Himanta Biswa Sarma

আমি যা দেখি তুমি তা দেখো?

স্নায়ুবিজ্ঞান সেই কবেই প্রমাণ করেছে ‘সিয়িং ইজ় নট বিলিভিং’। আমরা যা দেখি তা আসলে চোখ দিয়ে দেখি না। মস্তিষ্কই নিরন্তর স্থির করে দেয় সেই দৃষ্টিপাত।

Advertisement

জয়দীপ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২৪ ০৯:২১
Share:

—ফাইল চিত্র।

ছেলেবেলায় আমাদের এক মজার খেলা ছিল। চার-পাঁচ জন খুদে মিলে জটলা পাকাতাম কারও বাড়িতে। তখনকার মধ্যবিত্তের আটপৌরে আসবাবপত্র আর গেরস্থালির এটা-সেটা ছড়িয়ে রয়েছে ঘরটিতে। এক খুদে বেমক্কা প্রশ্ন করল বাকিদের, “আমি যা দেখি তোরা কি তা দেখিস?” সমস্বরে জবাব এল, “হ্যাঁ, দেখি।” এ বার ধরা যাক প্রশ্নকর্তা বলল, “আমি দেখি একটি পাখি।” আট থেকে বারোর দুষ্টুগুলো তো এ বার আতান্তরে। ঘরের ভিতর পাখি আসবে কেন! সবাই হামলে পড়ল প্রথম খুদের উপর। “কোথায় তোর পাখি? দেখা দিকিনি!” পাখি কিন্তু সত্যিই ছিল। আমাদেরই কারও রংচটা জামার গায়ে! সস্তা সাবানে কাচা সেই জামায় লেপ্টে থাকা ফিঙের বরণ আর তখন চেনা যায় না, মনে বিভ্রম তৈরি করে।

Advertisement

সে দিন পড়ছিলাম নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত মনোবিদ্যা ও স্নায়ুবিজ্ঞান বিষয়ক পাক্ষিক সায়েন্টিফিক আমেরিকান মাইন্ড-এর বেশ পুরনো একটি সংখ্যা। এক দশক আগের ওই সংস্করণের বিষয় ছিল ‘বিভ্রম’। আসলে মস্তিষ্কের নানান অদ্ভুত রকমের আচরণ। মোট ১৮৭টি বিচিত্র বিভ্রমের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করে দিয়েছে এই পত্রিকা, যাদের ১৭৮ বছর-প্রাচীন সহযোগী প্রকাশনা ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’-এ এখনও অবধি লিখেছেন কম করেও দেড়শো নোবেল বিজয়ী।

স্নায়ুবিজ্ঞান সেই কবেই প্রমাণ করেছে ‘সিয়িং ইজ় নট বিলিভিং’। আমরা যা দেখি তা আসলে চোখ দিয়ে দেখি না। মস্তিষ্কই নিরন্তর স্থির করে দেয় সেই দৃষ্টিপাত। ওই সংখ্যাটির সম্পাদকীয়ের প্রথম বাক্যটি হচ্ছে ‘হোয়াট উই এক্সপিরিয়েন্স শেপস আওয়ার রিয়্যালিটি’ (আমাদের অভিজ্ঞতাই আমাদের বাস্তবকে নির্মাণ করে)। আর তার উপরেই জ্বলজ্বল করছে আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত উক্তি— “রিয়্যালিটি ইজ় মিয়ারলি অ্যান ইলিউশন” (বাস্তব কেবল এক বিভ্রমমাত্র)। যে বাস্তব আমরা দেখি তা কার্যত আমাদেরই রচনামাত্র। সব ঝুট হ্যায়!

Advertisement

মনে রাখতে হবে ওই আমেরিকান ম্যাগাজ়িন যখন এই কথাগুলো বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে ঘষে ঘষে আমাদের জানাচ্ছে, তখনও কোনও এক নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর নাম বিজেপির শীর্ষ বৃত্তে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উঠে আসেনি। তখনও পৃথিবী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কুৎসিত চেহারা দেখেনি। তখনও সমাজমাধ্যম দেশ ও সমাজের অর্বাচীন অভিভাবক হয়ে ওঠেনি।

আর আজ যখন ডিপ ফেক বিশ্বের সর্বত্র ভোটে প্রভাব ফেলছে, তখন খেলাটা আর শৈশবের সেই ছেলেমানুষিতে আটকে নেই। যা দেখছি তা যে মোটেই সত্য নয়, তা-ই এখন চরম সত্য।

গত নভেম্বরেই মুরলীকৃষ্ণ চিন্নাদুরাই ইংল্যান্ডে বসে একটি তামিল ইভেন্টের লাইভ স্ট্রিমিং দেখেছিলেন। হঠাৎই তাঁর নজরে পড়ল একটি অদ্ভুত বিষয়। শ্রীলঙ্কার এলটিটিই-র প্রয়াত শীর্ষ নেতা প্রভাকরনের কন্যা দুয়ারাকা ওই লাইভে বক্তৃতা দিচ্ছেন। পেশায় ফ্যাক্ট চেকার চিন্নাদুরাই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি। আর পারবেনই বা কী করে! সেই ২০০৯ সালেই শ্রীলঙ্কার বায়ুসেনার বোমারু বিমানের আক্রমণে মারা যান প্রভাকরনের আত্মজা। তখন তাঁর বয়স ছিল ২৩। অথচ চোদ্দো বছর পর সেই দুয়ারাকা কিনা চোখের সামনে মাঝবয়সি চেহারায় আবির্ভূত হয়ে তামিল ইলমের স্বপ্ন দেখিয়ে লোকজনকে তাতাচ্ছেন! চিন্নাদুরাইয়ের বেশি সময় লাগেনি বুঝতে যে, এটা ডিপ ফেকের আরও এক কারসাজি। পাকিস্তানের জেলবন্দি ইমরান খানকে তেমনই এক কারসাজিতে এক বড় রাজনৈতিক সমাবেশে ভাষণরত দেখা গেছে।

এই যে সাত পর্যায়ে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ চলেছে দেশে, এতে সভা-সমিতি-সমাবেশে যে অবলীলায় অহর্নিশ অনৃতভাষণ দিচ্ছেন নেতারা তাতে চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জনেরও কোনও অবকাশ থাকছে না। এই তো গত বুধবার রাঁচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা (ছবি) জানালেন যে, তাঁর রাজ্যে নাকি চার দশক জুড়ে বেলাগাম অনুপ্রবেশের ফলে আজ এক কোটি পঁচিশ লক্ষ লোকই বাংলাদেশি। এই বিপুল সংখ্যক বিদেশির চাপে নাকি রাজ্যে অসমিয়ারা রীতিমতো আক্রান্ত। রাজ্য বিধানসভায় তাঁর সহ-বিধায়কদের মধ্যে চল্লিশ জনই নাকি বাংলাদেশি।

অথচ মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানেন যে, অসমে এনআরসি-ছুটের সংখ্যাটি হচ্ছে উনিশ লক্ষ। এবং আইনমাফিক আবেদনের সুযোগ পেলে এই সংখ্যাটিও নেমে আসবে অনেকটাই। তা হলে অনুপ্রবেশের ওই আষাঢ়ে গল্পটি তিনি কেন শোনাচ্ছেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোট যে ভাবে গড়াচ্ছে বিজেপি বুঝতে পারছে যে, খেলা ক্রমশই কঠিন হচ্ছে। তাই কুকথা, বিদ্বেষ, বিষোদ্গার এবং মিথ্যের বেসাতিও মাত্রা ছাড়াচ্ছে।

এই ব্যাখ্যা হয়তো ভুল নয়। কিন্তু এতে পুরো সত্যটা কখনওই ধরা পড়ছে না। হিমন্তবিশ্ব শর্মার এই বিস্ফোরক মন্তব্যে আর যাদের যা হোক, শুধু অসম নয়, গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালিমাত্রেই জানে যে, তারা রাষ্ট্রের চোখে এক বিদেশিই।

১৮৭৪-এ সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়াকে জুড়ে দিয়ে চিফ কমিশনার-শাসিত অসম প্রদেশ গড়েছিল ইংরেজ সরকার। সেটাই আসলে প্রথম বারের বঙ্গভঙ্গ যা ইতিহাস চর্চায় দীর্ঘকাল অনালোকিতই ছিল। রাজ্যের বাঙালি তাই অন্যূন দেড়শো বছর ধরে অসমেরই বাসিন্দা। চলতি লোকসভা ভোটে শিলচর আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সুস্মিতা দেব পুরো প্রচারপর্বে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বরাকের বাঙালি যে অসমের আদি বাসিন্দা, সেই ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। কতটা সফল হলেন বলা মুশকিল। কারণ এখানেও ‘আমি যা দেখি তোমরা কি তা দেখো?’-র বিভ্রম।

হিমন্তবিশ্ব এবং অসমিয়া জাতীয়তাবাদের চোখে রাজ্যের সব বাঙালিই বাংলাদেশি। আবার বাঙালি নিজেকে দেখতে গিয়ে হিন্দু কিংবা মুসলমান হিসাবে দেখে। চোখ ও মস্তিষ্কের এই ক্রমাগত সংঘাতের মধ্যেই আবারও চলে গেল ১৯ মে। বরাক উপত্যকায় সে দিনটি উদ্‌যাপনের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপিরও উনিশ-উৎসব। সন্দেহ ও বিতর্ক লেগে আছে তাতে— আর সব মিলিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে দৃশ্য আর দৃষ্টির নতুন বিভ্রম।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement