বিশ্ববাজারে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন বাংলার মাছ চাষিরা
Fish Farmers

চিংড়ির শনির দশা

কেবল চিংড়ি নয়, চিংড়ি চাষিরাও আজ গাছের কাছে আশ্রয় খুঁজছেন। প্রথমে কোভিড, তার পর বুলবুল-ইয়াস ঝড়, তার পর রফতানিতে ভাটা।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২৩ ০৫:০৯
Share:

আশ্রয়: মিনাখা ব্লকের চৈতলে ম্যানগ্রোভে ঘেরা ভেড়িতে চলছে পরীক্ষামূলক জৈব চাষ। —ফাইল চিত্র।

সুন্দরবনের ভেড়ি যেন জলের মরুভূমি। বড় সড়কের ধার থেকে দিগন্ত পর্যন্ত ধু-ধু জল। উপগ্রহের ছবি দেখাচ্ছে, উপকূলবর্তী এলাকায় অন্তত দশ হাজার হেক্টর জমি এখন মাছ চাষের দখলে। এ সবই এক দিন ছিল জঙ্গল। সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, কেওড়া কেটে ধানখেত হয়েছিল ইংরেজ আমলে। তার পর খেত হল ভেড়ি। মিনাখা ব্লকের চৈতলের চাষি, নারায়ণ চন্দ্র দাসের বয়স এখন তিপ্পান্ন। বছর চোদ্দো বয়স থেকে ধান চাষে হাত লাগিয়েছেন। সেই জমিতে মাছ চাষ শুরু হল, যখন তাঁর বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। আর এখন, এই তিপ্পান্ন বছর বয়সে, নারায়ণবাবু আবার ফিরেছেন গাছের কাছে। তাঁর পাঁচ বিঘা ভেড়ির চার পাশে লাগিয়েছেন ম্যানগ্রোভ— বাইন, সুন্দরী, কাঁকড়া, গোলপাতা। জলে আছে গলদা, বাগদা, পারশে, ভাঙন।

Advertisement

নারায়ণবাবুর দাবি, গাছই মাছ বাঁচাচ্ছে। জলের ভিতর ঝোপ ঊর্ধ্বমুখী শিকড়ের। মাছ শিকড়ের ফাঁকে আশ্রয় পাচ্ছে, গাছের ছায়া বাঁচাচ্ছে রোদের তাপ থেকে। ইউ২০, ইউ৩০ খাবার দিতে হচ্ছে না, খরচ বাঁচছে। “অন্য ভেড়ির মাছ ভাইরাসে মরছে, আমাদের মাছে রোগ হচ্ছে না,” বললেন বছর তেতাল্লিশের পিন্টু দাস। খোলতাই হচ্ছে মাছের চেহারাও। “এই দেখুন, কেমন বাগদা,” বললেন এক চাষি। চিংড়ির সরু মাথা তাঁর মধ্যমার শীর্ষ ছুঁয়েছে, লেজ স্পর্শ করছে মণিবন্ধ। “খোলের মধ্যে শাঁস কেমন আঁট হয়ে বসে, দেখছেন? অন্য ভেড়ির মাছের মতো খোলা আলগা নয়।” একটি অসরকারি সংস্থার কাছে এই চাষিরা ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্রে সুস্থায়ী মাছ চাষের ট্রেনিং নিয়েছেন।

উত্তর ২৪ পরগনার চৈতলের কুড়ি হেক্টর, আর দক্ষিণ ২৪ পরগনার মাধবপুরের দশ হেক্টর ভেড়িতে তাঁরা সুসংহত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করছেন, জানালেন ওই সংস্থার কর্ণধার অজন্তা দে। ফলাফল পর্যবেক্ষণ করছেন আইআইএসইআর-এর বিজ্ঞানী পুণ্যশ্লোক ভাদুড়ি। তাঁর মতে, সমন্বিত চাষের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। গাছের পাতায় জমা শেওলা জলের প্রাণীরা খায়, সেই প্রাণীদের খায় মাছ। ম্যানগ্রোভের পাতায় থাকে ট্যানিন, যা মাছের রোগ প্রতিরোধের শক্তি বাড়ায়। ম্যানগ্রোভের উপকারী জৈব রাসায়নিকগুলো চিহ্নিত করছেন বিজ্ঞানীরা।

Advertisement

কেবল চিংড়ি নয়, চিংড়ি চাষিরাও আজ গাছের কাছে আশ্রয় খুঁজছেন। প্রথমে কোভিড, তার পর বুলবুল-ইয়াস ঝড়, তার পর রফতানিতে ভাটা। ব্যবসায়ী মামরেজ আলি জানালেন, দু’বছর আগেও সতেরো টনের কন্টেনার বিদেশে পাঠাতেন পাঁচশোটা, এখন বড়জোর আড়াইশো। তাতে গেরস্তের পৌষ মাস, কলকাতার বাজারে বছর দুয়েক পকেটসই বাগদার দেখা মিলছে। কিন্তু সর্বনাশ মাছ চাষিদের। হাসনাবাদের বাউল সর্দার জানালেন, ছাব্বিশ বিঘা ভেড়িতে ভেনামি চিংড়ি চাষ করে ৩০ লক্ষ টাকা খুইয়েছেন গত বছর। মাছ, কাঁকড়া এবং চিংড়ি চাষিদের সংগঠন ‘অ্যাকোয়াফার্মার্স ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর প্রতিনিধি মদনমোহন মণ্ডলের হিসাব, মড়ক এবং মন্দার জেরে পাঁচ বছরে চিংড়ি উৎপাদন অর্ধেক হয়েছে, গত বছর পশ্চিমবঙ্গের চাষিদের ক্ষতি হয়েছে অন্তত চারশো কোটি টাকা। মাছচাষ প্রধানত মহাজন-নির্ভর, সুদ মাসে দশ শতাংশ। ঋণ শোধের তাগিদে ভিন রাজ্যে জন খাটতে গিয়েছেন মাছ চাষিরা। পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার থেকে উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ-হিঙ্গলগঞ্জ, অগণিত পুকুর চাষহীন। এই বিপুল বিপর্যয় ভোটের প্রচারে, চেম্বার অব কমার্সের রিপোর্টে, বাংলার অর্থনীতি বা শিল্পের আলোচনায় কোনও চিহ্নই ফেলেনি।

ইকোয়েডর আর ইন্দোনেশিয়া কম দামে ভাল জিনিস দিয়ে ভারতের বাজার দখল করছে। বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার ইকোয়েডর দেশটি দ্রুত উন্নতি করেছে। সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ব্র্যাকিশওয়াটার অ্যাকুয়াকালচার-এর আধিকারিক দেবাশিস দে জানালেন, সে দেশে উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়, রাসায়নিকহীন চিংড়ি চাষ হচ্ছে। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীরা প্রয়োগ করছেন আস্থা জাগানোর কৌশল, কোন খামার থেকে এসেছে মাছ, তা ‘ট্রেস’ করতে পারবেন ক্রেতা। এমনকি, মাছ কী খেয়েছে, তা-ও জানা যাবে।

কী খায় আমাদের মাছ? সুন্দরবনের ভেড়ি-পুকুরে এখনও ঠেসে নাইট্রোজেন-প্রধান রাসায়নিক খাবার দেওয়া হয়। ফলে মাছের শরীরেও জমে রাসায়নিক। মাছের অভুক্ত খাদ্য এবং বর্জ্য জমে পুকুরের তলায় দূষিত, দুর্গন্ধ পাঁক তৈরি হয়। পুকুর সাফ করার সময়ে সেই পাঁক নদীর জলে মিশলে বেশ কিছু দিন পাঁচ-সাত কিলোমিটার পর্যন্ত নদীর জলে আর মাছ খুঁজে পাওয়া যায় না। মিল্ক ফিশ, আঁশ ভাঙন, লাল গুলে, কালো গুলে, কাঠ কই, দাঁতনে, তেড়ে মাছের মতো বহু প্রজাতি সুন্দরবনের নদী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সবুজ বিপ্লবের পর যে ভাবে বিষিয়েছে মাটি, সে ভাবেই জল। দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম-এর দেবাশিস শ্যামলের দাবি, “বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষের পুকুরের পাঁকে কী কী আছে, পরীক্ষা করে তথ্য প্রকাশ করা হোক। রফতানির জন্য এক কেজি চিংড়ি উৎপাদন
করতে আমাদের কী কী সম্পদ ধ্বংস হয়, তার হিসাব করা হোক।”

ধান-আলুর চাইতে চিংড়ি চাষে এই ধ্বংসের প্রক্রিয়াটা ঘটেছে আরও দ্রুত। সত্তরের দশকে চাষ হত ‘ভাসা-বাঁধা’ পদ্ধতিতে। নদীর জল ভেড়িতে ঢুকত মাছের বীজ নিয়ে, তা আপনিই বড় হত। আশির দশকে শুরু হল বাগদার চাষ। অল্প জলে অনেক মাছ, অনেক খাদ্যে চাষের ঝোঁক এল। বছর পাঁচ-ছয় ‘ব্ল্যাক টাইগার প্রন’ রফতানি প্রচুর লাভ আনল। বাগদার উৎপাদন ১৯৯০ সালে ত্রিশ হাজার টন থেকে ১৯৯৯ সালে এক লক্ষ টন ছাড়িয়ে গেল। তার পরে ভাইরাসের মড়ক এল, সর্বস্বান্ত হলেন অগণিত চাষি। নতুন শতকে এল মেক্সিকোর চিংড়ি ভেনামি। উৎপাদন প্রচুর— বাগদা যেখানে প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয় ৫০০-৬০০ কেজি, সেখানে ভেনামি হয় পাঁচ থেকে ছয় টন। কিন্তু এক কেজি ভেনামি তৈরি করতে দেড় কেজি খাবার লাগে, যার দাম দ্রুত বেড়েছে। আজ ভেনামির বাজারদর ২৫০ টাকা কেজি, উৎপাদন খরচ ৩০০-৩৫০ টাকা।

এই সঙ্কট থেকে দু’টি রাস্তা দু’দিকে গিয়েছে। একটা রাস্তার দাবি, বিদ্যুতে ভর্তুকি দিক পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বীজের মান পরীক্ষার ব্যবস্থা করুক, খাবারের দাম বেঁধে দিক, চিংড়ির ন্যূনতম দাম ঘোষণা করুক। তৃণমূল স্তরের কর্মী (এক্সটেনশন ওয়ার্কার) রেখে এমন প্রযুক্তি শেখাক চাষিদের, যাতে ইন্দোনেশিয়া, ইকোয়েডরের চিংড়ির সঙ্গে বাংলার ভেনামি যুঝতে পারে। আর অন্য রাস্তাটি গিয়েছে ম্যানগ্রোভের ছায়ায়। ‘হয় দশতলা নয় গাছতলা’— ভেনামির এই ফাটকাবাজি থেকে সরে আসে সুসংহত চাষের বাগদায়। সীমিত, কিন্তু নিয়মিত আয়ের পথ দেখায়। সেই রাস্তারও দাবি আছে। “চর্মনগরীর জল যেন বিদ্যাধরীতে না আসে, বলবেন কলকাতায়। এত রাসায়নিক মিশছে নদীতে, লার্ভা বাঁচছে না,” বললেন চৈতলের চাষিরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement