শাহরুখ খানের জওয়ান সিনেমাটির পোস্টার। —ফাইল চিত্র।
দেশ, জাতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনায় অন্যতম পণ্ডিত বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন দেখিয়েছেন, জাতির ভাবনা কতটাই কল্পিত, ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’। এক রকমের জাতীয়তাবাদ এক-এক কল্পনাকে দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী নাগরিকের মনে গেঁথে দিতে চায়। হাল আমলে আমাদের দেশে এমন কল্পনা প্রোথিত করার বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া। বিশেষ করে, গত ছ’-সাত বছরে সমাজমাধ্যমের বিস্তার, প্রভাব, তার উপরে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক দলের তাকে ব্যবহার করার প্রবণতা— সবই বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সমাজমাধ্যমেই বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর দেখা গেল শাহরুখ খানের জওয়ান (ছবিতে সিনেমাটির পোস্টার) বয়কট করার ডাক।
কারণ হিসাবে বলা হল, প্রথমত, তামিলনাড়ুতে ছবিটির বিপণনের দায়িত্বে রয়েছে মন্ত্রী উদয়নিধি স্ট্যালিনের সংস্থা। যে উদয়নিধি স্ট্যালিন সম্প্রতি ‘সনাতন ধর্ম’ নিয়ে তাঁর মন্তব্যের জেরে বিজেপি শিবিরের আক্রমণের মুখে পড়েছেন, তবে পিছু হটেননি। আরও একটি বিষয় তুলে এই বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। তার কেন্দ্রেও ছিল সেই ধর্ম-ই। তা হল, ছবির অভিনেতা শাহরুখ খান মুসলিম হয়েও মেয়ে সুহানাকে নিয়ে তিরুপতিতে হিন্দু মন্দিরে গিয়েছিলেন।
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা উপাদান তুলে এ ভাবে ছবি বয়কটের ডাকের সঙ্গে গত কয়েক বছরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে বলিউড। খুব জোরালো গলায় তেমন প্রতিবাদও উঠে আসেনি। কারণ, এই বয়কট-হুঙ্কারের সঙ্গে কখনও প্রচ্ছন্ন, কখনও প্রকাশ্যে জুড়ে থেকেছেন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা।
রাজনীতির এমন বিভাজনের ফলে যে বিশাল বলিউড অর্থনীতির আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে, তাও অনেকে মেনেছেন। তবে ফল কিছু হয়নি। বরং নেশা-মাদক ইত্যাদি নানা অভিযোগ তুলে পুরো বলিউড যাপনকেই কলুষিত করার চেষ্টা হয়েছে। পরে সে সব অনেক অভিযোগের সারবত্তা না মিললেও যে উদ্দেশ্যে তা করা হয়েছিল, তা হাসিল হয়ে গিয়েছিল। তা হল, বলিউডের বহুত্ববাদকে তথাকথিত ‘অসনাতনি’ বলে দাগিয়ে দিয়ে সেই স্বরকে কোণঠাসা করে ফেলা। কেবল বিবৃতি নয়, এই লড়াইকে মোকাবিলা করা যেত কাজের মধ্য দিয়েও। বলিউড তার ছবির মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সেই প্রশ্ন তুলতে পারত। কিন্তু গত কয়েক বছরে যেমন জাতীয়তাবাদ শাসক চায়, তারই বর্ধিত বয়ান হিসাবে অধিকাংশ মূলস্রোতের বলিউড ছবি তৈরি হয়েছে।
এই প্রাতিষ্ঠানিক অপরায়ণের পরিকল্পনাকে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন ছিল বড়সড় অর্থনৈতিক সাফল্যের। বছরের গোড়ায় পঠান শাহরুখ খানকে সেই সাফল্য দিয়েছিল। সেই সাফল্য যে চলছে, তা অঙ্কই প্রমাণ করছে। সেই অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই জওয়ান নিয়ে এলেন শাহরুখ। বয়কট-ডাক পঠান-এও পাত্তা পায়নি। এ বারও হেলায় উড়িয়ে হিন্দি ছবির ইতিহাসে প্রথম দিনে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করে ফেলেছে জওয়ান।
শাহরুখের এই আত্মবিশ্বাসের প্রদর্শনটা প্রয়োজনীয় ছিল। দেশের এক নম্বর চিত্রতারকা, যিনি ধর্মে মুসলিম। হ্যাঁ, মহাতারকার ধর্ম এখানে গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখ্য। কারণ, এই পরিচয় তাঁকে দু’দিক দিয়েই আক্রমণ করেছে। এক দিকে, তাঁর ধর্মপরিচয় উল্লেখ করে বার বার নানা ঘটনায় তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে। যেমন, লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্যে তাঁর ‘দুয়া’ করার ছবি ব্যবহার করে মিথ্যে প্রচার চলেছে তিনি থুতু ছেটাচ্ছেন বলে। অন্য দিকে, দেশ জুড়ে এনআরসি-সিএএ আন্দোলনের সময় যে উদ্বিগ্ন সংখ্যালঘু সমাজকে দেখা গিয়েছিল প্রতিবাদে, তাঁদের সমর্থনেও তিনি নিজে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি হয়েও কিছু বলেননি বলে বিরোধী শিবির থেকে কটাক্ষ এসেছে।
অবশেষে শাহরুখ বললেন। বললেন সেই ভাষায়, যে ভাষা বলতে তিনি সবচেয়ে ভাল পারেন। বললেন সেই পরিসরে, যে পরিসর এই দ্বেষ-দীর্ণ মানচিত্রে তাঁর তৈরি করা দেশ। তাঁর অগুনতি ভক্তরা ভালবাসা দিয়ে গড়ে তুলেছেন সেই ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’। জওয়ান-এর সেই দেশে শাহরুখ প্রশ্ন তুলেছেন কৃষক আত্মহত্যা নিয়ে, ঋণখেলাপি ধনকুবেরদের প্রতি ব্যাঙ্কের মনোভাব আর গরিব চাষির প্রতি মনোভাবে বৈষম্য নিয়ে। পর্দায় অক্সিজেনের অভাবে শিশুমৃত্যুর পরে মিথ্যে অভিযোগে চিকিৎসকেরই গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা দেখিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন ঘটে যাওয়া বাস্তবকে। জাতপাত-ধর্মের ভিত্তিতে ভোট না দিয়ে প্রশ্ন করে অধিকার বুঝে নেওয়ার কথা বলে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন।
বলতে হতই। কারণ, সিনেমাকে যখন রাষ্ট্রের রাজনীতির অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়, তখন সেই ভাষাতেই জবাব না দিয়ে উপায় নেই।