দুরাশা: উচ্ছ্বসিত মতুয়া জনগণ, কলকাতা, ১১ মার্চ
অবশেষে ২০১৯ সালে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী (সিএএ) বলবৎ হল। শোনা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায়ের দাবি পূরণ করার জন্য লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার পূর্বক্ষণে বিশদ নিয়মাবলি প্রকাশ করে আইনের সংশোধনী চালু করা হয়েছে। এর ফলে, ভারতের নাগরিকত্ব চাইছেন এমন ব্যক্তি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের বিশেষ পোর্টালে অনলাইন দরখাস্ত জমা দিতে পারবেন। সিএএ চালু হওয়াতে স্বভাবতই মতুয়া সম্প্রদায়ের অনেকে আনন্দিত হয়েছেন। সেই সঙ্গে আবার নানা রকম ধোঁয়াশা আর বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তাই নতুন নিয়মগুলো ভাল করে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।
কী আছে এই নিয়মে? ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গে বাস করছেন, এমন মানুষদের ক্ষেত্রে যে নিয়মগুলো প্রযোজ্য, সেগুলোই এখানে আলোচনা করছি। আবেদন করতে হবে নাগরিকত্ব আইনের রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি অনুসারে। সেই নিয়মে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার দরখাস্তের সঙ্গে দুই রকম নথি জমা দিতে হবে। ১) ২০১৪ সালের আগে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের প্রমাণ। ২) ভারতে প্রবেশ এবং বসবাসের তারিখ সংক্রান্ত প্রমাণ।
প্রথমত, আবেদনকারী যে বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন, তার প্রমাণ হিসাবে দেওয়া যেতে পারে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের জারি করা জন্মের অথবা শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্র, কোনও সরকারি পরিচয়পত্র বা লাইসেন্স, জমির স্বত্বাধিকারের নথি অথবা ওই জাতীয় কোনও সরকারি দলিল। আবেদনকারীর পিতা-মাতা, তাঁদের পিতা-মাতা, অথবা তাঁদেরও পিতা-মাতা, অর্থাৎ পূর্বতন তিন পুরুষ পর্যন্ত কেউ বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানের নাগরিক ছিলেন, নথি-সহ এমন প্রমাণ দিলে সেটাও গ্রাহ্য হবে। কিন্তু ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ভারতে প্রবেশ করার আগে আবেদনকারী বা তাঁর পূর্বপুরুষ যে বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন, তার প্রমাণ অবশ্যই দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ভারতে প্রবেশ ও বসবাসের প্রমাণ। কারও যদি ভারতে আসার ভিসা অথবা রেসিডেন্স পারমিট থাকে, সেটা নথি হিসাবে গ্রাহ্য হবে। এমনকি ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই। কারণ, ধর্মে মুসলিম নন এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংশোধনী আইন অনুযায়ী তাঁকে বেআইনি অভিবাসী বলে গণ্য করা হবে না। এ ছাড়া রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, বিদ্যুৎ বিল, বিমা পলিসি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শংসাপত্র, আদালতের দলিল, ইত্যাদি যে কোনও সরকারি দলিল যাতে প্রমাণ হয় যে, আবেদনকারী ২০১৪ সালের আগে ভারতে এসেছেন এবং এখানে বসবাস করছেন, তা গ্রাহ্য হবে। বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে, এই দলিলের তালিকায় ভারতীয় পাসপোর্ট অথবা ভোটার কার্ড নেই, কারণ তা একমাত্র ভারতীয় নাগরিকের প্রাপ্য, অন্যদের নয়। এ ছাড়া আরও কয়েকটা দলিল জমা দিতে হবে, যেমন আবেদনকারীর ধর্ম কী, তিনি কোনও ভারতীয় ভাষা জানেন কি না, তার প্রমাণ। সে সব দলিল সংগ্রহ করা বিশেষ সমস্যার নয়, তাই তার বিশদ উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই।
অনলাইন দরখাস্ত করার পর তা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের তৈরি করা এক বিশেষ কমিটির কাছে। সেই কমিটি আবার জেলাস্তরে কমিটি বসাবে। আবেদনকারীকে সেই জেলা কমিটির সামনে হাজির হতে হবে তাঁর প্রমাণপত্র যাচাই করার জন্য। আবেদন আর আনুষঙ্গিক নথিপত্র দেখে সেই কমিটি স্থির করবে আবেদনকারীকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কি না।
এই হল রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি। প্রক্রিয়ার একটি মূল বিষয়ের দিকে কিন্তু যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়নি। অনলাইনে এমন ব্যক্তিই শুধু আবেদন করতে পারেন, যিনি বর্তমানে ভারতের নাগরিক নন। অর্থাৎ যিনি আফগানিস্তান, পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশের নাগরিক। আবেদনে (Form II-A) স্পষ্ট বিবৃতি দিয়ে আবেদনকারীকে বলতে হবে যে, তিনি এখন অন্য দেশের নাগরিক এবং ভারতের নাগরিকত্ব পেলে তিনি তাঁর বর্তমান নাগরিকত্ব ত্যাগ করবেন। এ জন্য ভারত রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের শপথবাক্যও পাঠ করতে হবে। এই পদ্ধতির পিছনে যুক্তিটা খুব সহজ। রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিতে ভারতের নাগরিকত্বের আবেদন করবেন কোনও বিদেশি নাগরিক। যিনি ইতিমধ্যেই ভারতের নাগরিক হিসাবে পরিচয় দিচ্ছেন, তিনি কেন নতুন করে নাগরিক হওয়ার আবেদন করবেন?
নাগরিকত্ব আইনের এই সহজ যুক্তিটা কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক তর্কবিতর্কের ভিতর দিয়ে ভয়ানক ভাবে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আসা নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষদের সমস্যাটা বোঝা কঠিন নয়। ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ একাধিক বার রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামাও হয়েছে। তার জেরে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা অনেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতে চলে এসেছেন। তাঁদের একটা বড় অংশ নমশূদ্র জাতির মানুষ, যাঁদের অনেকেই মতুয়া ধর্মগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা প্রধানত উত্তর চব্বিশ পরগনা আর নদিয়া জেলার শহর-আধাশহর অঞ্চলে বসবাস করে নানা জীবিকায় নিযুক্ত আছেন। তাঁদের অধিকাংশেরই এত দিনে ভারতীয় নাগরিকের প্রাপ্য সব রকম পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা হয়ে গেছে। শুধু রেশন কার্ড নয়, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড আছে। তাঁরা নিয়মিত ভারতের নির্বাচনে ভোট দেন। উচ্চশিক্ষা বা কাজের জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন হলে তাঁরা অনেকে ভারতের পাসপোর্ট পর্যন্ত করিয়েছেন। তবু তাঁদের অভিজ্ঞতা হল, তাঁদের নাগরিকত্ব সম্বন্ধে একটা সন্দেহ থেকে গেছে। সরকারি দফতর ইত্যাদিতে তাঁদের বহিরাগত বলে সন্দেহ করা হয়। ভারতীয় নাগরিক হিসাবে যে পরিষেবা তাঁদের প্রাপ্য, অনেক সময় তাঁরা সেটা পান না। উল্টে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সে জন্য তাঁরা এমন কোনও সরকারি পরিচয়পত্র চান, যাতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে যে তাঁরা ভারতের নাগরিক।
গত পাঁচ বছর ধরে তাঁদের বলা হয়েছিল, সিএএ বলবৎ হলে তাঁদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাঁদের অভিভাবকেরা এক বারও বলেননি যে, যাঁদের ভোটার কার্ড আছে, যাঁরা ভারতের নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন, তাঁরা ভারতের নাগরিক হওয়ার আবেদন করতে পারেন না। হয়তো তাঁরা সবটা না জেনে বলেছেন, যে ক্ষেত্রে তাঁদের বিষয়টা সঠিক ভাবে জেনে নেওয়া উচিত ছিল। অথবা তাঁরা জেনেবুঝে রাজনৈতিক স্বার্থে মানুষকে ভুল বুঝিয়েছেন। উভয় ক্ষেত্রেই মতুয়া সমাজের মানুষ প্রতারিত হয়েছেন। তাঁদের বলা হয়নি যে, ভোটার কার্ড থাকলে সিএএ প্রক্রিয়ায় ভারতীয় নাগরিকত্বের আবেদন করা যায় না।
ভোটার কার্ড যে আছে, সেই তথ্য গোপন রেখে নাগরিকত্বের আবেদন করলে বিপদ আছে। কারণ, আবেদন পরীক্ষার সময় ভোটার লিস্ট দেখে নাম-ঠিকানা মেলালেই দেখা যাবে যে, আবেদনকারী ইতিমধ্যেই ভারতের ভোটার হয়ে গেছেন। অর্থাৎ, এক দিকে তিনি নথি জমা দিয়ে বলছেন, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক, ভারতের নাগরিক হতে চান। অন্য দিকে, তিনি ভারতের নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন। তখন প্রশ্ন উঠবে, তিনি কি তা হলে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ভোটার কার্ড সংগ্রহ করেছেন?
সিএএ বলবৎ হওয়ার সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)-র সম্পর্ক আছে কি? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি বলেছেন, কোনও সম্পর্ক নেই, মিথ্যা প্রচার হচ্ছে। অথচ, চার-পাঁচ বছর আগে তিনি বার বার বলেছিলেন, সিএএ পাশ হল, এর পর সারা ভারতে এনআরসি প্রক্রিয়ায় বেআইনি বহিরাগতদের শনাক্ত করা হবে। এমনকি লোকসভায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, আগে সিএএ, তার পর এনআরসি, ‘ক্রোনোলজি সমঝ লিজিয়ে’। আমরা জানি, রাজনীতির নেতারা অবস্থা বুঝে তাঁদের বক্তব্য পাল্টে ফেলতে অত্যন্ত পটু। এই মুহূর্তে এনআরসি করে বিশেষ লাভ নেই। যে দিন লাভের সম্ভাবনা দেখা দেবে, সে দিন অবশ্যই এনআরসি-র ধুয়ো আবার উঠবে। তখন আবার জনে জনে বলা হবে, তুমি যে বাংলাদেশের নাগরিক নও, প্রমাণ করো। তাই আজ বিদেশি নাগরিক হিসাবে অনলাইন দরখাস্ত করার আগে বিশেষ ভাবে সাবধান হওয়া দরকার।