language

ভাষা, লিপি, বই, মেলা

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার পুঁথি, গ্রন্থ ইত্যাদির সর্ববৃহৎ সংগ্রহ ছিল মিশরে আলেকজ়ান্দ্রিয়ায়, সিজ়ারের সঙ্গে দ্বৈরথে তার আগুনে পুড়ে ধ্বংস হওয়ার ঘটনাও লেখা আছে ইতিহাসে।

Advertisement

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৪৬
Share:

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

মানুষের মুখে শব্দ-নিঃসৃত কথার ভাষা শুরু হয় দেড় লক্ষ বছর আগে। নিয়েনডারথালরা কথা বলত, কিন্তু স্বরবর্ণ ব্যতিরেকে। সঙ্কেতময় বহমান সংস্কৃতির ধারাকে কথা ও ভাষায় রূপান্তরের ক্ষমতা মানুষ ক্রমে অর্জন করেছে; চিন্তা, কল্পনা ও আবেগের সঙ্গে ভাষার অর্থপূর্ণ সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। পরিব্রাজক মানুষ ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যখন যে ভৌগোলিক অবস্থানে গেছে, সেখানকার পরিবেশ ও আবহাওয়ায় তৈরি হয়েছে কথা বলার অভ্যাস, আঞ্চলিক ভাষা। কথা-বলা মানুষের আবেগ প্রকাশ পেল গুহাচিত্রে, পশুপাখি গাছ শিকার নিত্যকর্মের ছবিতে। কথার ভাষা, শব্দ সাঙ্কেতিক চিহ্নে প্রকাশ পেল মাটির ট্যাবলেটে, পাথরের গায়ে। সুমেরীয় ও মিশরীয় শব্দ-লিপি পেলাম আমরা, সিন্ধু সভ্যতায় মুদ্রার লিপিও। পাথরের গায়ে লিপি খোদাই করে খবর তৈরি হত প্রাচীন গ্রিসে, ডেলফিতে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দ থেকে মিশরে হল প্যাপিরাসের উপর লেখার চল, অনেক পুঁথি তৈরি হলে তা সংগ্রহের জন্য তৈরি হল গ্রন্থাগার।

Advertisement

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার পুঁথি, গ্রন্থ ইত্যাদির সর্ববৃহৎ সংগ্রহ ছিল মিশরে আলেকজ়ান্দ্রিয়ায়, সিজ়ারের সঙ্গে দ্বৈরথে তার আগুনে পুড়ে ধ্বংস হওয়ার ঘটনাও লেখা আছে ইতিহাসে। তুরস্কের এফেসাসে ছিল আর এক প্রাচীন গ্রন্থাগার, বারো হাজারেরও বেশি পুঁথির বিপুল সংগ্রহ— একাধিক বার ভূমিকম্পে সে-ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। সে সময় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল গ্রন্থাগার। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে চিন-এ প্যাপিরাসের স্থান নিল কাগজ, সেখানেই সপ্তম শতকে কাঠের ব্লকে কাগজে ছাপা শুরু। সেই সঙ্গে বই ছাপা-ও। নবম শতকে মরক্কোয় তৈরি লাইব্রেরি বর্তমানে প্রাচীনতম বলে কথিত। গুটেনবার্গের ছাপাখানার হাত ধরে পঞ্চদশ শতকে পশ্চিমের মুদ্রণশিল্পে বিপ্লব ঘটে, আধুনিক মুদ্রণশিল্প ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। বই ছাপা শুরু হয় প্রায় সব ভাষায়। সাধারণ মানুষের নাগালে আসে বই, অভ্যাস তৈরি হয় বই পড়ার।

মুদ্রণশিল্প ব্লক থেকে ‘মুভেবল টাইপ’ প্রেসে উন্নীত হল, আধুনিক ছাপাখানায় বই ছাপানোর জন্য ভিড়ও জমতে শুরু করল। ধর্মীয় প্রচারকেরা তাঁদের বার্তা মুদ্রিত বইয়ের মাধ্যমে এক সঙ্গে অনেক লোকের কাছে কম সময়ে পৌঁছে দিতে পারলেন। একই সঙ্গে তা সুযোগ করে দিল দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদদেরও, যন্ত্রের দ্বারা দ্রুত প্রতিলিপি তৈরি করে নিজস্ব মতামতের প্রচার-প্রসারে। এলেন প্রকাশক, শুরু হল বই কেনা-বেচার ব্যবসা। দোকানে রাখা শুরু হল বই। ক্রমে বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের আলাদা দোকান তৈরি হল। বই-বাজারের সেই যাত্রা আজও অব্যাহত।

Advertisement

দোকানে গিয়ে পাঠকের বই বাছায় অসুবিধা, পর্যাপ্ত বই না থাকায় পাঠকের বই পছন্দে একটা ঘাটতি প্রকাশকেরা অনুভব করছিলেন। সেই থেকেই আসে বই নিয়ে মেলার চিন্তা। মুদ্রক ও প্রকাশকেরা বইমেলার সূচনা করেন জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফার্টে, আজ থেকে পাঁচশো বছরেরও আগে। পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধে ইউরোপ থেকে প্রকাশকেরা বই এনে বিক্রি করা শুরু করেন। অবশ্য সে দিক থেকে দেখলে এই বইমেলার ইতিহাস আরও পুরনো, দ্বাদশ শতকেই সাধারণ বাণিজ্যমেলায় হাতে লেখা পুঁথি নিয়ে বসত দোকান। পাঁচশো বছর ধরে প্রতি অক্টোবরে চলছে ফ্র্যাঙ্কফার্টের বইমেলা, বিশ্বে সর্ববৃহৎ। বর্তমানে শতাধিক দেশের সাড়ে সাত হাজার প্রদর্শক এই মেলায় যোগ দেন, তিন লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়। ১৬৩২-এ লাইপজ়িগ শহরে বইমেলা শুরু হলে এর আভিজাত্য কমে যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৯ থেকে ফ্র্যাঙ্কফার্ট তার হৃতগৌরব ফিরে পায়।

১৯১৮-র কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটে এক বই প্রদর্শনী হয়, বারাণসীর মতিলাল বনারসীদাস পাবলিশার্স ও কলকাতার বসুমতী যোগ দেয় সেখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬২ সালে বইমেলা হয়েছিল, মূলত শিশুদের বই ছিল বেশি। এর পর নারায়ণগঞ্জে বইমেলা হয় ১৯৭০ সালে। নয়াদিল্লিতে ১৯৭২-এ শুরু হয় বিশ্ব বইমেলা, দু’শো প্রকাশক-বিক্রেতার অংশগ্রহণে। কলকাতার পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড কলকাতা বইমেলা শুরু করে ১৯৭৬ সালে, পার্ক স্ট্রিটের পশ্চিম প্রান্তের উল্টো দিকে ময়দানে। পাঠকের আগ্রহে কয়েক বছরের মধ্যেই মেলা বড় আকার নেয়, ময়দানের অপর প্রান্তে বিশাল অংশ জুড়ে বসে মেলা। মিলন মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে বইমেলা এখন থিতু সল্ট লেকের সেন্ট্রাল পার্কে। নানা দেশের প্রকাশকদের আগমনে কলকাতা বইমেলা এখন আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত; ফ্র্যাঙ্কফার্ট ও লন্ডন বইমেলার পরেই সে তৃতীয় স্থানে, এশিয়ায় প্রথম। মেলায় লোকসমাগম বিশ্বে রেকর্ড তৈরি করেছে।

বইমেলার প্রধান উদ্দেশ্য সারা পৃথিবীর বইয়ের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করানো। শুরুর দিকে সেই পরিবেশও ছিল; স্টলে পছন্দের বই নিয়ে চেয়ারে বসে পড়াও যেত। বইপ্রেমী পাঠক এক দিনে দু’-তিনটে স্টলে বসে বই পড়তেন, বিপত্তি ঘটত না। লেখকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয়ের সুযোগ ছিল। বইয়ের স্টল যত বেড়েছে, মেলার এলাকা ও পরিধিও বৃদ্ধি পেয়েছে, লোকের ভিড় বেড়েছে তারও বেশি। মেলা এখন জমজমাট, শুধু হারিয়ে গেছে স্টলে বসে বই পড়ার অবসরটুকু।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement