নিয়ন্তা:আফজ়ল খাঁকে বাঘনখ দিয়ে হত্যা করছেন শিবাজি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
ছেলেবেলার ইতিহাস বইতে পড়া শিবাজির ‘বাঘনখ’ দেশে ফিরছে। এই সেই ধারালো অস্ত্র, যা দিয়ে শিবাজি ‘মুসলমান শত্রু’ আফজ়ল খাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করেছিলেন। তাই অনেকেই বাঘনখের দেশে ফেরাকে বীর হিন্দুর মুসলমান শত্রু দমনের প্রতীকের দেশে ফেরা হিসাবে দেখতে চাইছেন। এই প্রতীকের প্রত্যাবর্তনের সূত্রে হিন্দু আত্মপরিচয়ধারী ধর্মগোষ্ঠীর গৌরবকে বহুগুণিত করে তুলতে চাইছেন তাঁরা। এই ভূভাগে অবশ্য কেবল যে ‘হিন্দু’ ‘মুসলমান’-এর বক্ষ বিদীর্ণ করে তা নয়। ‘হিন্দু’ তো ‘হিন্দু’রও বুক চিরে রক্তপান করে। তার ভয়ঙ্কর উদাহরণ মহাভারতে আছে। “বৃকোদর ভীম সেইরূপ কম্পমান দুঃশাসনকে আক্রমণ করে গলায় পা দিয়ে চেপে ধরলেন এবং তীক্ষ্ণ অসি দিয়ে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে ঈষদুষ্ণ রক্ত পান করলেন।” এই হিংস্রতার কাছে কোথায় লাগেন শিবাজি?
এই অবধি পড়ার পর একটা প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই জাগে। ভীম আর দুঃশাসনের লড়াই কি দুই ‘হিন্দু’র লড়াই? শতকরা নব্বই জন বলবেন, ‘না’। এ পাণ্ডব আর কৌরব, একই বংশবৃক্ষের দুই ভিন্ন শাখার লড়াই। কুরুপক্ষ আর পাণ্ডবপক্ষ, এই দুই পক্ষের লড়াইকে দু’দল হিন্দুর লড়াই হিসাবে আমরা দেখি না। ‘হিন্দু’, এই আত্মপরিচয় কুরু-পাণ্ডব কোনও পক্ষই ব্যবহার করেনি। ‘হিন্দু’, এই আত্মপরিচয় সেই মহাভারতের কালে আলাদা করে মাথা তোলেনি। মাথা তোলার প্রয়োজনও হয়নি। অনেকে ‘কল্পনা’ করেন মহাভারতের মাঠে তখনই নাকি গীতা উচ্চারিত হয়েছিল। উচ্চারিত যদি হয়েও থাকে, তা হলেও সেই দার্শনিক কথোপকথন হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের সঙ্গে হিন্দু বীর অর্জুনের কথাবার্তা হিসাবে মহাভারতের কালে দেখার কথা নয়। সেখানে গীতা ন্যায়-অন্যায়ের নীতি বিষয়ক সংলাপ। একই বংশের দু’টি শাখার লড়াই হচ্ছে— সেই লড়াইয়ের সূত্রে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার চলছে। এ কথাও এখন সকলের জানা, মহাভারতের নানা কথা পরবর্তী নানা সময়ের চিহ্ন বহন করছে— কালে দিনে মহাভারতের অবয়ব বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্যই রামায়ণ-মহাভারতের সারানুবাদক রাজশেখর বসু বাল্মীকির নামের মধ্যে অনেক কালের অনেক বাল্মীকির অস্তিত্ব স্বীকার করতেন। রাজশেখরের সহোদর গিরীন্দ্রশেখর তাঁর পুরাণপ্রবেশ গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে পুরাণের কথন নির্মাণে নানা পর্বে নানা জন সক্রিয়।
গীতা নামক সারকথা সঙ্কলনটি কৃষ্ণার্জুন-কথার বদলে হিন্দুর দেবতা কৃষ্ণের কথা হিসাবে নির্দিষ্ট হল পরে— উনিশ শতকে হিন্দুধর্মের গ্রন্থ হিসাবে তাকে মর্যাদা দেওয়া হল। ইংরেজ প্রশাসক ও তাদের প্রশাসনের স্বার্থে নিবেদিত ভারতবর্ষের সাহেব ইতিহাস-রচয়িতারা হিন্দু যুগ, মুসলমান যুগ, ইংরেজ যুগ এ ভাবে সময়কে ভাগ করতে শুরু করলেন। মুসলমান আগমনের পূর্ববর্তী সব কিছুই ‘হিন্দুযুগ’ এই নাম দিয়ে অভিহিত— সুতরাং গীতা ‘হিন্দু’ধর্মগ্রন্থ হিসাবে নতুন করে বিবেচিত হল। মুসলমান আগমনের আগের ভারতবর্ষে যে নানা রাজবংশের লড়াই ছিল, সেই রাজবংশগুলি যে নানা ধর্মসম্প্রদায়ের সূত্রে নিজেদের চিহ্নিত করত, সার্বিক ভাবে ‘হিন্দু’ এই আত্মপরিচয়ের ছত্রছায়া ব্যবহার করার যে প্রয়োজন হত না, এই মোটা কথাটা আমরা ভুলে গেলাম। ইংরেজদের করা মুসলমান যুগও যে কেবল নামের ফেরে মুসলমান, তার মধ্যেও যে হিন্দুধর্মের নানা বর্ণের সক্রিয় ইতিবাচক উপস্থিতি, সে কথাও ভুলিয়ে দিতে চেয়েছেন অনেকে। মোগল যুগ তো এখন তেমন করে ছাত্রপাঠ্য নয়।
শিবাজি অবশ্য নিজে সে কথা বিস্মৃত হননি। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের বাংলায় লেখা শিবাজী গ্রন্থটি তার সাক্ষ্যবহ। তাঁর ইংরেজিতে লেখা শিবাজি অ্যান্ড হিজ় টাইমস বইটি বৃহদায়তন, সুখপাঠ্য বাংলা বইটি আম বাঙালি পড়তে পারেন। শিবাজিকে রাজা হওয়ার জন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। যদুনাথ মনোগ্রাহী বাংলায় লিখেছিলেন, “শাস্ত্র অনুসারে ক্ষত্রিয় ভিন্ন অন্য কোন জাতের লোক হিন্দুর রাজা হতে পারে না; অথচ সে যুগে সমাজে ভোঁশলে বংশকে শূদ্র বলিয়া গণ্য করা হইত।” এই শাস্ত্রাচারের থেকে রেহাই পেতে শিবাজি মুনশি কাশীবাসী গাগা ভট্টকে ‘অনেক টাকা দিয়া হাত করিলেন’। তিনি টাকা পেয়ে পাঁতি লিখে দিলেন, “মোটা দক্ষিণার লোভে সকলেই শিবাজীর ক্ষত্রিয়ত্ব স্বীকার করিল।” যদুনাথ সরকারের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলে বলতে হয়, যে শিবাজিকে হিন্দু বীরত্বের ছত্রপতি হিসাবে তুলে ধরতে এখন অনেকেই সচেষ্ট, সেই শিবাজিকে হিন্দুশাস্ত্রীয় উচ্চবর্ণত্ব টাকা দিয়েই কিনতে হয়েছিল। এই শিবাজি এটাও ভাল করেই জানতেন, তাঁর লড়াই সামগ্রিক ভাবে ‘ইসলাম’-এর বিরুদ্ধে নয়। তাঁর লড়াই মোগল রাজবংশের শাসকবিশেষের সঙ্গে। যদুনাথ তাঁর বইতে ‘আওরংজীব’-এর কাছে প্রেরিত শিবাজির ফারসি চিঠির সুললিত বঙ্গানুবাদ প্রদান করেছিলেন। সে পত্র ‘আওরংজীব’-এর অপশাসনের বিরুদ্ধে, পূর্ববর্তী মোগল শাসকদের প্রতি সেখানে শিবাজির শ্রদ্ধা প্রকাশিত। সে চিঠিতে লেখা হয়েছিল, “এই সাম্রাজ্য-সৌধের নির্ম্মাতা আকবর বাদশাহ পূর্ণ-গৌরবে ৫২ [চান্দ্র] বৎসর রাজত্ব করেন। তিনি সকল ধর্ম্ম সম্প্রদায়... প্রতি... সার্ব্বজনীন মৈত্রী [সুলহ্-ই-কুল= সকলের সহিত শান্তি]র সুনীতি অবলম্বন করেন।” এই সুনীতি থেকে বর্তমান শাসক ভ্রষ্ট। তাই শিবাজি জানিয়েছেন, “আপনার রাজ্যে প্রজারা পদদলিত হইতেছে, প্রত্যেক গ্রামের উৎপন্ন দ্রব্য কমিয়াছে।” লড়াই দুই ধর্মের নয়, লড়াই সুশাসন নীতির সঙ্গে অপশাসন নীতির। শিবাজি হিন্দুকুলপতি হিসাবে কথা বলছেন না, এক জন শাসক হিসাবে আর এক শাসককে মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি ‘সকলের সহিত শান্তি’ নীতি থেকে ভ্রষ্ট।
এই ইতিহাসের কথা মনে রাখলে শিবাজির ফিরে আসা বাঘনখ যে মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুশৌর্যের প্রতীক নয়, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। সে সময় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য নানা মাপের শাসকেরা নানা মাপের শাসকদের সঙ্গে লড়াই করছেন। সেই লড়াইতে লুটতরাজ খুনজখম যথেষ্ট। হাতে পেলে কে আর কাকে ছাড়ে? যদুনাথ সরকার আফজ়ল খাঁ আর শিবাজির লড়াইয়ের নাটকীয় বর্ণনা দিয়েছেন। “গলার চাপে শিবাজীর দমবন্ধ হইবার মত হইল। কিন্তু এক মুহূর্ত্তে বুদ্ধি স্থির করিয়া তিনি বাম বাহু সজোরে ঘুরাইয়া আফজল খাঁর পেটে বাঘনখ বসাইয়া দিয়া তাঁহার পাকস্থলীর পর্দ্দা বিদীর্ণ করিয়া দিলেন, খাঁর ভুঁড়ী বাহির হইয়া পড়িল। আর, ডান হাতে বিছুয়া লইয়া খাঁর বাম পাঁজরে মারিলেন। যন্ত্রণায় আফজল খাঁর বাহুবন্ধন শিথিল হইয়া আসিল; এই সুযোগে শিবাজী নিজেকে মুক্ত করিয়া বেদী হইতে লাফাইয়া পড়িয়া নিজ সঙ্গীদের দিকে ছুটিলেন।” চমকপ্রদ, গতিময়, চিত্রবৎ বিবরণ। মহাভারতের বিবরণের থেকে আলাদা— কারণ মহাভারতে হত্যার পর ভীমকে পালাতে হবে না, এক মহারথীকে বধ করলে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ থেমে থাকে। যুদ্ধনীতি অনুযায়ী সেখানে দু’জনের যুদ্ধ। শিবাজির কালে যুদ্ধ দু’জনের নয়— দু’পক্ষের, কৌশলে মারতে ও পালাতে হবে। প্রয়োজনে অতর্কিতে লুটতরাজ করতে হবে। শিবাজির সুরাত লুটের বিবরণ যদুনাথ দিয়েছেন। লুটতরাজের সময় ধর্ম মানা হত না। এক বর্ণের হিন্দু অন্য বর্ণের হিন্দুকে আক্রমণ করত— হিন্দুর ছাতাটি হিন্দুর আত্মপরিচয়বাহী হয়ে মোটেই সর্বদা সার্বিক ভাবে হিন্দুদের রক্ষক নয়। জঞ্জিরা থেকে খারেপটন পর্যন্ত শিবাজি এগোচ্ছেন— “শিবাজীর সৈন্যগণের দ্রুত গতি, অজেয় শক্তি, লুটপাট এবং কঠোর পীড়নের সংবাদে ভদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার, গরিব গৃহস্থ ও প্রজা সকলেই দেশ ছাড়িয়া পলাইতে লাগিল।”
ইতিহাসবিদ যদুনাথের বিবরণ পড়তে পড়তে মনে হয়, সে সময় মানুষ কতকগুলি সত্যকে ‘সনাতন’ বলে মানতেন। অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁরা এই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সুশাসন নীতি মেনে যে কোনও ধর্মের শাসক যদি রাজ্য চালান তা হলে প্রজারা নিরাপদ থাকেন, সুশাসন নীতি থেকে বিচ্যুত হলে সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষের জীবনযাত্রাই বিপর্যস্ত হতে পারে। অনেক সময় কোনও কোনও শাসক ধর্মের জিগির তোলেন বটে, তবে ধর্মের ছাতার তলায় সামগ্রিক নিরাপত্তা জোটে না— কারণ ‘হিন্দু’ বা ‘ইসলাম’-এর তলায় নানা বর্ণ ও বংশের ভেদ-বিভেদ মুখ্য। হিন্দু ঐক্য বা ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকের ঐক্যের চাইতে বংশের গৌরব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিবাজিকে রাজা হওয়ার সময় তাই তাঁর বংশ যে গরিমাময় ক্ষত্রিয় বংশ তা টাকা দিয়ে পাঁতি লিখিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হল।
আধুনিক ভারতে বসে পুরনো সময়ের নিশানগুলিকে যাঁরা হিন্দুত্বের পক্ষে একমাত্রিক ভাবে সমসত্ত্ব সনাতন বলে চিহ্নিত করতে চাইছেন, তাঁরা আদতে সেকেলে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ সনাতন সত্যকে অস্বীকার করতে চাইছেন। নিজেদের হিন্দুত্বের কল্পনায় সেকালকে আচ্ছন্ন করার এই পদ্ধতি ইংরেজ প্রশাসকদের ছেড়ে-যাওয়া জুতোতে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পা গলানোর ফলেই নব্য হিন্দুত্ববাদীদের অধিগত হয়েছে।