সাম্য?: নারী শক্তি বন্দন অধিনিয়ম কার্যক্রমে বিজেপি সমর্থকরা, নয়াদিল্লি, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। পিটিআই ছবি: পিটিআই।
লোকসভা ও রাজ্যসভায় ঐতিহাসিক মহিলা আসন সংরক্ষণ বিল (নারী শক্তি বন্দন অধিনিয়ম) প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয়েছে, প্রথম প্রচেষ্টার ২৭ বছর পর। ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে প্রায় তিন দশক ধরে বিগত বেশ কয়েকটি মন্ত্রিসভায় এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, বিতর্ক চলেছে। অবশেষে বর্তমান মন্ত্রিসভা প্রস্তাবিত এই অধিনিয়মে ঐতিহাসিক সিলমোহর লাগল ২০২৩-এর সেপ্টেম্বরে, লোকসভা ও রাজ্যসভার বিশেষ অধিবেশনে। এ বার বিধানসভাগুলির এই ঐতিহাসিক অধিনিয়মে ভাগীদার হওয়ার পালা। তবে কিছু ধোঁয়াশা রয়েই গেল। এক, এই সংরক্ষণের মধ্যে জাতিগত সংরক্ষণের দাবি ও সে বিষয়ে নীরবতা। দুই, এই সংরক্ষণ কবে বাস্তবায়িত হবে, সে নিয়ে সংশয়। বিভিন্ন অঙ্কের হিসাব বলছে ২০৩৪ বা ২০৩৯ সালের আগে নয়। তা হলে এই সামাজিক সাম্যের প্রচেষ্টাকে দিনের আলো দেখতে আরও ১০ থেকে ১৫ বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে।
প্রায় সর্বসম্মতিতে স্বীকৃত হলেও এই অধিনিয়মটির নাম নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন কিছু মহিলা সাংসদ। বিলটির ‘নারী শক্তি বন্দন’ কথাটির মধ্যেই যেন লুকিয়ে রয়েছে এক শক্তিমান তন্ত্রের নারীজাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আড়ালে আসলে তাদের প্রতি দাক্ষিণ্য বিতরণের চিরাচরিত আত্মশ্লাঘার প্রকাশ। অধিনিয়মের এই পোশাকি পরিচয়ে প্রকৃত সামাজিক সাম্যের বদলে রয়ে গিয়েছে এক অন্তর্লীন করুণা জাহির করার প্রবণতা। একটু পিছন ফিরে দেখার কৌতূহল হয়। প্রশ্ন জাগে, ১৯৫০ সালে গৃহীত স্বাধীন ভারতের সংবিধানে নারী সশক্তিকরণের এই বিষয়টি কেন স্থান পায়নি, কেন ৪৬ বছর অপেক্ষায় থাকতে হল? ১৯৩২ সালেই তো লোথিয়ান কমিটি ২%-৫% মহিলা আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব এনেছিল, ১৯৩৫ সালে এই মর্মে একটি অধিনিয়মও অনুমোদিত হয়। স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণেতারা কেন তাকে উপেক্ষা করলেন? সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সালের গণপরিষদের ১৫ জন বিখ্যাত মহিলা সদস্যের কিছু নথিভুক্ত করা বক্তব্য এই বিষয়ে অনেকটাই আলোকপাত করবে।
গণপরিষদের ১৮ জুলাই ১৯৪৭-এর অধিবেশনে রেণুকা রায় বলেছিলেন, দেশে নারীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার সময় থেকেই নারীরা নীতিগত ভাবে নিজেদের জন্য যে কোনও বিশেষ অধিকার বা সংরক্ষণের তীব্র বিরোধিতা করে এসেছেন। মহিলাদের জন্য লোথিয়ান কমিশন প্রস্তাবিত নির্বাচনী আসন সংরক্ষণ অধিনিয়ম অনুমোদিত হওয়ার আগের প্রায় দু’বছর সমস্ত আলোচনায়, বিতর্কে ভারতীয় নারীদের প্রতিনিধিরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা মহিলাদের জন্য কোনও রকম নির্বাচনী সংরক্ষণ বা কোনও বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিরোধী। জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি-র আলোচনা সভায় আমাদের প্রতিনিধি তিন মহিলা সদস্যই (রাজকুমারী অমৃত কউর-সহ) তাঁদের বক্তব্যে স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। বলেছেন যে, তাঁরা মেয়েদের জন্য যে কোনও রকম সংরক্ষণের বিপক্ষে। কিন্তু সমস্ত রকম বিরোধিতা সত্ত্বেও, তাঁদের ইচ্ছা ও যুক্তিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ১৯৩৫-এ মহিলা আসন সংরক্ষণ অধিনিয়ম অনুমোদিত হয়েছে। মহিলাদের মধ্যে তীব্র মতভেদ তৈরির বড় কারণ এই অধিনিয়ম। এটিকে কেন্দ্র করে দেশ দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে।
বেগম আইজ়াজ় রসুল ৮ নভেম্বর ১৯৪৮-র অধিবেশনে বলেন, মৌলিক নাগরিক অধিকারগুলি এমনই হওয়া উচিত যে, সেগুলিকে যেন কোনও সংরক্ষণ বা আইনসভার কোনও অধিনিয়মের আওতায় এনে বদলে না দেওয়া যায়। আবার ২৫ মে ১৯৪৯-এর অধিবেশনে বলেন, তাঁর মতে যে কোনও সংরক্ষণের বিশেষ সুবিধা এক আত্মঘাতী প্রক্রিয়া, তা সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে এক স্থায়ী বিভেদের রেখা টেনে দেয়। এর ফলে সংখ্যালঘুদের কাছে অন্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ থাকে না।
স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও রাজধানী দিল্লিতে এমস-এর রূপায়ণের অন্যতম স্থপতি রাজকুমারী অমৃত কউর বলেছিলেন, আপাত ভাবে যে মানুষগুলির সশক্তিকরণ রাষ্ট্রের লক্ষ্য, বাস্তবে এই ব্যবস্থা তাদের আরও বিচ্ছিন্ন, দুর্বল করে তুলবে। গণপরিষদের ১৫ জন বিদুষী সদস্যাই নারী-পুরুষের সমান অধিকার এবং সমাজজীবনে সমান্তরাল অংশগ্রহণের খুবই সক্রিয় প্রবক্তা হলেও নৈতিক ভাবে নারী বা সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ সুবিধা ও সংরক্ষণের বিরোধী ছিলেন।
সামাজিক সাম্য গড়ে ওঠে তিনটি ক্রমপর্যায়ে। সশক্তিকরণ, সমান নাগরিক অধিকার এবং সমান সামাজিক অবস্থান। তৃতীয়টি যে কোনও নাগরিকের অভিপ্রেত, যে কোনও রাষ্ট্রের লক্ষ্য। তবে ‘সশক্তিকরণ’ শব্দটির মধ্যেই একটি সামাজিক অসাম্যের বার্তা থাকে। তা হল একটি শ্রেণিকে দুর্বল চিহ্নিত করে তাদের জন্য কিছু বিশেষ সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করে দেওয়া। সমস্ত রকম সংরক্ষণেরই সেটাই মূল লক্ষ্য। এর ফলে, সংরক্ষণ এই বার্তা বহন করে যে তার সুফলভোগীরা এক দুর্বল শ্রেণি, যারা এখনও সমান সামাজিক অবস্থানে পৌঁছতে পারেনি। সংরক্ষণের মোড়কে সেই দুর্বল শ্রেণিকে সমান অধিকারের উপরে কিছু বিশেষ অধিকার দিয়ে একটা সহজ আপস গড়ে তোলার চেষ্টা করে প্রশাসন। কিন্তু তাতে কি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক সাম্য আসে? সমান সামাজিক অবস্থান গড়ে ওঠে? তারা কি সেই বাড়তি অধিকারটুকু উপভোগ করার মতো যথেষ্ট প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে? বরং এর মাধ্যমেই আদতে বিভেদের দেওয়ালগুলি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ভারতীয় সংবিধানের মূল বার্তা, রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যই তো সমস্ত নাগরিকের সমান সামাজিক অবস্থান নিশ্চিত করা। দুর্বল নাগরিক শ্রেণিকে শিক্ষায়, যোগ্যতায় সমান অবস্থানে তুলে এনে সমান অধিকারে প্রত্যয়ী করে তোলা। যে কোনও জাতপাতভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক বৈষম্য ও শোষণকে নির্মূল করা। গোড়ার এই কথাগুলি নিশ্চিত করতে পারলেই আপন যোগ্যতায়, সবার সঙ্গে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যারা আগে উঠে আসবে তারাই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সত্যিকারের অবদান রাখতে পারবে। তা না হলে যোগ্যতমের উদ্বর্তনের বদলে নানা রকম বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করে নিম্নমেধার উদ্বর্তনের ধারাবাহিকতায় দেশকে ক্রমশ পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। সামাজিক ন্যায়ও অধরা থেকে যাবে।
ভারতের শিল্প, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সাহিত্য, শিল্পকলার বিভিন্ন মঞ্চে কোনও সংরক্ষণ ছাড়াই বহু সুযোগ্য নারী নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের নিজের সংগ্রাম, যোগ্যতা, আত্মমর্যাদার শক্তি তাঁদের এগিয়ে দিয়েছে। তাঁরা ভারতের অর্থনীতিকে, ভারতের আন্তর্জাতিক পরিচয়কে নিজের প্রচেষ্টায় শক্তিশালী করে চলেছেন। অন্ততপক্ষে সেই মানের যোগ্যতাসম্পন্ন একটি নারীও কি এখন দেশের লোকসভা, বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে আর নেই? যাঁরা সমান সামাজিক অবস্থানে থেকে, নিজের যোগ্যতার নিরিখেই রাষ্ট্রের বা রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন? বাস্তবে রাষ্ট্রের সামাজিক আবহই তো তাঁদের বাধ্য করছে নারী শক্তি বন্দন-এর কবচে দুর্বল শ্রেণির অগৌরব বহন করতে। এই ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’-এ সেই আত্মসমীক্ষার দায়ভার রাষ্ট্রযন্ত্রের, সমান সামাজিক অবস্থানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে তুলে আনার দায়িত্ব রাষ্ট্রযন্ত্রের। তবেই এমন ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’-এর প্রয়োজন ফুরোবে।
সমগ্র নারীসমাজের ভাবা দরকার— এই অধিনিয়ম কি তাদের সমান সামাজিক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবে, না কি উল্টে ঈপ্সিত সামাজিক সাম্য ও ঐক্যের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াবে?