সাবিরা প্রকাশ। —ফাইল চিত্র।
নতুন বছরে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে কি বদল আনতে চলেছেন চিকিৎসক সাবিরা প্রকাশ? পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে লড়াই করার জন্য তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। পাক সংসদে মহিলা অনেকেই আছেন, কিন্তু এই প্রথম সে দেশের নির্বাচনে দাঁড়াতে চলেছেন সংখ্যালঘু হিন্দু নারী। ‘সংরক্ষিত’ নয়, ‘সাধারণ আসন’-এর প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই এগিয়ে এসেছেন তিনি। তাঁর আত্মবিশ্বাস দেখে তাঁর দেশ স্তম্ভিত। কারণ, গত আধ শতকের বেশি সময়ে তাঁর জেলা থেকে কোনও মহিলাই নির্বাচনে দাঁড়াননি। বহু স্থানীয় নেতা, সমাজমাধ্যমের লোকজন তাঁর পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।
২৫ বছরের তরুণী সাবিরা প্রকাশ নির্বাচন লড়বেন ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’র হয়ে (পিপিপি), তাঁর জন্মস্থান থেকেই। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের ‘বুনের’ জেলার পিকে-২৫ তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্র। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত খাইবার পাখতুনখোয়া দেশের চতুর্থ বৃহত্তম প্রদেশ। জনসংখ্যার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, এই এলাকায় (তৃতীয় বৃহৎ জনবসতি যুক্ত এলাকা) পাকিস্তানের মোট নাগরিকের প্রায় ১৮ শতাংশের বাস। এর মধ্যে হিন্দু নাগরিক এক শতাংশেরও কম। আসলে, গোটা পাকিস্তানেই হিন্দু জনসংখ্যা মাত্র দুই শতাংশের কাছাকাছি। কাজেই এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোটেই সহজ নয়। তার উপর এই অঞ্চল চিরকাল অশান্তিতে থেকেছে। পর্বত, উপত্যকা, কৃষিক্ষেত্র, সমতল-সমৃদ্ধ পাখতুনখোয়ার ইতিহাসের অনেকটাই লিখে দিয়েছে সুপরিচিত খাইবার পাস। বিচিত্র সাম্রাজ্য, ধর্ম, জনজাতি অধ্যুষিত করেছে এই ভূখণ্ড। গ্রিক শাসন, হিন্দু শাসন, বৌদ্ধ প্রভাব সমস্তই এসেছে পাখতুনদের এই মা-ভূমিতে। এর সীমানা ছুঁয়ে আছে বালুচিস্তান, পঞ্জাব, বাল্টিস্তান, ইসলামাবাদ, আজ়াদ কাশ্মীর। এলাকাটি আফগানিস্তানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সন্ত্রাসবাদী নানা সমস্যায় উদ্বিগ্ন থাকেন বাসিন্দারা। চাইছেন শান্তি, স্থায়ী সরকার। এই আশায় মাত্র ২৫ বছরের ‘বিধর্মী’ তরুণীকে আইনসভায় পাঠাতে মনস্থির করেছেন এলাকার বড় অংশের মানুষ।
সাবিরা জীবনের উপর ধর্মকে বোঝার মতো চাপাতে রাজি নন। তাঁর পরিষ্কার কথা, “ধর্মীয় জীবন নিয়ে বিভেদের প্রচেষ্টা এখন বাতিল হয়ে গিয়েছে। এ সব পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে।” তিনি মনে করেন, তাঁর এলাকার মানুষজন তাঁকে ‘পাখতুন প্রতিবেশী’, ঘরের মেয়ের মতোই দেখেন। বুনেরে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে সাবিরা পড়তে যান লাহৌরে। চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে ভর্তি হন অ্যাবটাবাদ ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। ২০২২-এ চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘ব্যাচেলর’ হয়ে সিদ্ধান্ত নেন রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার। রাজনীতি ও সামাজিক কাজের সঙ্গে সাবিরার পারিবারিক যোগাযোগ। তাঁর ভাষায়, “মানুষের সেবা আমার রক্তে রয়েছে।” ছাত্রীজীবনেই এ সবের শুরু। এখন ‘পিপিপি’র ‘বুনের’ জেলার ‘মহিলা শাখা’র সম্পাদক। নির্বাচনী লড়াইয়ের পাশাপাশি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাতেও বসতে চান।
বেনজ়ির ভুট্টো ছাড়া সাবিরাকে অনুপ্রাণিত করেছেন তাঁর পিতা, অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক ওম প্রকাশ। ৩৫ বছরের উপর ‘পিপিপি’র সঙ্গে যুক্ত। পার্টির ‘চিকিৎসক শাখা’র সভাপতি। দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা করেছেন বিনামূল্যে। অভাবী মানুষের জন্য ব্লাড ব্যাঙ্ক বানিয়েছেন। মেয়েকে রাজনীতির পথে পরিচালিত করেছেন সুচারু ভাবে। সাবিরা নারীর নিরাপত্তা, অধিকার এবং উন্নয়ন নিয়ে সরব। জয়ী হলে জোর দেবেন সেই কাজে। শিক্ষা এবং জনস্বাস্থ্য নিয়েও তাঁর আগ্রহ। বুনেরে মহিলাদের কলেজ মাত্র একটি। মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার সরকারি স্কুল হাতেগোনা। বেসরকারি স্কুলে যাওয়ার সামর্থ্য ক’জনের আছে? ফলে অধিকাংশ মেয়ে নিরক্ষর থেকে যান। গর্ভাবস্থার শেষ কালে হয়তো কারও ডাক্তার নসিব হয়। কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জরুরি অবস্থা মোকাবিলার ব্যবস্থা নেই। রোগীকে নিতে হয় ইসলামাবাদ অথবা পেশোয়ারে। চিকিৎসার অভাবে শিশুমৃত্যু বাড়ছে। এই অবস্থায় ডা. প্রকাশকে অনেকেই ‘পরিবর্তন এবং উন্নয়নের প্রতীক’ মনে করছেন। ভারত-পাক সম্পর্কে ‘বন্ধুত্বের সেতু’র ভূমিকা পালনে আশা রাখেন সাবিরা। সব মিলিয়ে তিনি অনেকের ভাষায় ‘বুনের কি বেটি’ যিনি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন; সংখ্যালঘু ও মহিলাদের অধিকারের জন্য আইনসভায় আওয়াজ তুলবেন।
২০১৩-য় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন ১১০০ নারী। ২০১৮-য় সেই সংখ্যা ১৬০০। ২০২৪-এর ষোড়শ সাধারণ নির্বাচনে (৮ ফেব্রুয়ারি) মনোনয়ন দাখিল করেছেন ৩০০০ নারী। সংবিধান সংশোধন করে পাঁচ শতাংশ সাধারণ আসন নারীর জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাই সাবিরা এই আসনে দাঁড়াতে পেরেছেন। আপাতভাবে ইতিবাচক ছবি হলেও, কয়েনের উল্টো পিঠে অনেক প্রশ্ন। ক’জন নারী বিজয়ী হয়ে আইনসভায় শেষ পর্যন্ত যেতে পারবেন? ক’জন নিজ বুদ্ধি এবং ক্ষমতার স্বাধীন ও যথাযথ প্রয়োগ করতে পারবেন? সমস্ত পরিবর্তন লোকদেখানো চমক নয় তো? পাকিস্তান তীব্র অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের রশি কার হাতে থাকে, সকলেরই জানা। একের পর এক রাষ্ট্রপ্রধানদের কারারুদ্ধ হতে হয়। তারই মধ্যে সাবিরার এই মনোনয়ন কতখানি সদিচ্ছা ও গুরুত্ববাহী তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবু এই ব্যতিক্রমী ঘটনাকে মূল্যায়নের তালিকায় না আনলেই নয়।
সাবিরা জানিয়েছেন, “গর্ব করে বলতে পারি, মনোনয়নপত্র দাখিলের পর থেকেই এলাকাবাসীদের তরফ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি।” সত্যিই যদি তিনি শেষ পর্যন্ত লড়াইটা করতে পারেন এবং জেতেন, তাঁর আশাবাদ বাস্তবের মাটি খুঁজে পাবে। যদি পরাজিতও হন, স্বীকার করতেই হবে পাকিস্তানের অচলায়তনে নতুন জানলা খুলে গেল। ভারত তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছে। সাবিরা আমাদের দুই দেশকে একটি সাধারণ সংযোগবিন্দুতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। দেখতে হবে অতীতের অশান্ত নদীর উপর বন্ধুত্বের সেতুটি সত্যিই নির্মিত হয় কি না; শক্তপোক্ত হয় কি না।