—প্রতীকী ছবি।
শিশুসন্তান খেতে চায় না, এ অভিযোগ কান না-পাতলেও শোনা যায় আর্থিক ভাবে সচ্ছল, বা ততখানি সচ্ছল নয় এমন পরিবারেও। ফলে, তাদের জোর করেই খাওয়ানো হয়। তার সহজতম আয়ুধ হল, শিশুটির হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেওয়া। এক-দেড় বছর বয়সি শিশু একদৃষ্টে দেখতে থাকে কখনও কার্টুন, কখনও অন্য কোনও ভিডিয়ো। ক্রমশ বাড়তে থাকে তার ফোনের মধ্যে ডুবে থাকা। শুধু খাওয়ানোর সময় নয়, শিশুকে সামলানোর পুরো দায়িত্বই নিয়ে নেয় সেই ফোন। বাইরের জগতের সঙ্গে শিশুটির সম্পর্ক ক্রমশ কমতে থাকে। ফোন সামনে থাকলে কারও ডাকে সে আর সাড়া দেয় না। শৈশবেই আসক্তির বেশ কিছু লক্ষণ ফুটে ওঠে শিশুর মধ্যে। ফোন হাতে না-পেলেই কাঁদে।
জন্মের পর থেকে তিন বছর বয়স পর্যন্ত শিশু তার পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে চার পাশের জগৎকে চিনতে, অনুভব করতে শেখে। এই সময়েই তার সঙ্গে থাকা মানুষজনের কথাবার্তা সে মন দিয়ে শোনে, কথার অর্থ নিজের মতো করে বুঝতে শেখে, অন্যদের ডাকে হাসির মাধ্যমে সাড়া দিতে শেখে, এর পর ধ্বনি থেকে একটু-একটু করে তার সামনে বারংবার উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্যে থেকে একটি দু’টি শব্দ বলতে শেখে, ধীরে ধীরে সে গোটা বাক্য বলতে শেখে। কোনও কারণে এই বয়ঃসীমার শিশু যদি বঞ্চিত হয় তার চার পাশের জগৎকে তার পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আবিষ্কারের সুযোগ থেকে এবং তার চার পাশের মানুষের সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ থেকে, সে ক্ষেত্রে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
বর্তমানে এই সমস্যা ক্রমশ গুরুতর আকার নিতে চলেছে। দেখা যাচ্ছে, আমাদের চার পাশের অনেক শিশুর ভাষার বিকাশ তার বয়সের সাপেক্ষে ঠিকমতো হচ্ছে না। শব্দ ও বাক্য যে বয়সে বলতে শেখার কথা, বহু শিশুই তা শিখছে না। অনেক ক্ষেত্রে কথা বলার সময় চোখে চোখ রেখে কথা বলছে না। কখনও কখনও এমন কিছু শব্দ উচ্চারণ করছে, যার অর্থ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই লক্ষণগুলো অনেকাংশে মিলে যায় ‘অটিজ়ম স্পেকট্রাম’ নামক অটিজ়মের বিস্তৃত পরিসরের মধ্যে কোনও এক বা একাধিক বিশেষ ধরনের সমস্যার সঙ্গে। যদিও, ক্লাসিক্যাল অটিজ়ম বলতে যা বোঝায়, তার সঙ্গে জিনের সম্পৃক্ততাই বেশি বলে মনে করা হয় বৈজ্ঞানিক চর্চার পরিসরে; এখানে উল্লিখিত লক্ষণগুলোর ক্ষেত্রে পরিবেশের ভূমিকাই মুখ্য। তবে একটা আশঙ্কা থেকে যায়, বংশগত বৈশিষ্ট্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকা জিন অনেক সময় পরিবেশগত কারণে প্রকাশ পায়। আমরা জানি না কোন শিশুর মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় আছে ‘অটিজ়ম স্পেকট্রাম’-এর কোনও প্রবণতা। সেই শিশুর পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রথম শৈশবে বাইরের জগতের সঙ্গে আদানপ্রদানের, সংযোগের, কথোপকথনের সুযোগ যদি না-ঘটে, তা হলে তার মধ্যে অন্য আর পাঁচ জন শিশুর তুলনায় অটিজ়ম স্পেকট্রাম ডিজ়অর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা হয়তো বেশিই থাকে।
সম্প্রতি এই সমস্যাটিকে কেউ কেউ ‘ভার্চুয়াল অটিজ়ম’ নামে উল্লেখ করছেন। সমস্যাটি সেই শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে, যারা প্রথম শৈশব থেকেই ডিজিটাল নানা সামগ্রীর মধ্যে অনেকটা সময় ডুবে থাকছে। এই সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ইশারা এবং হাবভাবের মাধ্যমেই সেরে নিতে চাইছে তার প্রয়োজনীয় কথাবার্তা। অবশ্য শিশুদের ইন্দ্রিয়-বিকাশের অন্তরায় হওয়ার ক্ষেত্রে খাওয়ানো অনুষঙ্গ ছাড়াও আরও বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশুর ইন্দ্রিয় ও সংবেদনের বিকাশ সম্পর্কে আমাদের অসচেতনতার ভূমিকা অনেকখানি। তবে আশার কথা, যে শিশুরা শৈশবের প্রথম পর্বে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে পারেনি, তারা যদি আবার সবার সঙ্গে মেলামেশার, কথোপকথনের পর্যাপ্ত সুযোগ পায়, তা হলে তাদের বেশির ভাগই সমস্যা কাটিয়ে উঠে প্রয়োজনীয় কুশলতা ফিরে পেতে পারে। এমন কিছু উদাহরণও চোখে পড়ছে।
বহু শিশুর মধ্যে অনেক সময় অস্থিরতা, অতিচঞ্চলতা দেখা দিতে শুরু করে। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারে না। কোনও কিছুতেই সে মনঃসংযোগ তেমন করতে পারে না। একটুতেই বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় তার মন। কেন? এক দিকে শিশুর প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যালরি-সম্পন্ন খাবার তাকে খাওয়ানোর ফলে তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে বিপুল এনার্জি, অন্য দিকে ডিজিটাল স্ক্রিনে দ্রুতগতিসম্পন্ন কার্টুন নেটওয়ার্ক বা ইউটিউব ভিডিয়ো কিংবা গেমস তার মধ্যে জাগিয়ে তুলছে অতিচঞ্চলতা। ফলে শিশুর মধ্যে অস্থিরতা ও অমনোযোগের সমস্যা দেখা দিচ্ছে বহু ক্ষেত্রে। এই অস্থিরতা ও অমনোযোগ সেই বয়সে তার যা কিছু শেখার কথা, সেই শেখার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছে।
এ-যাবৎ মানুষ যা কিছু সৃষ্টি করেছে, সবটাই কল্পনার ডানা মেলে। শিশুর জগৎ স্বভাবতই কল্পনাময়। সেই কল্পনার জগৎ কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের ডিজিটাল-নির্ভরতা। তা শিশুর কল্পনাকে সঙ্কুচিত করে, ভাবার অভ্যাস কমতে থাকে। শিশু যখন কল্পনা করতে ভুলে যাবে, তখন তার সৃষ্টিশীলতাও নিঃশেষ হয়ে আসবে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা তৃণমূল স্তরে কাজ করেন, তাঁদের অনেকের মনের মধ্যেই এই বিষয়ে নানাবিধ আশঙ্কার মেঘ জমছে।
মোবাইল ফোনের স্বেচ্ছা-কারাগার থেকে শিশুদের মুক্তি না-দিলে বিপদ তীব্রতর হবে।