Saraswati Puja

কবির হৃদয়কমলাসনা

মাইকেল থেকে বঙ্কিম, তারও আগে ময়মনসিংহ-গীতিকা বা মঙ্গলকাব্য— সরস্বতী পূজিতা হচ্ছেন সাহিত্যলক্ষ্মী রূপেই।

Advertisement

রিমি মুৎসুদ্দি

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৫
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী-তে বীরেন্দ্র সিংহের দাসী ও বিমলার সহায়ক আশমানির রূপবর্ণনায় বাগ্-দেবীর শরণাপন্ন হয়েছেন। আশমানির গুরুত্ব উপন্যাসে সামান্য হলেও বঙ্কিম তাঁর রসবোধে বিস্ময়াভূত করার অদ্ভুত দক্ষতায় ‘আশমানির অভিসার’ পর্বে সরস্বতী বন্দনা করেছেন। হাস্যকৌতুক রসের পাশাপাশি দেবী বরদাকে কাব্যশাস্ত্র ইতিহাসের অংশীদারও করেছেন। সাহিত্যসম্রাটের কলমে কখনও তিনি ‘কমলাসনা’, কখনও ‘বটতলা বিদ্যাপ্রদীপ তৈলপ্রদায়িনী’!

Advertisement

তিনি লিখেছেন, “হে বাগ্‌দেবি! হে কমলাসনে! শরবিন্দুনিভাননে! অমলকমল-দলনিন্দিত-চরণ-ভক্তভজন-বৎসলে! আমাকে সেই চরণকমলের ছায়া দান কর; আমি আশমানির রূপ বর্ণন করিব। হে অরবিন্দানন-সুন্দরীকূল-গর্ব-খর্বকারিণি! হে বিশাল রসাল দীর্ঘ-সমাস-পটল-সৃষ্টিকারিণি! ...পদনখের এক পার্শ্বে স্থান দাও, ...সমাস-পটল, সন্ধি-বেগুন, উপমা-কাঁচাকলার চড়চড়ি রাঁধিয়া এই খিচুড়ি তোমায় ভোগ দিব। হে পণ্ডিতকুলেপ্সিত-পয়ঃপ্রস্রবিণি!... হে অঙ্গুলি-কণ্ডূয়ন-বিষমবিকার সমুৎপাদিনি! হে বটতলা-বিদ্যাপ্রদীপ-তৈলপ্রদায়িনি!... বুদ্ধির প্রদীপ একবার উজ্জ্বল করিয়া দিয়া যাও। যে রূপে তুমি কালিদাসকে বরপ্রদা হইয়াছিলে, যে প্রকৃতির প্রভাবে রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, শকুন্তলা জন্মিয়াছিল, যে প্রকৃতির ধ্যান করিয়া বাল্মীকি রামায়ণ, ভবভূতি উত্তরচরিত, ভারবি কিরাতার্জুনীয় রচনা করিয়াছিলেন, সে রূপে আমার স্কন্ধে আরোহণ করিয়া পীড়া জন্মাইও না; যে মূর্তি ভাবিয়া শ্রীহর্ষ নৈষধ লিখিয়াছিলেন, যে প্রকৃতিপ্রসাদে ভারতচন্দ্র বিদ্যার অপূর্ব রূপবর্ণন করিয়া বঙ্গদেশের মনোমোহন করিয়াছেন, যাহার প্রসাদে দাসরথি রায়ের জন্ম, যে মূর্তিতে আজও বটতলা আলো করিতেছ, সেই মূর্তিতে একবার আমার স্কন্ধে আবির্ভূত হও...”

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য-এ দেবীকে কবির হৃদয়পদ্মাসনে অধিষ্ঠানের প্রার্থনা জানান: “দেবি বিশ্ববিনোদিনি,/ তব বলে বলী যে, মা, কি অসাধ্য তার/ এ জগতে? ঊর তবে, ঊর পদ্মালয়া/ বীণাপাণি! কবির হৃদয়-পদ্মাসনে/ অধিষ্ঠান কর ঊরি! কল্পনা-সুন্দরী-/... এ দাসেরে বর যদি দেহ গো, বরদে,/ তোমার প্রসাদে, মাতঃ, এ ভারতভূমি/ শুনিবে, আনন্দার্ণবে ভাসি নিরবধি,/ এ মম সঙ্গীতধ্বনি মধু হেন মানি! আবার, মেঘনাদবধ কাব্য-এ দেবী-স্মরণ:..কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি/ ...বন্দি চরণারবিন্দ,... ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে/ ভারতি! যেমতি, মাতঃ, বসিল আসিয়া,/ বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন)/ যবে খরতর শরে, গহন কাননে,/ ক্রৌঞ্চবধূ সহ ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা,/ তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি।”

Advertisement

অর্থাৎ, মাইকেল থেকে বঙ্কিম, তারও আগে ময়মনসিংহ-গীতিকা বা মঙ্গলকাব্য— সরস্বতী পূজিতা হচ্ছেন সাহিত্যলক্ষ্মী রূপেই। সৃজনমূলক রচনায় খ্যাতি, যশ ও তার ফলে অর্থোপার্জন প্রার্থনীয় ঠিকই, তবে এ সবের জন্য প্রয়োজন পাঠক বা শ্রোতার মনোরঞ্জন। কাব্য বা গদ্যভাষায় পাঠক শ্রোতার মন জয় করার বর চেয়ে বাগ্‌দেবীর স্তুতি গাইছেন গীতিকা রচয়িতারা, মঙ্গলকাব্যকার। আধুনিক কবি ও গদ্যশিল্পীরাও। দেবীর স্তুতিগানে গীতিকা ও মঙ্গলকাব্য রচয়িতারা পির গাজি ও অন্যান্য দেবদেবীর বন্দনা করছেন, মাইকেল ও বঙ্কিমের বন্দনায় পূর্বজদের রচনা মাহাত্ম্য বর্ণিত হচ্ছে।

মকবুল ফিদা হুসেনের আগেই ‘মেঘমল্লার’ গল্পে দেবীকে অক্ষরে ‘এঁকেছিলেন’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাতে মেঘমল্লার রাগের বিস্তারে, কোন সুদূর অতীতে ভদ্রাবতী নদীর বাঁকে বড় ঢিবির উপর লুপ্ত হয়ে যাওয়া সরস্বতী মন্দির থেকে দেবী স্বয়ং এসে উপস্থিত হন গায়কের কাছে। ছলে ও কৌশলে দেবীকে বন্দি করলেন দুষ্ট কাপালিক গুণাঢ্য। সেই রাতে মেঘমল্লার গায়ক প্রদ্যুম্ন কেবল নিজের কাজের অনুতাপেই নয়, এক প্রকৃত সরস্বতী সেবকের মতো দেবীর উদ্ধারে চিরকালের জন্য পাষাণজন্ম গ্রহণ করলেন।

বেতের জঙ্গল আর বাঁশবনের মধ্যে চিরশায়িত প্রদ্যুম্নের পাষাণমূর্তিকে মণীন্দ্র গুপ্তের ‘দেবিতমা সরস্বতী’ কবিতায় সারা রাত তম্বুরা বাজিয়ে গান শোনাতে এলেন স্বয়ং দেবী। দেবীর অপেক্ষায় যুবক থেকে বৃদ্ধে রূপান্তরিত প্রদ্যুম্নকে সেই গান পথে খুঁজে বেড়ায়। শেষে হয়তো সেই গান এসে বসে কবির শব্দে। কবির খাতা ভরে যায় বিষাদদেবীর হাতে সাজানো নিপুণ অক্ষরে। যেখানে বনধুঁদুলের লতা আর পুকুরের কুসুম কুসুম গরম জলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাস যেন অপেক্ষায়! “ছেঁড়াখোঁড়া, অক্ষরে অক্ষরে কালি হয়ে যাওয়া কাগজের ফাঁক দিয়ে/ আজ কখন চাঁদ উঠবে।”

বাংলা সাহিত্যে এই ভাবেই সরস্বতীকে ধ্বনি, বীণা ও তন্ত্রীর দেবী রূপের পাশাপাশি শব্দ, বর্ণ ও অক্ষরের দেবী রূপে পূজা চলে আসছে। সরস্বতীই প্রমাণ— বাঙালির দেবী নিছক আচার ও রীতিনীতিতে আবদ্ধ নন, অন্ধ ভক্তির অভিমুখ নন। বরং তার আরাধ্যা বহু যুগ ধরে বাঁধা পড়ে আছেন ‘বিদ্যাপ্রদীপ’-এর সঙ্গে, এক পরিব্যাপ্ত শিল্প-চারণ, সাহিত্যচর্চা ও জীবনবোধের সঙ্গে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement