প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
আমরা ছেলেবেলা থেকে শুনতাম, মুর্শিদাবাদ পিছিয়ে পড়া জেলা। বর্তমানে কিন্তু সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই ‘পিছিয়ে পড়া’ তকমা অনেকটাই মুছে গেছে। লক্ষ করার বিষয় হল, রাজনীতিতে আজও ওই ‘পিছিয়ে পড়া’ ভাবটি বহমান, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে মোট জনসংখ্যা ৭১,০৩,৪০৭। পুরুষ ৩৬,২৭,৫৬৪ জন এবং মহিলা ৩৪,৭৬,২৪৩ জন। ২০২৪ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার জনসংখ্যা আনুমানিক ৮৭.১০ লক্ষ।
একটু দেখা যাক বিধানসভা-ভিত্তিক পুরুষ-মহিলার আনুপাতিক হার, কেননা সংখ্যা অনেক কিছু বলে। ফরাক্কায় মহিলা ভোটার ৪৯.৬৪%, পুরুষ ভোটার ৫০.৩৫%। শামশেরগঞ্জে মহিলা ভোটার ৫০.৮৪%, পুরুষ ভোটার ৪৯.২%। সুতিতে মহিলা ভোটার ৪৯.৭০%, পুরুষ ভোটার ৫০.২৯%। জঙ্গিপুরে মহিলা ভোটার ৪৯.০৯%, পুরুষ ভোটার ৫০.০৯%। রঘুনাথগঞ্জে মহিলা ভোটার ৪৯.৬৩%, পুরুষ ভোটার ৫১.১২%। সাগরদিঘিতে মহিলা ভোটার ৪৯.২৪%, পুরুষ ভোটার ৫০.৭৫%। লালগোলায় মহিলা ভোটার ৪৮.৯৭% পুরুষ ভোটার ৫৩.২৩%। কান্দিতে মহিলা ভোটার ৪৮.১৮%, পুরুষ ভোটার ৫০.৮১%। ভরতপুরে মহিলা ভোটার ৪৮.৭০%, পুরুষ ভোটার ৫১.২৯%। রেজিনগরে মহিলা ভোটার ৪৮.৫৯%, পুরুষ ভোটার ৫১.৩৯%। বেলডাঙায় মহিলা ভোটার ৪৮.৮৩%, পুরুষ ভোটার ৫১.১৬%। বহরমপুরে মহিলা ভোটার ৫০.৯৯%, পুরুষ ভোটার ৪৮.৯৯%। নওদাতে মহিলা ভোটার ৪৮.৪৪%, পুরুষ ভোটার ৫১.১১%। ভগবানগোলায় মহিলা ভোটার ৪৮.৬৭%, পুরুষ ভোটার ৫১.৩২%। রানিনগরে মহিলা ভোটার ৪৯.০১%, পুরুষ ভোটার ৫০.৯৮%। মুর্শিদাবাদে— মহিলা ভোটার ৪৯.৭২%, পুরুষ ভোটার ৫১.২৭%। ডোমকলে মহিলা ভোটার ৪৯.১৬%, পুরুষ ভোটার ৫০.৪২%। জলঙ্গিতে মহিলা ভোটার ৪৮.৬৫%, পুরুষ ভোটার ৫১.৪৩%।
তালিকাটি দীর্ঘ হল। কিন্তু তালিকা খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে, বহরমপুর ও শামশেরগঞ্জ বিধানসভায় মহিলা ভোটার তুলনায় বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই ওই দুই আসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মহিলা-প্রার্থী দেওয়া আবশ্যক। বাকি বিধানসভাগুলোয় শতাংশের বিচারে অন্তত ২২ আসনের বিধানসভায় ১০ জন মহিলা-প্রার্থী দাবিদার। লোকসভার তিনটি আসনে ন্যূনতম এক জন মহিলা-প্রার্থী কাম্য। অথচ দেখা যাচ্ছে, গত বিধানসভা নির্বাচনে (২০২১) তৃণমূল দু’জন মহিলা-প্রার্থী দিয়েছিল: এক জন হেরেছেন, এক জন জিতেছেন। সিপিএম-কংগ্রেস জোট মাত্র এক জন মহিলা-প্রার্থী দিয়েছিল, বিজেপি-ও এক জন। গত লোকসভায় (২০১৯) মুর্শিদাবাদ জেলায় তিনটি আসনে বিজেপি এক জন মহিলা-প্রার্থী দিয়েছিল, সিপিএম, কংগ্রেস, তৃণমূল কোনও মহিলা-প্রার্থী দেয়নি। এ বারের লোকসভায় কোনও দলই মহিলা-প্রার্থী দেয়নি। অথচ সব রাজনৈতিক দলের পাখির চোখ মহিলা-ভোট। জেলা পরিষদে ৭৮ আসন রয়েছে, গত পঞ্চায়েত ভোটে ৪২ জন মহিলা জিতেছেন। সেখানেও অর্থ উন্নয়ন সমিতির বোর্ডে মোট ১১ সদস্যের মাত্র চার জন মহিলা। থাকা উচিত ন্যূনতম ৬ জন।
এ থেকে স্পষ্ট, ক্ষমতায়নে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণের প্রধান অন্তরায় রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই নারীকে ব্যবহার করা হয়। নারী-অধিকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যতই বড় বড় কথা বলুক, রাজনৈতিক ভাবে নারীর ক্ষমতায়নে সবার অনাগ্রহ স্পষ্ট।
মুর্শিদাবাদ জেলায় ৩১টি ব্লক, ২৬টি পঞ্চায়েত সমিতি ও ২৫০টি গ্রাম পঞ্চায়েত। পুরসভা ৮টি। বর্তমানে ২৬টি ব্লকের কোথাও মূল সংগঠনের দায়িত্বে তৃণমূলের কোনও মহিলা-সভাপতি নেই, সিপিএম-এরও না। অতি সম্প্রতি কংগ্রেস দু’জন মহিলাকে ব্লক সভাপতি করেছে। তৃণমূলের এক জন জেলা সভাপতি হয়েছিলেন; কংগ্রেস, সিপিএম ও বিজেপি কখনও কোনও মহিলাকে জেলা সভাপতি করেনি। একই চিত্র পুরসভাতেও। অর্ধেক আকাশ ব্রাত্য, সব রাজনৈতিক দলের কাছে।
বাস্তবচিত্র কিন্তু তা বলে না। মুর্শিদাবাদের মহিলারা অনেক বেশি রাজনীতি-সচেতন। বহু মহিলা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অনেক দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। ব্যাঙ্ক চালাচ্ছেন, ব্যবসা করছেন। মহিলারা যে দলকেও অনেক বেশি দিতে পারেন তার প্রমাণ ভোট এলেই বোঝা যায়। তখন মেয়েদের কদর বাড়ে। বাড়ি বাড়ি প্রচারে, জনসভায় মাঠ ভরাতে হাতিয়ার মহিলারা। সব রাজনৈতিক দলের পাখির চোখ মহিলা-ভোট। জনসভাগুলোয় মঞ্চের সবচেয়ে কাছে মেয়েদের বসার জায়গা করা হয়; যত ক্ষণ না সভা শেষ হবে, তাঁরা ধৈর্য সহকারে বসে থাকবেন। নেতাদের আসতে দেরি হলেও অপেক্ষা করবেন। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এঁরা অনুগত, বিশ্বস্ত, কিন্তু নীতি তৈরির ক্ষেত্রে ওঁদের জায়গা ছাড়া হবে না। হবে না প্রকৃত ক্ষমতায়নও। তাই শুধু রাজনীতিই নয়, অধিকারবোধ সম্পর্কেও মুর্শিদাবাদ জেলার মহিলাদের সম্যক সচেতন হওয়া জরুরি। নইলে এই জেলা ক্রমাগত রাজনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়বে।