অমৃত: লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে সলিল চৌধুরী। কলকাতা, ১৯৮১
গতকালই ছিল সলিল চৌধুরীর জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে বলার মতো কথা ফুরোনোর নয়— তাঁর রাজনীতি, তাঁর কবিতা, গানের সুর, কথা, মানুষ সলিল চৌধুরী, অনেক কথা বলা যায় অনেক কিছু নিয়েই। অথবা, সব কথা আসলে গাঁথা থাকে একটি গুচ্ছে— তাঁর যে দিক নিয়েই কথা বলি, বলতে হবে সবটুকু নিয়েই। সলিল চৌধুরীর গান মানে যেমন শুধু কোনও একটা গান নয়, এক সঙ্গে অনেক ছোট ছোট গানের ঠাসবুনটে তৈরি এক অপূর্ব বিশাল সমাবেশ। যেন একটা বিরাট রঙিন কার্পেট, যা বাইরে থেকে দেখে একক মনে হলেও আসলে তার মধ্যে থাকে অজস্র রঙের সুতোর সূক্ষ্ম নকশা।
ভারতীয় সঙ্গীতে ওয়েস্টার্ন মিউজ়িকের ব্যবহার আগেও ছিল। সলিল ভারতীয় সঙ্গীতের ন্যারেটিভে জুড়লেন ওয়েস্টার্ন হারমনি, কয়্যার অর্কেস্ট্রা— এবং, এমন ভাবে জুড়লেন, যাতে তা বিদেশি হয়েও হয়ে উঠল দেশীয় গানের ও দেশজ কানের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুকূল। পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে তিনি ভারতীয় আত্মায় শামিল করলেন। একটা গানের কথা বলি: ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’। গানটা শুরু হয় একটা তিন মাত্রা ছন্দে। যেন উজ্জ্বল এক ঝাঁক তরুণতরুণী সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, তারা এসে দাঁড়াচ্ছে একটা পথের বাঁকে কোনও জলপ্রপাতের সামনে— জলপ্রপাতের মতোই গানের প্রিলিউড বাজতে থাকে স গ র স ধ নি, স গ র স ধ নি। তার পর গান শুরু হয়, এবং তা শুরু হয় চার মাত্রায়। এই যে একটা তিন মাত্রার ছন্দকে বিন্দুমাত্র ঝাঁকুনি ছাড়াই চার মাত্রায় মিলিয়ে দেওয়া, এটা শুধুমাত্র করব বললেই করে ফেলা যায় না— এই তরঙ্গ মাথায় চলতে থাকে অবিরাম, তবেই আসে এই সুর। এ ভাবেই এগোতে এগোতে ঝাঁকুনিটা আসে অন্তরায়, যেন ওই যে যারা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, তারা কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মনে এই বিশ্বাস নিয়ে ফের চলা শুরু করল যে, এক দিন এই প্রান্তর তারা পেরিয়ে যাবেই। যদি গানগুলো আর এক বার শুনে নেন, আরও স্পষ্ট ধরা যাবে সলিলের ম্যাজিক।
হিন্দিতে এই সুরই ব্যবহার করা হয়েছে আনন্দ ছবিতে, সেখানে কিন্তু আলাদা প্রিলিউড ইন্টারলিউড ব্যবহার করা হয়েছে। হয়তো খানিক বিষণ্ণ সুরে, কিন্তু এ গানও এক জীবনের কথা বলে। এই যে একটা গানের গায়ে জড়িয়ে থাকা এই সব ছোট ছোট গান, এগুলোকে বাদ দিলে মূল গানটি একক ভাবে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় না। আনন্দ ছবিরই অন্য একটি গান— জ়িন্দেগি, ক্যায়সি হ্যায় পহেলি— তার শুরুতে একটা ট্রাম্পেট বেজে ওঠে। এই ট্রাম্পেট জয়ের, এই ট্রাম্পেটে বাজে জীবনের সব লড়াইয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের সুর। এ ট্রাম্পেট বলে যে, বেঁচে থাকাটাই আসল। ছ’মাত্রার একটা সুইং দিয়ে গান শুরু হয়, তার পর তাতে আসে ক্যাথিড্রাল কয়্যার। এই কয়্যার যাঁরা গেয়েছেন, তাঁরা এক সময় চার্চে মাস গাইতেন। সলিল তাঁদের নিয়ে এলেন সিনেমার গানে। সলিলের আগেও ক্যাথিড্রাল কয়্যার ব্যবহৃত হয়েছে— কিন্তু তিনি যে ভাবে ব্যবহার করেছেন, সে ভাবে হয়নি। আর একটা গানের কথা বলি। ছোটি সি বাত ছবির ‘না জানে কিঁউ’। এই গান কি শুধুই ভারতীয়? না কি, দুনিয়ার যেখানেই যখন কেউ প্রেম হারায়, এই গান, এই সুর বেজে ওঠে? ক্যাথিড্রাল কয়্যার এখানে এসেছে অন্য ভাবে। সোপ্রানোর সুরে মিলেমিশে যায় আরব সাগরের সঙ্গে অতলান্তিক, প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে সুয়েজ— সারা পৃথিবীর প্রেম কথা বলে এই গানে। এ ভাবেই তিনি ভারতের সুরে মিলিয়ে দিয়েছেন বিশ্বকে, ভারতকে করে তুলেছেন বিশ্বজনীন ।
‘কেন কিছু কথা বলো না’ গানটির কী অসামান্য একটা প্রিলিউড! অসামান্য বেহালা, পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান এবং বাঁশির সুরে যেটা বেজে ওঠে, তার সমতুল্য কিছু আজ অবধি আর কোথাও খুঁজে পাইনি। প্রিলিউডে যেন একটা কথোপকথন চলে— ছোট ছোট সংলাপের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়ে তা শ্রোতাকে গানের লাইনে পৌঁছে দেয়। তার পরে একটা ‘জয়েনিং মিউজ়িক’ বা একটা ছোট ফিলার। এই যে একটা গানের গা থেকে চুইয়ে পড়ে আরও একটা গান, সেগুলোর ভূমিকা মূল গানের থেকে কোনও অংশে কম নয়, এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। এরই অন্তরায় বাজে বিভিন্ন মেজর মাইনরের কম্বিনেশন, তৈরি হয় এক অদ্ভুত প্রেমের সংলাপ। এই সংলাপ আমাদের পৌঁছে দেয় গানের কথায়। গান, এবং গান গাওয়া যে কত রকমের হতে পারে, তার আরও একটা উদাহরণ রজনীগন্ধা ছবির ‘রজনীগন্ধা ফুল তুমহারে’। কী নরম একটা সুরে হালকা ভাবে হাস্কি আওয়াজে গানটি গাওয়ানো হয়েছে। অপূর্ব সব হারমনির প্রোগ্রেশন শুনে যখন এর ইন্টারলিউডে আসি, তখন যেন কী শান্তি, কী মুক্তি! কী অপূর্ব সেতারের কাছে এই সমর্পণ! সেতারের মিড়ে যেন বাঁধা পড়ে যায় এই উপমহাদেশের সমস্ত আবেগ, সব ভালবাসা।
তবে কি শুধু ক্যাথিড্রাল কয়্যারই ব্যবহার করলেন সলিল? না, ভারতীয় কয়্যারের ব্যবহারও আছে ঠিক প্রয়োজন মতো। ‘জাগো মোহন প্রীতম’ বা ‘পথে এ বার নামো সাথী’-তে দেখতে পাই তার প্রয়োগ। ‘পথে এ বার নামো সাথী’-তে ‘মনোরথের ঠিকানা’র ঠিক পরেই যেখানে কয়্যারের ব্যবহার, তাতে যেন একটা শঙ্কা, একটা ভয়মিশ্রিত আশা দেখি যে, এ সময় ভাল নয়, তবু মানুষ উঠে দাঁড়াবেই, মানুষ মানুষের হাত ধরবেই। এখানে দাঁড়িয়ে সুর আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে যায় বেঠোভেনের সেই অব্যর্থ ডিমিনিশড ফিফথ সিম্ফনির কথা, যেখানে শুদ্ধ সা, কোমল গান্ধার, কড়ি মধ্যম এবং শুদ্ধ ধৈবতের ব্যবহার ঝলসে ওঠে— এ সেই সুর যা বেঠোভেনকে মহান করেছিল। তারই নির্যাস তিনি তাঁর মতো করে আনলেন ‘পথে এ বার নামো সাথী’ গানে। আদতে কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও মিল নেই— মিল যেটুকু, তা একেবারেই ভাবনার, এই সুরের মধ্যে দিয়ে সলিল চৌধুরী যেন সমস্ত ভারতবর্ষের হয়ে বেঠোভেনকে স্যালুট করলেন।
তেমনই আর একটি গান ‘শোনো কোনও এক দিন’। এই গানটিতে দেখি এক অদ্ভুত এগিয়ে যাওয়া। প্রতি বার নতুন সুর থেকে শুরু হয়। কখনও ‘রে’ হয়ে যায় ‘সা’, কখনও ‘গা’ হয়ে যায় ‘সা’। এ ভাবে গান এগিয়ে চলে, কিন্তু কখনওই আর প্রথম স্বরে ফিরে আসে না— প্রতিটা বাঁকে বদলে বদলে যায় জীবন, সুরের মাঝে মাঝে জন্মান্তর উঁকি দিয়ে যায় বটে, কিন্তু তাকে আর দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। যেখানে সুর দাঁড়ায়, সেখান থেকেই শুরু হয় আবার নতুন করে পথ চলা আর একটা নতুন জীবন। ‘মন হারাল হারাল মন হারাল’ যেন স্মৃতির আবেশ মাখা এক সুর, কিন্তু তাতে নেই পিছনে ফিরে তাকানো।
‘কি যে করি, দূরে যেতে হয়’ গানটির কথা ভাবুন। এর স্থায়ীর শেষে যেই অনন্ত বিরহী কোমল নি গেয়ে ওঠেন লতা, কী অসম্ভব একরাশ মনখারাপ বয়ে নিয়ে আসে সুর। কিন্তু তার ঠিক পরেই আবার শুরু হয়, এক নতুন শুরু। নদী হঠাৎ একটা বাঁক নেয়, আর ঝমঝমিয়ে বেজে ওঠে একটা অর্কেস্ট্রাল স্কোর। কত রকমের ওঠা-পড়া। মেজর, মাইনর এবং তার প্রত্যেক ছত্রে যেন নতুন গতির সঞ্চার হয়। সেখানে যেন প্রেমের সঙ্গে মোকাবিলা চলে প্রেমিকের। প্রেম নিজের সবটুকু অধিকার নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পথ আটকায়, যেন বলে— বললেই হল, চলে যাবে? কিন্তু তবু সেই প্রেমিক যখন চলেই যায়, তখন প্রেমের সামনে থাকে অন্তহীন অবাধ এক নদীপথ। অন্তরার কথা যত ক্ষণে ‘কখনও সঘন বাদলের পরে’ পেরিয়ে ‘প্রেমলিপি লিখি বিজলি আখরে’তে এসে পৌঁছেছে। শ্রোতার সেই দুরন্ত গতিপথ কখনও অজানতে বদলে গেছে। সে সব তখন ধূসর অতীত।
সলিলের গানে প্রিলিউড আর ইন্টারলিউডের খেলা ছাড়াও আর একটা বৈশিষ্ট্য আছে— ওঁর সুরে মাঝেমাঝেই উঁকি দিত স্বর আর সুরের আশ্চর্য আলোআঁধারির খেলা। যেমন ‘রানার’ গানটিতে অবলিগেটো। গানের সুরে মধ্যেই যেন তার অবলিগেটো তৈরি হয়ে আছে— তা-ই রানারের সমস্ত বিপন্নতা লক্ষ করে আলো জ্বেলে রাখে। যদিও এ পাশ্চাত্য সঙ্গীত থেকেই শেখা, কিন্তু ঠিক কতটা নিলে তা ভারতীয় প্রাণকে আলোড়িত করতে পারে, তা তিনি জানতেন। এবং তার ফলেই তাঁর এই সব গান কখনও নগরের রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকে না, সে দিব্যি গিয়ে বসে প্রান্তিক মানুষের কানে-মনে। যেমন, ‘পথে এ বার নামো সাথী’র ইন্টারলিউডে সেই হারমনিক কোরাস! হারমনি নিয়েই আর একটি গান ‘সুরের এই ঝর ঝর ঝরনা’।
এই সলিল চৌধুরীরই ষাটের দশকে ক্লাসিক্যাল এপিক থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে গিয়ে হাত রাখলেন এক সদ্য ফুটন্ত লাভার আঁচে। সাদরে গ্রহণ করলেন জ্যাজ় আর ব্লুজ়কে, যা তার জন্য নতুন পথ নির্মাণ করল। তৈরি হল পুরোপুরি জ্যাজ়নির্ভর গান ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও!’ এ একেবারে ইম্প্রোভাইজ়ড মিউজ়িক, এখানে ভোকাল হারমনি ব্যবহার হচ্ছে সম্পূর্ণ জ্যাজ়-এর স্ক্যাটিং-এ, এবং হারমনিক প্রোগ্রেশান পুরো পাল্টে গেছে। এ গানের কথায় দেখি যে, আসলে পৃথিবী নামক এই গ্রহটা থেকেই বেরিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আসলে এ তো বিদ্রোহেরই গান! বিদ্রোহ যে পুরনোকে থামাতেই চায়! বলে, আমি এসেছি! আমাকে নাও!
সলিল চৌধুরীর গানের স্রেফ প্রিলিউড আর ইন্টারলিউড জুড়ে নিয়েই একটি স্বতন্ত্র সিম্ফনি রচনা করতে পারেন ভবিষ্যতের কোনও সঙ্গীতকার। তা যদি কোনও দিন সত্যিই ঘটে, তা হলে সে দিন হারমনি, কাউন্টার পয়েন্টস, পাশ্চাত্য ধ্রুপদী, জ্যাজ়, ব্লুজ়, আর দেশীয় সঙ্গীতের শক্তি নিয়ে আমরা দাঁড়াতে পারব এক অপার বিস্ময়ের মোহনায়। ভবিষ্যৎ কান পেতে রইল সেই জলোচ্ছ্বাসের শব্দ শোনার জন্য।