—ফাইল চিত্র।
এমন সঙ্কটের মুখে শিক্ষাব্যবস্থা সম্ভবত কখনও পড়েনি। ডাক্তারিতে ভর্তি হওয়ার কেন্দ্রীয় সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা ‘ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট’ (নিট)-এ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে যখন দেশ উত্তাল, তখনই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক ও জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপের জন্য গৃহীত পরীক্ষা, ইউজিসি-র ‘ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট’ (নেট) বাতিল হল। জানা গেল, সাইবার অপরাধ দমন শাখার কাছ থেকে নিট-এর প্রশ্নপত্র ডার্ক ওয়েবে আপলোড হওয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতর এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, দুর্নীতির আশঙ্কায় পরীক্ষা বাতিলের তালিকায় যুক্ত হল আরও একটি পরীক্ষা, নিট-পিজি। ডাক্তারিতে স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে ভর্তির যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা স্থগিতের ফলে বিপুল সংখ্যক ডাক্তারের উচ্চশিক্ষার দরজা সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। দেশের মেধাবী ছাত্রদের অপরিসীম পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে নেওয়া প্রস্তুতি এক ফুঁয়ে উড়ে যাওয়ার এমন মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা অতীতে ঘটেছে কি?
যাদের জন্য এই পরীক্ষাগুলো দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ে বাতিল বা সন্দেহজনক বলে চিহ্নিত হল তাদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়ও, এই সংগঠিত অপরাধের ফলে যে বিপুল সংখ্যক ছাত্রের ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তায় পড়ল— তার সুরাহা যে আশু সম্ভব নয় তা এক প্রকার নিশ্চিত। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, পরীক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সর্বোচ্চ স্তরের আধিকারিকদের যোগসাজশ ছাড়া এ ধরনের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস সম্ভব নয়।
ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী নিট নিয়ে একাধিক বার তাঁর বয়ান বদল করেছেন। গত ১৪ জুন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দাবি করেছিলেন, দু’-একটা বিচ্ছিন্ন ক্ষেত্রে কিছু অনিয়ম হয়ে থাকলেও নিট-এ কোনও দুর্নীতি হয়নি। কিন্তু পরে নিট-কেলেঙ্কারিতে যুক্ত বেশ কয়েক জনের গ্রেফতারি এবং একাধিক ব্যক্তি/পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রমাণ-সহ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সামনে আসার পর তিনি দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছেন বটে, তবে দায় স্বীকার করে পদত্যাগ বা নিট বাতিলের রাস্তায় হাঁটেননি। একই সঙ্গে এ-ও উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ নিট-এর মেধাতালিকার ভিত্তিতে কাউন্সেলিং প্রক্রিয়া বাতিল বা স্থগিতাদেশের আবেদন বাতিল করেছে। আন্দোলন ও তদন্তপ্রক্রিয়ার অগ্রগতির ভিত্তিতে নিট-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আদালত বা কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক কী অবস্থান নেবে, সে বিষয়ে আগাম মন্তব্য করা দুরূহ। কিন্তু এই ঘটনাবলির জেরে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকেরা যে হতাশা ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
চাকরিতে নিয়োগের পরীক্ষাই হোক বা কোনও কোর্সে ভর্তির পরীক্ষা, ভারত এর আগে দুর্নীতি কম দেখেনি। তা যে শুধু কেন্দ্র বা একটিমাত্র রাজ্যে সীমাবদ্ধ, তা-ও নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে কেন্দ্রীয় সরকারের এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে এ রাজ্যে এসএসসি ও টেট-এ যে ধারাবাহিক দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে, তার অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা। রাজ্যে যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের ফলে বনিয়াদি শিক্ষার মানের অবনমন অনিবার্য হয়েছে, অন্য দিকে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় ভাটা পড়েছে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহে। রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা উচ্চতর পাঠক্রমে ক্রমবর্ধমান ছাত্রাভাব থেকেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
একই ভাবে নিট ও নেট-এ দুর্নীতির পাশাপাশি, পরীক্ষার ঠিক আগে ইউজিসি-নেট বাতিল হওয়াটা মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মনে কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যে অনাস্থা ও নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে, তা সহজে দূর হওয়ার নয়। রাজ্য সরকারের নানা পরীক্ষার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা হারালেও যে শিক্ষিত কর্মপ্রার্থীরা কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিকে পাখির চোখ করে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাঁরাও অকূল পাথারে পড়লেন। কেন্দ্রের তরফে এই পরীক্ষা-কেলেঙ্কারির রহস্য উন্মোচনে যতই তদন্তের আশ্বাস দেওয়া হোক, প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা যুবসমাজকে আরও হতাশ ও বিভ্রান্ত করেছে।
গভীর পরিতাপের বিষয়, এ ধরনের দুর্নীতিগুলি যখনই সামনে এসেছে, তখনই রচিত হয়েছে আর এক রাজনৈতিক কুনাট্য। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অপরাধ স্বীকারের বদলে নির্লজ্জ ভাবে একে অন্যের দুর্নীতির তুলনামূলক বিচারে তৎপর হয়ে উঠেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে, একটি দুর্নীতি ও তার নেপথ্য কারিগরদের আড়াল করতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোটি কোটি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, অথচ ভুক্তভোগী নিরপরাধদের সুবিচারের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে প্রতি পদে। এর ফলে দোষীদের শাস্তিবিধান প্রক্রিয়াই শুধু বিলম্বিত হচ্ছে না, দুর্নীতির শিকার যাঁরা, তাঁদের ভোগান্তিও বেড়ে চলেছে।
আর এই সব কিছুর পরিণামে যে অমোঘ প্রশ্নটি সামনে চলে আসছে তা হল, এ ভাবে আগামী প্রজন্মের সামনে আমরা কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছি? মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দুর্নীতির পাঁকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত নেতা-মন্ত্রীদের অসততা আর শিক্ষিত ও সুশীল সমাজের বধিরতা যদি ভবিষ্যতের নাগরিকদের আদর্শহীনতা আর দুর্নীতির দিকে ধাবিত করে, তা হলে শাসনের নামে তাঁদের পায়ে বেড়ি পরানো যাবে কি?