International Kolkata Book Fair 2024

বই তো ছুতো, আমাকে দেখুন

লেখার আগেই সে লেখক হয়ে গেছে ধরে নিয়ে, চেয়ে বসে বরণমালা আর অ্যাওয়ার্ড-ডালা। সেই সম্মাননা-সভার নাম কী? সোশ্যাল মিডিয়া।

Advertisement

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:১২
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

বইমেলা মুড়োল, কিন্তু মন জুড়োল কি? লেখকের মন, বিশেষত এই সময়ের লেখকের— বিষম বস্তু। লেখার আগেই সে লেখক হয়ে গেছে ধরে নিয়ে, চেয়ে বসে বরণমালা আর অ্যাওয়ার্ড-ডালা। সেই সম্মাননা-সভার নাম কী? সোশ্যাল মিডিয়া। বইমেলা এগিয়ে আসতে-আসতে, এবং চলাকালীনও, সেই সভায় মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ ঘটছিল বিজ্ঞাপনের। যত না বইয়ের বিজ্ঞাপন, তারও বেশি লেখকের নিজের। বই তো ছুতো, পুরোটাই ‘আমাকে দেখুন’-এর মেলা।

Advertisement

শুরুটা হয় বই দিয়েই। বই প্রকাশ করছেন প্রকাশক, লেখকের নতুন বইটির খবর সবার আগে তাঁরই জানানোর কথা। কিন্তু এখন অ-স্বাভাবিক সময়, লেখকমাত্রেই অ-সাধারণ, তাই তিনিই ঢাক পেটাবেন সবার আগে, প্রকাশকেরও আগে। প্রকাশককে আর ক’জন চেনেন, লেখকই তো সব। তাঁর একটি কমেন্টে লিখলে দু’শো বত্রিশ ‘লাভ’, একশো তিরাশি ‘কেয়ার’, অজস্র লাইক (কিছু ‘হাহা’ও আছে, ও-সব থাকেই, ঈর্ষা, ঈর্ষা!)। এ-হেন লেখক নিজের বই সম্পর্কে ‘একটু’ লিখবেন না, হয়? তাও তো বইমেলা বলে প্রিবুকিং-এর ব্যাপার নেই, নয়তো এই এক পোস্টেই এক এডিশন ফুরিয়ে যেত (প্রিন্ট অন ডিমান্ডে এক এডিশন মানে কত কপি ছাপা হয়েছিল ও-সব প্রশ্ন করিয়া লজ্জা দিবেন না)।

বই নিয়ে, তার বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা হলে, এবং এক বার তা জানানোর পর ক্ষান্ত দিলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু বইমেলার সময় কিছু লেখক নিউজ় চ্যানেলের স্ক্রোল-লাইনের মতো হয়ে যান। অষ্টপ্রহর ‘খবর’ দিয়ে যাচ্ছেন: এই বই আমায় নিংড়ে নিয়েছে, এমন বই আমি আগে লিখিনি। এটি আমার শ্রেষ্ঠ বই। অমুক স্টলে এল। তমুক স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। আজ ফুরিয়ে গেল, যাঁরা গিয়ে পাননি, খুব দুঃখিত। আজ এসে গেছে, প্লিজ় আসুন। আজ বইমেলায় অমুক স্টলে অমুক সময়, তরশু তমুক স্টলে তমুক সময় থাকছি। আমায় নইলে হে পাঠকেশ্বর, তোমার ষোলো আনাই মিছে।

Advertisement

এই আত্মদম্ভের যজ্ঞে পাঠকেরাও জুগিয়ে যান গদগদ ঘি। ফেসবুকে আকুতিভরা পোস্ট: আজ বইমেলায় কোন কোন লেখককে পাব, জানাবেন? শুধু আপনাকে দেখব বলে একটি বার মেলায় আসব, কোন কলমে এমন ভূতের গল্প লেখেন? প্রকাশক বা বিক্রেতাদের অত সময় থাকে না, চিন্তা থাকে, বই বিক্রির, ব্যবসার, লগ্নি ও লাভের চিন্তা। তাঁরা তাই সোনার ডিম পাড়া হাঁসটির, মানে লক্ষ্মী লেখকের স্টলে উপস্থিতির বিজ্ঞাপন করেন জমিয়ে, ওতেই কেল্লা ফতে। বাকি কাজ তো হাঁস আর তার ছানারাই দায়িত্ব নিয়ে করে দিচ্ছে, অনন্ত প্যাঁকপ্যাঁক।

বাঙালি লেখক কী ছিলেন আর কী হয়েছেন সেই হা-হুতাশে লাভ নেই। এই লেখকেরা বলবেন, কী হয়েছে একটু ঢাক পেটালে? বই নিয়েই তো বলছি, খারাপ কিছু নিয়ে তো নয়। কিংবা, যে কথাটা এর গায়ে গায়ে আসে: একটু-আধটু না করলে চলে না, যুগটাই বিজ্ঞাপনের। আর একটু আগ্রাসী যাঁরা তাঁদের মত: পুঁজিবাদে সব পণ্য, বইও— তা বিকোনোর ব্যবস্থা করব না? বেশ করেছি। কেউ কেউ টেনে আনেন জাতিচরিত্রের প্রশ্ন: এই মুখচোরা বলেই বাঙালি লেখকের কিছু হল না, কেউ চিনল না, আর একটাও নোবেল এল না ইত্যাদি।

বইমেলার সময়টাকে যদি একটা আয়না ভাবা যেত, আর এই লেখকেরা যদি সত্যি তার সামনেটায় গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস করতেন, তা হলে দেখতে পেতেন নিজেদের অতল দৈন্য ও দ্বিচারিতাকে, প্রতিযুক্তির ছলে যুগপ্রবণতার অজুহাত আর সাফাই গাওয়ার স্বভাবকে। যে স্বভাব অস্বাভাবিককে স্বাভাবিক বলছেই না শুধু, স্বাভাবিক করে তুলছে নিজ দায়িত্বে। যে স্বভাব বুঝছে না (কিংবা বুঝছে ঠিকই, আসলে সেয়ানা), রামমন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে মেতে ওঠা লোকের পর দিন ‘নেতাজি লহ প্রণাম’ বলে ফেসবুকে দণ্ডবৎ হওয়া যেমন ভণ্ডামির চরমসীমা, ঠিক তেমনই এক দিকে ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ উদ্ধৃত করা আর অন্য দিকে নিজেই আত্মবিজ্ঞাপন-পরাকাষ্ঠা হয়ে ওঠাটা কুৎসিততম শেষ কথা। আনখশির ‘আমাকে দেখুন’-এর অবতার হয়ে আপনি জীবনানন্দের জন্মদিনে ‘নির্জনতম কবি’ বলে হু-হু পোস্ট দিতে পারেন না। মানে, দিতেই পারেন, তবে যেটুকু কলম ধরেছেন আজ পর্যন্ত, তার সামগ্রিক অসারতা হাট হয়ে পড়ার মূল্যে।

বইমেলা, থুড়ি চোদ্দো দিনের ‘আমাকে দেখুন’ মেলা তো শেষ। এ বার? পরের বইটি, থুড়ি, ফোলানো-ফাঁপানো গর্ব-বেলুনের পরবর্তী প্রিবুকিং-আইডিয়া ভাবা শুরু হোক জমিয়ে। এখনই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement