প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ক্লডিয়া গোল্ডিন। যুগান্তকারী, পথপ্রদর্শক গবেষণার মতো শব্দ বহুব্যবহারে জীর্ণ— কিন্তু অধ্যাপক গোল্ডিনের কাজের ক্ষেত্রে সেই বিশেষণগুলো প্রয়োগ না করে উপায় নেই। অর্থনীতিতে নারী-শ্রমিকের অবস্থান নিয়ে তাঁর যে গবেষণাকে নোবেল কমিটি সম্মান জানাল, তার জন্য ব্যবহৃত তথ্য ‘আবিষ্কার’ করা থেকে পুরনো তাত্ত্বিক কাঠামো ফেলে দিয়ে নতুন বিস্তৃততর কাঠামো তৈরি— ক্লডিয়া গোল্ডিন একা হাতে করেছেন পুরো কাজটাই। ১৯৯০ সালে উনি একটি বই লেখেন; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে সেটি প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের শিরোনামেই গোল্ডিনের গবেষণার পুরো বিষয়টা ফুটে উঠেছে— আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য জেন্ডার গ্যাপ: অ্যান ইকনমিক হিস্ট্রি অব আমেরিকান উইমেন।
আধুনিক অর্থনীতিতে ‘জেন্ডার গ্যাপ’ বা লিঙ্গ-দূরত্ব শব্দবন্ধটা নতুন নয় মোটেই। শুধু আমেরিকায় নয়, উন্নত বিশ্ব বা উন্নয়নশীল দেশ, সর্বত্রই শ্রমের বাজারে লিঙ্গ-দূরত্ব বহুআলোচিত। পরিসংখ্যান দেখলে, গোটা দুনিয়ায় পুরুষদের আশি শতাংশ কাজ করেন অর্থনৈতিক ভাবে মূল্যায়িত কোনও ক্ষেত্রে, অর্থাৎ যেখানে শ্রমের বিনিময়ে মজুরি মেলে, অথবা মুনাফা অর্জন করা যায়; নারীদের মধ্যে এই অনুপাত শতকরা মাত্র পঞ্চাশ। এ ছাড়া, প্রায় সব কাজেই পুরুষদের উপার্জন নারীদের তুলনায় প্রায় কুড়ি শতাংশ বেশি। নারী-পুরুষের এই লিঙ্গ-দূরত্বের আরও নানান অভিমুখ আছে। যেমন, যে কোনও বৃহৎ আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যনির্বাহী বৈঠকে ঢুকলেই দেখা যাবে নারীদের উপস্থিতি পুরুষদের তুলনায় হাতেগোনা। তত উঁচুতে তাকানোরও প্রয়োজন নেই— পরিসংখ্যান বলবে, যে কোনও পেশায় ধাপে ধাপে যত উপরে ওঠা যায়, ততই কমতে থাকে মহিলাদের অনুপাত।
তবে, অর্থনৈতিক ইতিহাসের শিক্ষক ক্লডিয়া গোল্ডিনের কৃতিত্ব এই বৈষম্যগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া শুধু নয়, এই লিঙ্গ-দূরত্ব কী ভাবে তৈরি হল, এবং কেন এখনও তা টিকে আছে, তাঁর গবেষণা এই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধান করেছে। তাঁর গবেষণাপত্রগুলো প্রকাশের আগে এ বিষয়ে প্রচলিত ধারণা ছিল বেশ সরলীকৃত— অর্থনীতিবিদরা ভাবতেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটার সঙ্গে-সঙ্গেই বাজারে শ্রমের চাহিদা বাড়বে, ফলে শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অনুপাতও বৃদ্ধি পাবে। পরিসংখ্যানের রেখচিত্রও তাই ইঙ্গিত দিচ্ছিল বইকি। ক্লডিয়া গোল্ডিন নারী-শ্রমিকের সংখ্যার এই ঊর্ধ্বমুখী রেখচিত্রটিকেই চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। তাঁর মতে, ইতিহাসটাই ঠিকমতো লেখা হয়নি এত দিন। নারীশ্রমের বিগত দু’শো বছরের ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজে বার করলেন তিনি। অষ্টাদশ শতকের শেষ দশক থেকে শুরু করে তিনি দেখালেন, এই দুই শতকের তথ্যের ভিত্তিতে মাপলে, শ্রমিক হিসাবে নারীদের অবদানের চিত্রটা একেবারেই সরলরৈখিক নয়, বরং কিছুটা ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতো দেখতে— শ্রমশক্তিতে নারীর অনুপাত প্রথমে কমেছে, তার পর তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অষ্টাদশ শতকে পৃথিবীর সর্বত্রই মূলত যখন শুধু কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ছিল, তখন নারীরা পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়েই কাজ করত। তার পরের শতকের মাঝামাঝি ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ঘটল; ফলে, সঙ্গত কারণেই কাজের দুনিয়াতে, মানে কলকারখানাতে, নারীর অবদান কমল; ভারী বৃহৎ শিল্পে পুরুষরাই কাজ পেল বেশি, মেয়েদের স্থান হল সংসারে, এবং কুটিরশিল্পে। এর পরে বিংশ শতাব্দীতে আবার নারীদের শ্রমিক হিসাবে বেশি মাত্রায় পাওয়া গেল নানাবিধ কারণে। শিল্পের এবং অর্থনীতির রূপ তত দিনে বদলেছে, পশ্চিমি দুনিয়ায় নানা পরিষেবামূলক কাজ, যেমন ব্যাঙ্কিং, বেড়েছে। গত শতকের শেষ ভাগে মেয়েরা উচ্চশিক্ষায়
যোগ দিয়েছেন; ইউনিভার্সিটিতে ছেলে ও মেয়ের অনুপাত সমান।
কাজের ধরনে পরিবর্তন, চাকরির ক্ষেত্রে শারীরিক শক্তির গুরুত্ব কমা ইত্যাদির পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যোগদান বৃদ্ধির অন্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কারণের দিকে নির্দেশ করেছেন গোল্ডিন। এক, মেয়েদের কর্মজীবন নিয়ে সামাজিক প্রত্যাশার পরিবর্তন ঘটেছে— অন্তত পশ্চিমি সমাজ এখন আর আশা করে না যে, বিয়ে বা সন্তানের জন্মের পরই মেয়েরা সরে আসবে কর্মজীবন থেকে। মেয়েরা এখন দীর্ঘমেয়াদি ‘কেরিয়ার’-এর কথা মাথায় রেখে এগোয়। ফলে, তাদের শিক্ষার পিছনে বিনিয়োগ বেড়েছে। অন্য দিকে, গর্ভনিরোধক বড়ি সহজলভ্য হওয়ায় সন্তানধারণের সিদ্ধান্তের উপর মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে। ফলে, চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়েছে।
গোল্ডিনের গবেষণা কিন্তু এখানে শেষ নয়, বরং শুরু বলতে পারেন। মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের ‘ইউ’-আকৃতির রেখচিত্র দেখে তাঁর মনে পরের প্রশ্ন উঠল, এত দিনেও ‘জেন্ডার গ্যাপ’ থেকে আমরা মুক্তি পেলাম না কেন? গোল্ডিন-পূর্ব যুগে বহু অর্থনীতিবিদ ভাবতেন যে, নারী-শ্রমিকরা শুধু নারীই, ঠিক শ্রমিক নন। তাঁরা আসলে সংসারই করবেন ও করতে চান— সঙ্গে, বিয়ের আগে, বড়জোর কয়েক বছর, তাঁরা কাজ করেন। অথচ, পুরুষদের জন্য অর্থনীতির মডেল ছিল ‘র্যাশনাল’। সাবেক অর্থনীতির মডেল বলে, উৎপাদন হয় ‘ক্যাপিটাল’ আর ‘লেবার’-এর সমন্বয়ে। এক জন শ্রমিকের অবদান মাপা হয় কতটা সময় তিনি কাজ করছেন তাই দিয়ে— চব্বিশ ঘণ্টার অবশিষ্ট সময়টুকু তাঁর ‘অবসর’। শ্রমিকের কাজের এক-এক রকম মূল্য, যাকে আজকাল আমরা চিনি ‘চার্জ-আউট রেট’ হিসাবে। শ্রমিক হিসাবে ব্যক্তির ‘ইউটিলিটি’ আসে তাঁর উপার্জন ও অবসর সময় থেকেও। এ-হেন পুরুষতান্ত্রিক মডেলে নারী-শ্রমিকের কথা আলাদা করে বিশ্লেষিত হওয়ার অবকাশ নেই; তাই, গোল্ডিনের গবেষণার আগে শ্রমে লিঙ্গবৈষম্য ব্যাখ্যা করা যায়নি।
তথ্য ঘেঁটে গোল্ডিন দেখলেন নারী-পুরুষের লিঙ্গ-দূরত্ব কর্মজীবনের শুরুতে থাকে না; এর শুরু প্রথম সন্তানের জন্মের পরেই, ক্রমশ তা বাড়তে থাকে। এই বৈষম্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গোল্ডিন বললেন, সাবেক চাহিদা-জোগানের সূত্র ধরে নারী-শ্রমিকের অবদান মাপলে চলবে না। এক জন নারীর শ্রমিক হিসাবে ব্যক্তিগত চয়েস বা চয়ন নির্ভর করে একাধিক ভেরিয়েবল বা চলরাশির উপরে; তিনি জীবনের কোন পর্যায়ে, কখন কতটা সময় শ্রমিক হিসাবে ব্যয় করবেন, তা তিনি স্থির করবেন পরিস্থিতি বুঝে। যেমন, আজকের দিনে আধুনিক উচ্চশিক্ষিত নারীমাত্রই জানেন, সন্তানধারণ করতে হলে তেইশ থেকে চল্লিশ, এই সতেরো বছরই বড়জোর হাতে থাকে; অগত্যা এই ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ মেনে নিয়েই নারী-শ্রমিক তাঁর সিদ্ধান্ত নেবেন— উচ্চশিক্ষায় কতটা সময় দেবেন, ক’টি সন্তানের মা হবেন, প্রথম সন্তানধারণের আগে কত বছর কাজ করবেন ইত্যাদি। এ ছাড়া, গোল্ডিন আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করলেন— আগের প্রজন্মের থেকে শেখা। গোল্ডিনের মতে, কোনও মেয়ে তাঁর মায়ের জীবন দেখেই স্থির করেন যে, তিনি নিজের জীবনে কী করতে চান; মায়ের সিদ্ধান্ত মেয়ের কর্মী হিসাবে চয়নকে প্রভাবিত করে।
গোল্ডিনের গবেষণা আমাদের চোখ খুলে দেয় ঠিকই। আমরা ভাবতে বসি যে, তা হলে কি কিছুই করার নেই, এই লিঙ্গ-দূরত্ব থাকবেই? এ-হেন ঐতিহাসিক নোবেল পুরস্কারের পরে প্রশ্ন উঠতে পারে, কী ভাবে এই দূরত্ব ঘোচানো যায়, নিদেনপক্ষে কমানো যায়। গোল্ডিনের কাজ সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করে না— তাঁর গবেষণার বিষয় ঐতিহাসিক ভাবে লিঙ্গ-দূরত্বের ধরন ও কারণ নির্দেশ করা। তিনি তা করেছেন, এর পরের কাজটা সমাজের, সরকারের। বিভিন্ন দেশে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের রূপ এক-এক রকম। তাই আমেরিকার বা বিলেতের সরকারের যা ভূমিকা, তার সঙ্গে ভারতের বা পশ্চিমবঙ্গের মিল হয়তো হবে না; আমাদের সমস্যা নিয়ে আমাদের সরকারকেই ভাবতে হবে বইকি।