NEET Scam

নিট-এ ঢাকা অন্ধকার

প্রতি দিন স্পষ্ট হচ্ছে সরকারের পিছু হটা এবং লাগামছাড়া রোজগারের ক্ষেত্র হিসাবে পুরো মাঠটাকে বেসরকারি বিনিয়োগের হাতে ছেড়ে দেওয়া।

Advertisement

অভিজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৪ ০৮:০৮
Share:

—ফাইল চিত্র।

লেখাপড়ায় ভাল ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি পড়বে। ডাক্তারিই পড়বে। এই সযত্নলালিত সামাজিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে উপরি হিসাবে এসেছে পাশ করার পর ‘অচ্ছে’ প্যাকেজ। এক বার ডাক্তারিতে ঢুকে পড়তে পারলে অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আয় আকাশছোঁয়া। এ অবস্থায় ডাক্তারি পড়ার জন্য আকুলতা স্বাভাবিক। এ দিকে, স্বাস্থ্যক্ষেত্র থেকে সরকার ক্রমশ সরে যাচ্ছে। জাঁকিয়ে বসছে কর্পোরেট। লাভকে মোক্ষ করে আধুনিক হওয়ার পথে হেঁটে চলেছে দেশ।

Advertisement

সেই স্বর্গদ্বারে বিশৃঙ্খলার ছবি এখন প্রকাশ্যে। ডাক্তারির পাঠক্রমে ভর্তি হতে গেলে যে সাড়ে তিন ঘণ্টার সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসতে হয়, তার নাম ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট, সংক্ষেপে এনইইটি বা ‘নিট’। মেধার সমতাবিধানের নামে এই খেলা শুরু হয়েছে বছর আষ্টেক। যে পাঠক্রম মুখ্যত টাকা রোজগারের রাস্তা, তাতে জায়গা পেতে গেলে ভারতের মতো দেশে টাকার খেলা থাকবে না, তা কি হয়? তাই এত বেনিয়ম। কুকর্মের কর্তারা এখন আগুন চাপা দিতে ব্যস্ত।

নিট-এর বেনিয়ম নিয়ে হইচই হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভাবখানা এমন, যেন এ-বারেরটা দুর্ঘটনা মাত্র— ত্রুটি সংশোধন এবং এই বেনিয়মের পুনরাবৃত্তি না-হওয়ার জাদু-ঔষধি যেন ব্যবস্থাপকদের হাতের তালুর মধ্যে এসে গেছে। আগামী বছরে নিট পরীক্ষা যাতে ছিদ্রহীন ও শুধুমাত্র মেধাস্পর্শী হয়ে উঠতে পারে, তার জন্য সব ব্যবস্থা এখন থেকেই করা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। এই স্তোকবাক্যের মধ্যে ঢুকে আছে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করা, সামাজিক বৈষম্যের মূর্ত প্রতীক এক ব্যবস্থাকে দাঁড় করিয়ে রাখা। নিট পরীক্ষায় বেনিয়ম নতুন কিছু নয়। প্রতি বছর এমনটাই ঘটে থাকে বলে ওয়াকিবহাল মহল জানে। এ বারে আবর্জনার জল রাজপথ পেরিয়ে জনপদে ঢুকে পড়াতেই এত হট্টগোল।

Advertisement

তবে, এই সাময়িক কেলেঙ্কারি থেকে নজর সরিয়ে বৃহত্তর প্রশ্নটি উত্থাপন করা প্রয়োজন— সাড়ে তিন ঘণ্টার এই টিক মারার পরীক্ষা কি আদৌ তার অভীষ্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? কে ধীমান আর কে কম মেধাবী, এটা অঙ্কের নিয়মে বিভাজনের জন্য যে পদ্ধতি, তা দিয়ে বিচার করা যায় না। সত্যিকারের মেধাবী চয়নের বদলে এই পরীক্ষায় যা করা হয়, তা হচ্ছে ধীমান এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যের মঞ্চ থেকে অপসারণ। কৌশল এবং চকিতে অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পটুত্বই এই পরীক্ষায় সাফল্যের চাবিকাঠি।

এই একটি পরীক্ষাকে জীবনের ধ্রুবতারা করায় ছাত্রছাত্রীদের সিংহভাগের মধ্যে তৈরি হয় মূল বিষয় ভাল করে বোঝার প্রয়োজনীয়তার প্রতি অশ্রদ্ধা। নিতান্তই অগভীর বিষয়জ্ঞান নিয়ে তারা ঢুকে পড়ে এমন জ্ঞানচর্চার জগতে, যেখানে বিজ্ঞানের সমৃদ্ধি ও মানবিক সংবেদনশীলতা হাত ধরাধরি করে চলে। ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অমসৃণ পথে হাঁটতে গিয়ে এরা হয়ে পড়ে দাবার বোড়ে। প্রবেশিকা পরীক্ষায় সাফল্যের উজ্জ্বল আলোয় যতগুলো মুখ উদ্ভাসিত হয়, তার বহু গুণ ডুবে যায় আঁধারে। এক বার নয়, দু’বার, তিন বার এমন কি ছ’সাত বার নিট পরীক্ষায় বসেছে, এমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নগণ্য নয়।

যে দেশ সকলের সামনে শিক্ষার সমান সুযোগ তুলে ধরতে পারেনি, সেই দেশে মেধার সমীকরণের নামে এ রকম একটা পরীক্ষার বাঁধনে সবাইকে বাঁধার চেষ্টা সামাজিক ন্যায়ের ভাবনার পরিপন্থী নয় কি? মেধার বিকাশের সুযোগ যারা পায়নি, এবং জীবনের প্রথম দিন থেকে আলো পাওয়া সৌভাগ্যবানেরা যখন একই মানদণ্ডে পরীক্ষিত হয়, তখন তার ফল আগে থেকেই বলে দেওয়া যায়। অথচ ‘সবকা বিকাস’ আওড়াতে আওড়াতে আমরা নিটের মতো পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে সামাজিক বৈষম্যের বারান্দাটাকে আরও চওড়া করছি।

প্রতি দিন স্পষ্ট হচ্ছে সরকারের পিছু হটা এবং লাগামছাড়া রোজগারের ক্ষেত্র হিসাবে পুরো মাঠটাকে বেসরকারি বিনিয়োগের হাতে ছেড়ে দেওয়া। চিকিৎসা শিক্ষার কারখানায় এখন পুঁজি-বিনিয়োগের বান। চিকিৎসা শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির নামে সরকারের সস্নেহ প্রশ্রয়ে বেড়ে চলা এই প্রতিষ্ঠানগুলি আদতে ‘বিপরীতমুখী সংরক্ষণ’-এর সুনিশ্চিত পদ্ধতি। বড়লোকের ছেলেমেয়েরাই শুধু ডাক্তারি পড়ে, এই মধ্যযুগ-লালিত প্রবচন এখন নতুন রূপে ফিরে এসেছে। চিকিৎসা শিক্ষার গুণমানের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই যে আয়োজন, নিটকেন্দ্রিক বাৎসরিক দুর্নীতি তারই অংশবিশেষ।

তা হলে পথ কী? মেধার মূল্যায়ন এবং সামাজিক ন্যায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য করে চিকিৎসাশিক্ষার প্রবেশিকার এক পদ্ধতির উদ্ভাবন। নিট-এর জায়গায় পুরনো রাজ্যভিত্তিক পরীক্ষা হতেই পারে। তাতে দুর্নীতি লোপ পাবে, এই ভাবনা যদিও অমূলক। তবে, এলাকাভিত্তিক অসমান সামাজিক বিকাশের যে ধাক্কা, রাজ্যভিত্তিক পরীক্ষা হলে তা সামলানো যাবে। আরও একটি কথা ভাবা যেতে পারে— বিভিন্ন রাজ্যের এবং সর্বভারতীয় বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার নম্বরের মধ্যে প্রথমে সমতাবিধান করে তার পর সেই নম্বরকে একটি অনুপাত হিসাবে প্রবেশিকা পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে যোগ করা যায়। তা হলে ডাক্তারি পড়তে ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের কাছে স্কুলশিক্ষা ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement