আপত্তি: অসমের কংগ্রেস সাংসদ প্রদ্যুৎ বরদলই এবং আবদুল খালিক ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, ২০ জুলাই। ছবি: পিটিআই।
গত ১৬ অগস্ট রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তিকে মান্যতা দিয়ে অসমের ‘ডিলিমিটেশন’-এর নথিতে সই করলেন। গত এক দশকেরও বেশি অসমের রাজনীতিতে এনআরসি শব্দটা অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে আছে। বর্তমানের প্রেক্ষিতে ‘ডিলিমিটেশন’ শব্দটি ক্রমে সেই জায়গা নিচ্ছে বলেই আশঙ্কা। অসমে দু’টি উপত্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে, এবং ভাষাগত/ধর্মগত ভাবে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শব্দটির অভিঘাত গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা ডিলিমিটেশনের খসড়া পরিকল্পনায় মন্তব্য করেছিলেন, ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি বা ইদানীং কালের এনআরসি অসমে যা করে উঠতে পারেনি, এই ডিলিমিটেশন মাধ্যমে তা হয়ে যাবে। কী ভাবে তা হতে পারে?
ডিলিমিটেশন একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। দেশের প্রতিটি নির্বাচনী ক্ষেত্রে ভোটারের সংখ্যা যাতে কম-বেশি কাছাকাছি থাকে, অর্থাৎ যাতে নির্বাচন ক্ষেত্র-নিরপেক্ষ ভাবে প্রতিটি ভোটের গুরুত্ব সমান হয়, তার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর ক্ষেত্রগুলির সীমা পুনর্বিবেচনা ও পুনর্নির্ধারণ করা হয়। স্বাধীনতার পর ভারতে জাতীয়-স্তরে চার বার (১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৭২ এবং ২০০২ সালে) ডিলিমিটেশন কমিশন তৈরি হয়েছে। রাজ্যস্তরে ডিলিমিটেশন কমিশনে সাধারণত নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি হিসাবে সুপ্রিম কোর্টের কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারপার্সন হিসাবে নিয়োগ করা হয়। সরকার ও বিরোধী পক্ষের বিধায়করা থাকেন। ডিলিমিটেশন কমিশনের সুপারিশ সম্পর্কে কোনও আদালতে প্রশ্ন তোলা যায় না। রাষ্ট্রপতির নির্দেশে এই সুপারিশ কার্যকর করা হয়।
২০০১ সালের জনশুমারির ভিত্তিতে তৈরি ২০০২ সালের ডিলিমিটেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী ডিলিমিটেশন কমিশন ভারতে শেষ বার কাজ করেছিল ২০০৮ সালে। কিন্তু সে সময়ে অসম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড ও মিজ়োরাম, এই চারটি রাজ্যকে ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। স্থির হয়, অসমে পরবর্তী সময়ে ডিলিমিটেশন করা হবে নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে। কমিশনের মতামত ২০০৮ সালের ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বিবেচিত হবে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে অসমে ডিলিমিটেশন-এর প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু ২০১১ সাল নয়, ২০০১-এর জনগণনার ভিত্তিতে সীমানা পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ডিলিমিটেশনের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান, যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা, প্রশাসনিক কাঠামোর মতো নানাবিধ শর্ত থাকলেও, আসল গুরুত্ব পায় জনসংখ্যার প্রশ্নটি। ২০০২ সালে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, ডিলিমিটেশন-এর মাধ্যমে নির্বাচনী ক্ষেত্রের সংখ্যা বাড়ানো যাবে না, শুধু তার পুনর্বিন্যাস করা যাবে। ২০০৮ সালে ডিলিমিটেশন-এর গাইডলাইনে লেখা ছিল যে, কোনও একটি নির্বাচন ক্ষেত্রের জনসংখ্যা গড় জনসংখ্যার তুলনায় ১০% পর্যন্ত কম বা বেশি হতে পারে। এ বারে নির্বাচন কমিশন রাজ্যের জেলাগুলোকে এ, বি, এবং সি, এই তিন ভাগে ভাগ করেছে। যে সব জায়গায় জনঘনত্ব বেশি, সে সব অঞ্চলে গড়ের চেয়ে দশ শতাংশ বেশি জনসংখ্যার ঊর্ধ্বসীমা ব্যবহার করা হচ্ছে; যেখানে জনঘনত্ব কম, সেখানে দশ শতাংশের নিম্নসীমা। স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, এ সব বিধান ডিলিমিটেশন-এর মূল শর্তে নেই, তাই এই প্রক্রিয়াকে অসাংবিধানিক বলা যায়।
এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে আসনসংখ্যা পাল্টে যাচ্ছে। করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, কাছাড় জেলা নিয়ে তৈরি বরাক উপত্যকার ক্ষেত্রে বিধানসভায় ১৫টি আসন ছিল। এ বারের ডিলিমিটেশন-এর খসড়া পরিকল্পনায় তা কমিয়ে ১৩ করে দেওয়া হয়েছে। আবার বড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল এরিয়াতে, কোকড়াঝাড়ের মতো কম জনঘনত্বের জায়গায় আসনসংখ্যা ১১ থেকে বাড়িয়ে ১৫ করা হয়েছে। বরাক উপত্যকার এলাকাগুলোকে যে ভাবে বিচ্ছিন্ন করা বা জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে ভৌগোলিক সাযুজ্যও মানা হয়নি বলে অভিযোগ। যেমন, বদরপুর শহর কাছাড় সংলগ্ন। হিন্দু অধ্যুষিত বদরপুর মিউনিসিপ্যালিটি এরিয়া এবং পাঁচগ্রামের হিন্দু এলাকাও কেটে নিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে কাছাড়ে। আবার বদরপুর সংলগ্ন কাটিগড়া নামক হাওর অঞ্চলের ন’টি মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে হাইলাকান্দি জেলার মুসলমান অধ্যুষিত আলগাপুর অঞ্চলের সঙ্গে, যেখান থেকে মুসলমান প্রার্থীই জিততেন। কাটিগড়ায় হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যা প্রায় সমান ছিল, সেখানে বদরপুর আর পাঁচগ্রামের হিন্দু এলাকা কেটে নিয়ে আসার ফলে হিন্দু জনসংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছে যে, এখানে হিন্দু প্রতিনিধির জয়ের সম্ভাবনা প্রকট বলেই মনে করা হচ্ছে। করিমগঞ্জে চারটে নির্বাচনী এলাকার অঞ্চল আর জনসংখ্যা এক নয়। দোহালিয়া রেঞ্জ আর বাদশাহি রেঞ্জের এক দিকে পাথারকান্দি, অন্য দিকে রাতাবাড়ি নির্বাচনী এলাকা। এই দুটো জায়গার কিছু গ্রামকে কেটে, অন্য অঞ্চলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। রাতাবাড়ি নির্বাচনী এলাকাকে পরিবর্তিত করে নতুন নামকরণ করা হয়েছে রামকৃষ্ণনগর। অভিযোগ, এই বিভাজন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে মাথায় রেখে করা হয়েছে। মুসলমান বা অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠী অধ্যুষিত গ্রামগুলোকে আলাদা নির্বাচনী এলাকার মধ্যে আনার একটা ধাঁচ লক্ষ করা যাচ্ছে। আশঙ্কা করা যেতে পারে, মূল উদ্দেশ্য হল অহিন্দু নির্বাচনী এলাকার আসনসংখ্যা কমানো, যা বিধানসভায় হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যথেষ্ট হবে।
আগে বরাক উপত্যকায় হিন্দু-মুসলমান আসনসংখ্যা ছিল সমান। ডিলিমিটেশনের পর ১৩টি আসনের মধ্যে ১০টিতে হিন্দুরাই জিতবেন মনে করা হচ্ছে— সেই হিন্দু বিজেপির প্রার্থী হতে পারেন, কংগ্রেসেরও হতে পারেন। বাকি থাকছে তিনটি আসন, কাছাড়ের সোনাই, আলগাপুর-কাটলিছোলা এবং দক্ষিণ করিমগঞ্জ। ৬৫ কিলোমিটার দূরের ধলাই-এর দুটো ব্লক বরখোলার সঙ্গে, পুরনো শিলচরের ৬টা ওয়র্ড কেটে উদারবন্দের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই ভাগ থেকে স্পষ্ট যে, ধর্মপরিচয়ে মুসলমানরা ঢুকে যাচ্ছেন কিছু নির্দিষ্ট আসনে। আবার লক্ষ্মীপুর এলাকায় মেইতেই বা মণিপুরিরা তিনটি নির্বাচনী এলাকায় ভাগ হয়ে যাওয়ার ফলে তাঁদের ভোট আর নির্ধারক থাকছে না।
বরাকের জনসংখ্যা এখন আনুমানিক ৪৫ লক্ষ। ২০০১ সালের জনশুমারি অনুসারে অসমের জনসংখ্যা ২.৬৬ কোটি। সেই হিসাবে অন্তত ১৫টা আসন বরাকে থাকা উচিত ছিল। করিমগঞ্জ জেলা আদালতের আইনজীবী শিশির দে’র মতে, ডিলিমিটেশনের আসল যে উদ্দেশ্য, অর্থাৎ নির্বাচনী এলাকাগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা, সেটা তো করা হয়নিই, বাস্তবে এক অদ্ভুত ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে। ২০ জুলাই ইলেকশন কমিশনের একটা দল গুয়াহাটিতে গণ-শুনানির ব্যবস্থা করেছিল। বহু মানুষ নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছেন। কমিশন তাকে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে?
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেছেন, ডিলিমিটেশন-এর মাধ্যমে খিলঞ্জিয়া বা ভূমিপুত্রদের স্বার্থ ১০০ শতাংশ সুরক্ষিত হবে। এই খিলঞ্জিয়া কারা? ভাষার ভিত্তিতে খিলঞ্জিয়া? না কি, ধর্মের ভিত্তিতে খিলঞ্জিয়া? বরাকের হিন্দুত্ববাদীরা প্রথমে ভেবেছিলেন, ধর্মের ভিত্তিতে খিলঞ্জিয়াদের ধরে তিনি ১০২টি আসনে জয়ী হওয়ার কথা বলছেন। আবার কিছু দিন আগে তিনি বললেন, অহমিয়ারা যেখানে ৭৫টির মতো আসন পায়, তা এ বারে ৯০-এর উপরে হবে, বরাক উপত্যকাকে বাদ দিয়েও। আর, অহমিয়াদের হাতে আগামী ২০ বছর শাসনক্ষমতা থাকবে। তার মানে, ধর্মের ভিত্তিতে খিলঞ্জিয়া তত্ত্বে বরাক নেই। আর, অসমের বাঙালিরা কি ভারতীয় নয়? সবাই বাংলাদেশি?
জনসংখ্যা আর জনসংখ্যার ঘনত্ব, দু’টি বিষয় এক নয়। অসমে যে ভাবে ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়াটি হল, তাতে কোনও জাতিগত-ভাষাগত বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বেশি জনসংখ্যার মানুষরা হয়তো কম আসন পাবেন, আর কম জনসংখ্যার মানুষরা বেশি আসন পাবেন। বিধানসভায় হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের সংখ্যা বেড়ে গেলেও, বাঙালি-অধ্যুষিত আসন কমল দু’টি। বরাক ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট-এর মুখ্য আহ্বায়ক জয়দীপ ভট্টাচার্য বলছিলেন, ২৪ অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টে শুনানির জন্য অপেক্ষা করছে তাঁর দল। সমস্যার সমাধান না হলে এই দল বরাক-পৃথকীকরণ করে পূর্বাচল রাজ্য তৈরির ডাক দেবে। অভিযোগ, বরাক উপত্যকায় দু’টি আসন কমে যাওয়া মানে হল, বরাক উপত্যকার উন্নতির জন্য পাওয়া তহবিলের পরিমাণ কমে যাওয়া।
১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি বা ইদানীং কালের এনআরসি বিধানসভায় মুসলমান প্রতিনিধিত্ব কমাতে পারেনি। এখন অসমে ৪০টি বিধানসভা আসনে বিধায়করা মুসলমান ধর্মাবলম্বী। আছেন খ্রিস্টানরাও। বর্তমান ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া এই সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারে, এমনই আশঙ্কা। ধর্মীয় বা ভাষাগত অক্ষে আসনসংখ্যার পরিবর্তন হলে আঞ্চলিক মিশ্র সংস্কৃতিও বিষম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেটাই কি কাঙ্ক্ষিত?