আমাদের শ্যামল-সুনীল দেশটি, বিশেষত এর পূর্বাঞ্চল, গড়া হয়েছে আবহমান কালের পলিমাটি দিয়ে— শিশুপাঠ্য বইয়ের এই কথাটা আজ প্রায়ই মনে থাকে না। দূর উঁচু এলাকা থেকে বৃষ্টির প্রবল জল সঙ্গে করে নিয়ে আসে লক্ষ লক্ষ টন মাটি, তাকে বিছিয়ে দিতে থাকে নিচু জমি জুড়ে, সেই জমি ঢেকে যায় সমৃদ্ধ মিহি মাটির আস্তরণে। বীজ সহজেই শিকড় ছড়ায় তাতে। কোনও বিশাল পরিকল্পনা ছাড়া, লক্ষ-কোটি টাকার প্রকল্প ছাড়া, পরিবহণ ব্যবস্থা বা রাস্তা তৈরি ছাড়াই, এই বিশাল ও জটিল ব্যবস্থাটা চলে আসছে কয়েক কোটি বছর ধরে। আমাদের ভূপৃষ্ঠের রূপ তৈরি করেছে জলের নীচের দিকে গড়িয়ে যাওয়ার নিয়ম।
অন্তত পাঁচ হাজার বছর ধরে পূর্ব ভারতের মানুষজন সেই নিয়মের সঙ্গে মিলিয়ে অপূর্ব কুশলতায় বুনেছেন নিজেদের জীবন আর জীবিকার মূল রূপটি— কৃষিকাজ। বন্যাকে ভয় পেলেও, সমীহ করলেও তার নিয়ম মেনেই তাকে কাজে লাগানো হয়েছে অভিজ্ঞতালব্ধ দক্ষতায়। অথচ, গত মাত্র ৭০-৭৫ বছরে ধনতন্ত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার লোভে সেই বন্যাজলের পথ রোধ করে তাকে ‘কাজে লাগানো’র কথা ভাবল। যাঁদের দেশে বড় নদী ছিল না, সেই ঔপনিবেশিক শাসকেরা পূর্ব ভারতের নদীদের দেখলেন বিপদ হিসেবে— ‘বিহারের দুঃখ কোশী’, ‘ছোটনাগপুরের দুঃখ দামোদর’, ‘অসমের দুঃখ ব্রহ্মপুত্র’ বলে। এদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাগা ‘মুন্ডাদের জল’ দামোদর, কারণ এর অববাহিকা অঞ্চলে বিশ্বযুদ্ধের সমসময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে কয়লা, লোহা, সস্তা শ্রমশক্তি। বাঁধ দিয়ে দামোদর-বরাকর অববাহিকাকে শাসন করার স্বপ্ন দেখলেন বিদেশিদের সঙ্গে স্বদেশি প্রভুরাও।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জল ও কৃষির উন্নতিকল্পে ১৯৪৮ সালে ভারতে তৈরি হল ডিভিসি— দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন। তার ফল আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আজ। আমাদের রাজ্যের বাঁয়ে গঙ্গানদীর পায়ের শিকল ফরাক্কা আর ডাইনে গলার পাথর ডিভিসি। এক দিকে পর পর বাঁধে জলবঞ্চিত উত্তর ভারত জুড়ে গঙ্গানদীর হাড়পাঁজরা বেরিয়ে এসেছে। অন্য দিকে, তিন দিন জোর বৃষ্টি হলে ডিভিসি-র লকগেট খুলে এক রাতে সোয়া লক্ষ কিউসেক জলের প্রলয় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিম্ন দামোদরের উপর। গত এক দশক বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দৃঢ় হস্তক্ষেপে সেই ভয়ঙ্করতা কিছু কমেছে। আগে সতর্কবার্তা দিতে হয়, জল ছাড়তে হয় অনেক সামলে— কিন্তু বিপদ যখন অতিবাস্তব, তখন কতটুকু আর সুরক্ষা! যেমন ঘটল এই ২০২১-এ। অথচ, হড়পা বানের নদী এই দামোদর বরাকর ওই তীব্র স্রোতের বন্যায় প্রতি বছর নিজেদের খাত পরিষ্কার ও গভীর করা ছাড়াও গঙ্গার মুখে জমা লক্ষ লক্ষ টন পলি ঠেলে সমুদ্রে ফেলে জাহ্নবীর মুখের নাব্যতা বজায় রাখত। অবৈজ্ঞানিক কোনও ড্রেজিং-এর ব্যবস্থা ছাড়াই।
কেন আমাদের এই রাজ্যের বন্যার চেহারা চরিত্র এমন পাল্টে গেল ডিভিসি-র দৌলতে, সে কথার আগে এক বার দেখে নেওয়া যায় ডিভিসি-র জন্মের ইতিবৃত্ত। ১৯৩৩ সালে আমেরিকায় টেনেসি উপত্যকায় ‘টিভিএ’ নামে একটি ক্ষমতাশালী স্বয়ংশাসিত সংস্থা তৈরি হয় নদীবাঁধ তৈরির জন্য। মিসৌরির উপনদী টেনেসির উপর চারটে প্রকাণ্ড বাঁধ তৈরি হয়। এগুলোকে বলা হল বহুমুখী বাঁধ প্রকল্প, অর্থাৎ এই সব বাঁধ বর্ষাকালের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করবে, শুকনো দিনে সেচখাল দিয়ে জল ছাড়বে কৃষির সুবিধার্থে। এ ছাড়া তৈরি হবে জলবিদ্যুৎ।
বাস্তবে যদিও ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩৮টি বাঁধ নির্মাণের পরে টিভিএ প্রায় আর কোনও বাঁধ নির্মাণ করেনি, কিন্তু বিপুল প্রচারের কারণে পৃথিবীতে বহুমুখী বাঁধ তৈরি প্রকল্পের সঙ্গে টিভিএ-র নাম প্রায় সমার্থক হয়ে গেল। আমেরিকার সরকার নিজ ব্যয়ে সমস্ত পৃথিবী থেকে রাষ্ট্রনায়ক, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্য প্রযুক্তিবিদ, আমলা, সাংবাদিকদের বিরাট দলকে বারে বারে আমন্ত্রণ করে বোঝালেন, যে কোনও দু’টি নদীর সঙ্গমে এ রকম বহুমুখী বাঁধ নির্মাণ করলেই সব রকমের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, প্রথাগত চাষ সহজেই হয়ে উঠবে বিশাল কৃষিবাণিজ্যক্ষেত্র। তৈরি হবে কম খরচে পণ্য পরিবহণের সুবিধাজনক জলপথ। সঙ্গে আশ্বাসও ছিল, প্রয়োজনীয় সমস্ত প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করবে আমেরিকা। এমনকি ঋণের ব্যবস্থার দায়িত্বও তার। ফলে শুধু ভারতের দামোদর নয়, ব্রাজিলের সাও ফ্রান্সিসকো, মেক্সিকোর পাপালোয়াপান, ইরানের দেজ়— অন্তত ষোলোটি দেশের সরকার এই সর্বরোগহর প্রকল্পে রাজি হয়। সদ্যস্বাধীন নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান ভারত তার প্রথম ‘বড় কাজ’ শুরু করে দামোদর ভ্যালি পরিকল্পনার জন্য ‘ডিভিসি’ নামের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বোর্ড তৈরির মধ্য দিয়ে। দামোদরের উপর পাঞ্চেত, বরাকরের উপর মাইথন ও ঝুমরি তিলাইয়া, কোনার নদীতে কোনার— এই চারটি বড় বাঁধ। এ ছাড়া দুর্গাপুরে ব্যারাজ ও মোট ২৪৯৪ কিমি দীর্ঘ সেচখাল। নদীর স্বাভাবিক বন্যা বন্ধ হল।
সেই প্রকল্পের অন্যান্য কোনও আলোচনায় যাচ্ছি না, তার সঙ্গে আজ যে বন্যা-দুর্দশার মধ্যে আমাদের রাজ্যকে পড়তে হল তার সম্পর্ক কী হতে পারে, সেটুকু কেবল দেখে নিতে চাই।
নদী আর বড় বাঁধ, বহমান জলস্রোত আর তার মাঝখানে প্রকাণ্ড উঁচু কংক্রিটের পাঁচিল, এরা দু’টি পরস্পরবিরোধী সংস্থান। নদীতে কেবল জল বয়ে আসে না, সঙ্গে থাকে প্রচুর মাটি। জল যখন সহজে চলে, হালকা মিহি মাটি সেই জলের সঙ্গে ভেসে যায়। কিন্তু জল যখন আটকে পড়ে বাঁধের রিজ়ার্ভারে, মাটি ক্রমশই সেই রিজ়ার্ভারের পিছনে নীচে বসে যেতে থাকে। বছরের পর বছর ধরে সেই মাটির পরিমাণ আমাদের কল্পনার থেকেও অনেক বেশি হয়ে ওঠে। অন্য বাঁধের মতোই এ ভাবে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে ডিভিসি-র চারটি বাঁধেরই কিছু কিছু স্লুস গেট। মাটি জমে ভরাট হতে থাকে রিজ়ার্ভারগুলি আর সেচখাল।
কথা ছিল শুকনো দিনে বিভিন্ন সেচখালের মাধ্যমে রিজ়ার্ভারের জমা জল নদীর প্রবাহে ছেড়ে কৃষিকে অব্যাহত রাখা হবে। তার ফলে রিজ়ার্ভার অনেকটা খালি হলে বর্ষায় এসে পড়া অতিরিক্ত জল সেখানে থাকবে। এ ছাড়া হবে জলবিদ্যুতের ব্যবস্থা। হিসাব করা হয়নি, সারা বছর নদীর পাশের সব জমিতে চাষ হলে আলগা মাটি সারা বছর অবিশ্রাম নেমে আসবে নদীর খাতে। তীরের জঙ্গল বা তৃণভূমি হারানোর ফলও হবে তা-ই। বাঁধের সামনের দিকে নদীর জলবিরল অংশের লোকেদের মনে নদী সম্পর্কে সতর্কতা চলে যাবে, নদীর ভিতরে পর্যন্ত খেত বাড়ি রাস্তা তৈরি হবে। ভরাট হয়ে যেতে থাকবে নদী ও সেচখালের খাত। ঠিক সেটাই হয়েছে। ১৯৫৩ সালের পর থেকে আজ অবধি কখনও আর গভীর করে কাটা হয়নি সেচখালগুলো। নদীখাত ভরে গিয়েছে। রিজ়ার্ভারে জলের জায়গায় দ্রুত ভরে উঠছে বেহিসাব মাটি-বালি।
২০১৮ সালের ৩১ জুনের কেন্দ্রীয় জল কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দেশের ১৮টি রাজ্যের ১২টি প্রধান নদীর উপরে স্থিত মোট ৯১টি বাঁধের রিজ়ার্ভারের জলধারণ ক্ষমতা আশঙ্কাজনক ভাবে কম। রিজ়ার্ভারের স্টোরেজ ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলের সঙ্গে বয়ে আসা মাটি-বালিতে। গত তিন বছরে সেই মাটি-বালি আসা বেড়েছে বই কমেনি।
নদী ভূভাগের সবচেয়ে নিচু অংশ। কাজেই সমগ্র অববাহিকার যেখানে যা কিছু বস্তু উদ্বৃত্ত বা আবর্জনা, তা শেষ পর্যন্ত নদীতেই এসে নামবে, এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে যত্রতত্র নগরায়ণের আবর্জনা, এমনকি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়া হিমালয় পর্বতের অংশ, এই সব কিছুই আছে। মুক্ত নদী নিজের স্বভাবেই স্বাভাবিক মাটি বয়ে নিয়ে যায়, তাকে বন্যাজলের সঙ্গে দু’পাশে ছড়িয়ে জলপথের গভীরতা বজায় রাখে। প্রকৃতির সব কিছুই থাকে পরস্পর সংলগ্ন। এই প্রাথমিক কথাটা ভুলে মানুষ যখন তাঁর কোনও একটি সংস্থানকে নিজের বুদ্ধি বা পছন্দমতো বদলানোর চেষ্টা করেন, তখন সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েন নিজেই। ২০২১-এর বন্যা আবার আমাদের সে কথাটা কঠিন করে বোঝাচ্ছে।
কিছু মানুষ মনে করেন, তাঁরা প্রকৃতির চেয়ে শক্তিশালী। তাই সেচখাল যথেষ্ট নয় বলে খেত জুড়ে লক্ষ লক্ষ পাম্পও অক্লেশেই ব্যবস্থা করেন। আর প্রচারে বিহ্বল বিরাট সংখ্যক মানুষ ডুবতে থাকেন দুর্দশার অতলে।