায় কি?
প্রধানমন্ত্রী ২০১৫-১৬ সালে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে বছর কৃষকদের গড় মাসিক আয় ছিল ৮,০৫৯ টাকা। এনএসএসও-র পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের শেষে কৃষি পরিবারের গড় মাসিক আয় দাঁড়িয়েছিল ১০২১৮ টাকা। ২০২২ সালের মধ্যে কী করে কৃষকের মাসিক আয় বেড়ে ১৬১১৮ টাকা হতে পারে, মন্ত্রী সে ব্যাখ্যা দেননি। ২০১২-১৩ সালে দেশে কৃষি পরিবারের গড় মাসিক আয় ছিল ৬,৪২৬ টাকা— যার মধ্যে ২,০৭১ টাকা এসেছিল মজুরি থেকে, ৩,০৮১ টাকা শস্য উৎপাদন ও চাষ থেকে, এবং পশুপালন থেকে ৭৬৩ টাকা। ২০১৮-১৯ সালে, কৃষকের গড় মাসিক আয় ১০,২১৮ টাকার মধ্যে সর্বোচ্চ অংশ এসেছিল মজুরি থেকে, যার পরিমাণ ৪,০৬৩ টাকা। ২০১২-১৩ সালে মজুরি থেকে কৃষকের আয় ছিল তাঁর মোট আয়ের ৩২%, যা ২০১৮-১৯ সালে দাঁড়াল ৪০%। অর্থাৎ, কৃষকরা ক্রমশ দিনমজুরে পরিণত হচ্ছেন।
কৃষি পরিবারগুলির গড় মাসিক আয় ওড়িশায় ৪,০১৩ টাকা থেকে মেঘালয়ে ২৬,৯৭৩ টাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০১৮-১৯’এ দেশের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ১২টিতে কৃষকের গড় মাসিক আয় ১০,০০০ টাকার বেশি ছিল, যার মধ্যে চারটি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য। বাকি ১৬টি রাজ্যের গড় আয় ৪,০১৪ টাকা থেকে ৯,৯৯৫ টাকার মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বহু কৃষিনির্ভর রাজ্যে কৃষক পরিবারের আয় ছিল জাতীয় গড়ের চেয়ে কম।
এ বছরের বাজেটে কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর অনেক পরিকল্পনা আছে। কিন্তু, কৃষিপণ্যের বাড়তি উৎপাদন মানেই কৃষকের বাড়তি আয় নয়। দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ রাজ্যেই ফসল উৎপাদন থেকে কৃষি পরিবারের আয়ের চিত্রটি শোচনীয়। শুধুমাত্র পাঁচটি রাজ্যে কৃষি পরিবারের মোট মাসিক আয়ে ফসল উৎপাদনের অবদান অংশ ৫০ শতাংশের বেশি। ১৬টি রাজ্যে কৃষকের মোট মাসিক আয়ের মধ্যে ফসল উৎপাদন থেকে আয়ের অংশ ৪০ শতাংশের কম। ন’টি রাজ্যে ফসল উৎপাদন থেকে আয়ের অংশ মোট আয়ের ২৫ শতাংশেরও কম। গত দু’-তিন বছরে কৃষকের আয় ফসল উৎপাদনের তুলনায় মজুরি থেকেই এসেছে বেশি।
কৃষকের আয় বাড়াতে হলে সরকারকে উৎপাদন-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাজারকেন্দ্রিক উৎপাদন পদ্ধতির উপর জোর দিতে হবে। সঙ্গে কৃষিপণ্য সংগ্রহের পরিকাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। নচেৎ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কৃষকদের কাজে আসবে না। ধান এবং গম ছাড়া বেশির ভাগ ফসলের সরকারি সংগ্রহের মান খুব হতাশাজনক। পর্যাপ্ত কৃষিপণ্য ক্রয়কেন্দ্রের অভাবেও কৃষকরা সহায়ক মূল্যের সুবিধা পাচ্ছেন না।
এ ছাড়াও পিএম-আশা প্রকল্পের মাধ্যমে কেন্দ্র তিনটি প্রকল্পের জন্য রাজ্যগুলিকে সহায়তা প্রদান করে। এগুলি হল— মূল্য সহায়তা প্রকল্প, যা কৃষিপণ্যের যথার্থ মূল্যপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত করে এবং অতিরিক্ত ফলনের ক্ষেত্রে বিপাকে পড়ে কৃষিপণ্য বিক্রয়ের হাত থেকে কৃষককে রক্ষা করে; মূল্যের ঘাটতি প্রদান প্রকল্পের অধীনে কৃষিপণ্যের বাজার দাম সহায়ক মূল্যের চেয়ে কমে গেলে কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে; এবং ‘প্রাইভেট প্রকিয়রমেন্ট স্টকিস্ট স্কিম’-এর সাহায্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তৈলবীজ সংগ্রহে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। কৃষকদের সুবিধার জন্য, রাজ্যগুলির তরফে এই পরিকল্পনাগুলিকে পুরোমাত্রায় বাস্তবায়িত করা উচিত। কৃষিখামারের আয় বাড়াতে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দূর করার জন্য সারা দেশে সরাসরি কৃষকের দ্বারা বিক্রয়কে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। কৃষিপণ্যের ফলন বেশি হলে কৃষকদের ‘দুর্দশা বিক্রয়’ থেকে রক্ষা করতে, সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন।
২০২৩-২৪’এর বাজেটের মাত্র ২.৭% কৃষিক্ষেত্রের জন্য বরাদ্দ, গত বছর ছিল ৩.৩৬%। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমার ফলে ২০২৩-২৪ অর্থ-বছরে সারের ভর্তুকিও ২২.২ শতাংশ কমানো হয়েছে। পিএম-কিসান প্রত্যক্ষ সুবিধা হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন নেই। মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম এবং প্রাইস সাপোর্ট স্কিমে বরাদ্দ ১,৫০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। পিএম-আশা স্কিমেও বরাদ্দের পরিমাণ ১ কোটি টাকা থেকে কমে ১ লক্ষ টাকা হয়েছে। এই সব ক’টি প্রকল্পই দেশে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যভিত্তিক কৃষিপণ্যের সরকারি ক্রয় কর্মসূচির নির্ণায়ক। অর্থাৎ, কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যটি এই মুহূর্তে সরকারের ভাবনায় নেই।