NEET Scam 2024

পরীক্ষাব্যবস্থায় ভরসা ফেরাতে

পরীক্ষা ত্রুটিমুক্ত রাখতে বেশ কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, যা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। যিনি পরীক্ষা নিয়ামক কমিটির চেয়ারম্যান হবেন, তাঁকে এই নির্দেশাবলি মেনে চলতে হয়।

Advertisement

অজয়কুমার রায়

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৪ ০৮:৩২
Share:

—ফাইল চিত্র।

এ বার সারা দেশে নয় লক্ষেরও বেশি ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট বা নেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ফর্ম ভরেছিলেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সহকারী অধ্যাপক পদে, বা জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসাবে যোগ দেওয়া যায়। গত কয়েক বছর পরীক্ষা হয়েছিল কম্পিউটারের মাধ্যমে; এ বারে হল ওএমআর পদ্ধতিতে, অর্থাৎ কাগজ-কলমে। এ দিকে পরীক্ষার পর দিনই কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক বিবৃতি দিয়ে জানাল, ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ) দ্বারা পরিচালিত এই পরীক্ষাটি বাতিল করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম থ্রেট অ্যানালিটিক্স ইউনিট নাকি জানিয়েছে, পরীক্ষার মধ্যে উদ্বেগজনক অনিয়মের ইঙ্গিত মিলেছে। দিন কয়েক আগেই চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠক্রমের প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট-এ বিপুল গরমিলের সন্ধান মিলেছিল। উল্লেখযোগ্য যে, সেই পরীক্ষাটিও পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সিই। ২০১৭ সালে এনটিএ চালু হওয়ার পরে এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই অনেকগুলি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে বড় ধরনের দুর্নীতির আভাস পাওয়া গিয়েছে।

Advertisement

১৯৮৯-এ চালু হয়েছিল ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট বা নেট। তার দায়িত্বে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। ২০১২ সালে এই পরীক্ষার কাঠামোয় একটা পরিবর্তন করা হল— দীর্ঘ উত্তরভিত্তিক পরীক্ষা থেকে নেট হয়ে উঠল মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চন (এমসিকিউ) বা প্রদত্ত একাধিক উত্তরের মধ্য থেকে সঠিক উত্তরটি বেছে নেওয়ার পরীক্ষা। এই জাতীয় পরীক্ষায় সচরাচর নেগেটিভ মার্কিং থাকে, অর্থাৎ ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটা যায়— কিন্তু, নেট-এর ক্ষেত্রে সে নিয়ম রাখা হল না। এমসিকিউ-এর মাধ্যমে গবেষণা বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার যোগ্যতা নির্ধারণ করা যায় কি না, সে প্রশ্ন বারে বারেই উঠেছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে পরীক্ষাটি পরিচালনার ভার পায় এনটিএ। শুরু হয় কম্পিউটার-বেসড টেস্ট (সিবিটি)। এই জুনের বাতিল হওয়া পরীক্ষাটি কেন সিবিটি পদ্ধতিতে না হয়ে ফের কাগজ-কলমে নেওয়া হয়েছিল, সে প্রশ্নও থাকছে।

জুন মাসের নেট পরীক্ষায় কী ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, সেই তদন্তের ভার সিবিআইকে দেওয়া হয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটির উপরে ছাত্রছাত্রীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে স্বচ্ছ তদন্ত চাই, এবং তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ হতে হবে। অপরাধীদের কঠোর শাস্তিও প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই নেট-এর নতুন তারিখ ঘোষিত হয়েছে। আশঙ্কা হয়, যাঁরা সেই পরীক্ষায় বসবেন, তাঁরা মনে পরীক্ষাটির সম্বন্ধে সংশয় নিয়েই বসবেন। এমন পরিস্থিতি একেবারেই কাম্য নয়।

Advertisement

কিন্তু, পরীক্ষাটি সম্বন্ধে ছাত্রছাত্রীদের আস্থা ফেরানোর জন্য এই দুর্নীতির তদন্ত হওয়াই যথেষ্ট নয়। পরীক্ষা ব্যবস্থাটির খোলনলচে নিয়ে ভাবতে হবে। স্বচ্ছ ভাবে এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যে সর্বভারতীয় যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষার আয়োজন করা সম্ভব, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রয়েছে আইআইটি-র পরীক্ষায়। দীর্ঘ সময় ধরে দেশের আইআইটিগুলি সম্মিলিত ভাবে এই পরীক্ষা নিয়ে চলেছে। তার মডেলটি অনুসরণ করা যেতে পারে। পরীক্ষা যে-হেতু কম্পিউটার-নির্ভর, ফলে তথ্যের নিরাপত্তার দিকে বিশেষ ভাবে নজর দিতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া আটকাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সম্পূর্ণ ভাবে ডিজিটাল প্রশ্নপত্র ও অনলাইন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। এতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাবনা অনেকখানি কমবে। তবে, ডার্কনেট-এর মাধ্যমে ডিজিটাল প্রশ্নপত্রও ফাঁস হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তথ্য নিরাপত্তার দিকে আরও জোর দিতে হবে। পরীক্ষার্থীরা যাতে কোনও অসৎ উপায় অবলম্বন না করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করার জন্য কৃত্রিম মেধার ব্যবহারের পথও খোলা রয়েছে।

পরীক্ষা ত্রুটিমুক্ত রাখতে বেশ কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, যা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। যিনি পরীক্ষা নিয়ামক কমিটির চেয়ারম্যান হবেন, তাঁকে এই নির্দেশাবলি মেনে চলতে হয়। এনটিএ-তে তা করা হয় কি না, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এত দিন যদি না-ও হয়ে থাকে, এ বার নিয়মানুবর্তী হওয়া জরুরি। নিট ও নেট-এর জোড়া কেলেঙ্কারির পর কেন্দ্রীয় সরকার এনটিএ-র অধিকর্তা সুবোধকুমার সিংহকে সরিয়ে অবসরপ্রাপ্ত আমলা প্রদীপ সিংহ খারোলাকে নতুন অধিকর্তা হিসাবে নিয়োগ করেছে। বিভিন্ন দফতর বা প্রকল্প পরিচালনার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। এমন পরীক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনায় তাঁর যোগ্যতম সহযোগী হতে পারেন কোনও অভিজ্ঞ অধ্যাপক; বিশেষত এমন কেউ, কম্পিউটার বিজ্ঞান সম্বন্ধে যাঁর সম্যক ধারণা রয়েছে।

এনটিএ-র প্রধান পদে তো বটেই, শিক্ষাক্ষেত্রে কোনও পদেই নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্যের কথা বিবেচনা করা উচিত নয়— যোগ্যতাই একমাত্র বিবেচ্য হওয়া বিধেয়। তবে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে সে আশা করতে সাহস হয় না।

এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির জন্য জেইই-মেনস, ডাক্তারি পাঠক্রমের জন্য নিট, ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্যাট, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্নাতক স্তরে ভর্তির জন্য কমন ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্ট (কুয়েট)— এমন বহু পরীক্ষা পরিচালনার ভার এনটিএ-র উপরে ন্যস্ত। এই বিপুল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে যথেষ্ট সংখ্যক দক্ষ কর্মী প্রয়োজন। কিন্তু, বর্তমানে খুবই অল্পসংখ্যক স্থায়ী কর্মীর দ্বারা পুরো ব্যাপারটা পরিচালিত হয়। প্রশ্নপত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ হয় বহিরাগত বিশেষজ্ঞদের দ্বারা; প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেও বাইরে থেকে সহায়তা নিতে হয়। বলা বাহুল্য যে, এমন পরিস্থিতিতে তথ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। যে এজেন্সির উপরে দেশ জুড়ে এত ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে, তার ক্ষেত্রে সরকারের আরও মনোযোগী হওয়া জরুরি নয় কি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement