—প্রতীকী ছবি।
২০২৩ থেকে শুরু করে আট বছরে ‘রাষ্ট্রীয় কোয়ান্টাম মিশন’ খাতে ভারত খরচ করবে প্রায় পৌনে এক বিলিয়ন ডলার। প্রতিবেশীর তুলনায় তুশ্চু। ২০২২ সালে চিন জানিয়েছিল, পরবর্তী পাঁচ বছরে তারা ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে। ব্রিটিশ সরকার আগামী দশ বছরে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি খাতে, যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ নেই সেমিকন্ডাকটরের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের ক্ষেত্রেও। যে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি এখনও নিতান্তই ভবিষ্যতের গর্ভে, তাকে নিয়ে কেন এই মাতামাতি? কারণ, এই কম্পিউটারের গণন-ক্ষমতা অবিশ্বাস্য। ২০১৯ সালে গুগল জানিয়েছিল, তাদের সিকামোর নামক ফার্স্ট জেনারেশন কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন এক গাণিতিক সমস্যার সমাধান করেছে ২০০ সেকেন্ডে, সাধারণ কম্পিউটারের যে কাজে সময় লাগত প্রায় ১০,০০০ বছর।
দ্রুত অঙ্ক কষাই শুধু নয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কী কী সম্ভব, তার পুরো তালিকা করতে বসলে মহাভারত হয়ে যাবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, অতি দ্রুত বিভিন্ন প্রোটিনের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বানিয়ে ফেলা যাবে বহু নতুন জীবনদায়ী ওষুধ; তৈরি করা যাবে এমন গাড়ি যাতে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হবে ন্যূনতম; অনলাইন ব্যাঙ্কিং তথ্য এমনই নিরাপদ করা যাবে যে, হ্যাকারদের সে তথ্য বার করতেও লাগবে হাজার হাজার বছর। কিন্তু এ সবই ভবিষ্যতের কথা। আসলে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতির থেকেও বেশি কার্যকর হয়ে উঠেছে ভয়— অন্য দেশের চেয়ে এই গবেষণায় পিছিয়ে পড়ার ভয়। যে দেশ কোয়ান্টাম প্রযুক্তিকে সর্বপ্রথম হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারবে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে তো বটেই, জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রেও তাদের টক্কর দেওয়া অন্যান্য দেশের পক্ষে দুঃসাধ্য হবে। আর সেই অস্ত্র যদি কোনও যুদ্ধবাজ একনায়কের হাতে পড়ে, তা হলে বিপদ কল্পনাতীত।
কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ২০২২ সালে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল আড়াই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। ২০২৩ সালে সে বিনিয়োগ প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ কমে যায়। কারণ, প্রযুক্তি সংস্থাগুলি দ্রুত বুঝে নেয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পিছনে খরচ করলে অনেক কম সময়ে অনেক বেশি লাভ। সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই চটজলদি অদলবদলের সুবিধা প্রায় নেই। যে কারণে প্রতিটি বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের পিছনেই থাকে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ভারতের ক্ষেত্রে সেই পরিকল্পনাটি কী? আইবিএম বা গুগলের মতো যে বেসরকারি সংস্থাগুলি কোয়ান্টাম প্রযুক্তি নিয়ে প্রায় দু’দশক ধরে কাজ করছে, তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অন্তত এই মুহূর্তে অসম্ভব। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারত কি পিছিয়ে থেকেই শুরু করছে?
গুগলের মতো বেসরকারি সংস্থা বা চিনের মতো দেশ বিনিয়োগ-নির্ভর গবেষণার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যথাযথ সাফল্য কবে আসবে, সে কথা কেউই জানে না। প্রথম প্রজন্মের একাধিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার সারা পৃথিবী জুড়ে তৈরি হলেও বিশেষজ্ঞরা মেনে নিয়েছেন, তার মান সন্তোষজনক নয়। সাধারণ কম্পিউটারে যে কোনও তথ্য বিশ্লেষণের জন্য যেমন দরকার পড়ে ০ এবং ১ এর ‘বাইনারি ডিজিট’ (সংক্ষেপে বিট), সে রকমই কোয়ান্টাম কম্পিউটারে তথ্য বিশ্লেষণের জন্য দরকার কিউবিট (কোয়ান্টাম বিট)। আর উচ্চ মানের কিউবিট তৈরি করতেই আজকের বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদরা নাজেহাল হচ্ছেন। তাপমাত্রার সামান্যতম হেরফের হোক বা তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের সান্নিধ্য, কিউবিট-এর কোয়ান্টাম ধর্ম খুব সহজেই নষ্ট হতে পারে। অথচ, এই কোয়ান্টাম ধর্মের উপরে নির্ভর করেই আমরা ‘হয় শূন্য নয় এক’-এর বাইরে গিয়ে এমন সব পরিস্থিতির কথা ভাবতে পারি যেখানে ০ এবং ১, হেড এবং টেল, বাঁচা এবং মরা একই সঙ্গে ঘটতে পারে। এই কোয়ান্টাম ধর্মের উপরে নির্ভরশীল হয়েই ভবিষ্যতের সুপারকম্পিউটার একটির পর একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান না করে একই সঙ্গে অসংখ্য গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারে। তাই অনুন্নত কিউবিট নিয়ে এগোনোর মানে কোয়ান্টাম শব্দটি বাস্তবায়িত না হওয়া। ভারতের মতো দেশ এই ভরসাতেই বুক বাঁধছে যে, সীমিত সামর্থ্য নিয়ে শুরু করলেও অগ্রণী দেশ বা বেসরকারি সংস্থাগুলিকে ঠিকই ধরে ফেলা যাবে।
কিন্তু তার থেকেও বড় লক্ষ্য হল আমাদের নিজস্ব একটি কোয়ান্টাম বাস্তুতন্ত্র তৈরি করা। সুপারকম্পিউটার কোয়ান্টাম প্রযুক্তির একটি আঙ্গিক মাত্র, তার বাইরেও যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিল্পোৎপাদন সর্বত্রই কোয়ান্টাম প্রযুক্তি বড় সহায় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেই সোনালি ভবিষ্যৎকে সুনিশ্চিত করার জন্য দরকার নতুন অ্যালগরিদম, নতুন সফটওয়্যার, নতুন ক্লাউড কম্পিউটিং প্ল্যাটফর্ম। এ-হেন পরিকাঠামো দ্রুত তৈরি করে ফেলতে পারলে উৎপাদকরা তো বটেই, অসংখ্য উপভোক্তাও কোয়ান্টাম অর্থনীতিতে শামিল হতে পিছপা হবেন না। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ‘নেটওয়ার্ক এফেক্ট’ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বেসরকারি সংস্থাগুলিও স্বেচ্ছায় সরকারের সঙ্গে অংশীদারি বিনিয়োগে প্রবল উৎসাহ দেখাচ্ছে। ভারতের আর একটি বড় সুবিধা হল মানবসম্পদ। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে ভাবে ভারত বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে গুরুত্ব পেয়েছে, পরিকাঠামো ঠিকমতো গড়ে তুলতে পারলে পৃথিবীব্যাপী কোয়ান্টাম অর্থনীতিতেও ভারতীয় প্রযুক্তিবিদরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন।
কিন্তু ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে দীর্ঘ অবহেলার জন্য দেশে এমন গবেষণাগার কমই আছে, যেখানে অতি কম তাপমাত্রায় কিউবিট সংরক্ষণ করা যায় বা ন্যানোপ্রযুক্তির মাধ্যমে বানিয়ে ফেলা যায় কোয়ান্টাম সেন্সর। অথচ ক্রায়োজেনিকস বা ন্যানোটেকনোলজির দরকার ছিল বহু আগেই, অন্যান্য কারণে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উন্নত দেশগুলির তুলনায় আমরা দু’দশক পিছিয়ে শুরু করছি। তবে, দৌড় যে-হেতু দীর্ঘ, হঠাৎ কী ঘটে যায়...