বিবর্তন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পৃথিবীতে টিকে থাকার স্বার্থে জীবের গাঠনিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্রমপরিবর্তনকে বোঝায়। প্রতীকী ছবি।
নিহিত পাতালছায়া ভরে ছিল আকাশপরিধি”— কত বছর আগে রচিত শঙ্খ ঘোষের এই অক্ষরমালা আজ যেন দেশের স্কুলপড়ুয়াদের শিক্ষার মুক্ত নীল আকাশে এক ঘটমান বর্তমান। সেই আকাশে ঘনায়মান অন্ধকার খুব সন্তর্পণে গাঢ়তর হয়ে উঠল সম্প্রতি। কোভিড-পরবর্তী সময়ে পড়ুয়াদের সিলেবাসের বোঝা লাঘব করতে গিয়ে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)-এর সরকারি বিশেষজ্ঞরা দশম শ্রেণির জীববিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ের নবম অধ্যায়টিকে নির্ভার করলেন— ‘বংশগতি ও বিবর্তনবাদ’-এর বদলেপড়ে রইল শুধুই ‘বংশগতি’।
জীববিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ্যে ডারউইনের বিবর্তনবাদকে অপরিহার্য বলেই মনে করেন বেশির ভাগ বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ। নবীন প্রজন্মের বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তোলার উপরে এই প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় ফতোয়ার বিরুদ্ধে খানিক প্রতিবাদ হচ্ছে। বিজ্ঞানচর্চায় নিবেদিত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এনসিইআরটি-র এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পাঠিয়েছেন প্রতিবাদের চিঠি। এই চিঠির স্বাক্ষরকারীদের তালিকায় রয়েছেন আইআইটি, টিআইএফআর, আইআইএসইআর-এর মতো সেরা জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৮০০ বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান-শিক্ষক, এবং শিক্ষাবিদ। এই চিঠির ফলে যে কোনও সরকারি সিদ্ধান্তেই বিন্দুমাত্র নড়চড় হবে না, অভিজ্ঞতা এ কথাটি আমাদের বুঝতে বাধ্য করেছে।
প্রায় ১৬০ বছর আগে প্রকাশিত একটা তত্ত্ব হঠাৎ আমাদের দেশে এতটা শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠল কেন? আমাদের ঘিরে থাকা এই বহুবর্ণী জীবজগতের মধ্যে মাত্র তেরো লক্ষ প্রাণী এবং সাড়ে চার লাখের মতো উদ্ভিদ-প্রজাতিকে এত দিনে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। সুদূর অতীতে মানুষের ধারণা ছিল যে, সৃষ্টির একেবারে গোড়ার দিককার জীবজগতের সঙ্গে আজকের জীবদের বিশেষ পার্থক্য নেই। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতেই জ়েনোফেন প্রথম বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিহ্নিত করলেন কিছু জীবাশ্ম। তাঁর নিরীক্ষা থেকে উঠে এল যে, জীবদেহের আকার কালের সঙ্গে পরিবেশের প্রভাবে এবং সেই পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার বা অভিযোজনের স্বার্থে যথেষ্ট পাল্টে যেতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ পরিভ্রমণকালে কেমব্রিজের সদ্য-স্নাতক এবং বছর বাইশের ডারউইনকে বিশেষ ভাবে টেনেছিল ওই অঞ্চলের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের জীববৈচিত্র। ১৮৩৭ সালে ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তনের প্রায় ২০ বছর পরে, ১৮৫৯ সালে, তাঁর সেই পরিভ্রমণের সময়েঅনুপুঙ্খ সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভিত্তিতে বিভিন্ন জৈব প্রজাতির উদ্বর্তনের তত্ত্বটি তাঁর অন দি অরিজিন অব স্পিসিস বইয়ে প্রকাশ করেন।
ল্যাটিন শব্দ ‘ইভলভেরি’ থেকে এসেছে ‘ইভলিউশন’, যা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ব্রিটিশ দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ হার্বার্ট স্পেনসার। বিবর্তন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পৃথিবীতে টিকে থাকার স্বার্থে জীবের গাঠনিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্রমপরিবর্তনকে বোঝায়। ডারউইনের তত্ত্বটি সাধারণ ভাবে বিবর্তনবাদ নামে প্রচলিত হলেও, তিনিই প্রথম বিবর্তনের কথা বলেছিলেন, এমনটা নয়। জৈব বিবর্তন যে প্রকৃতই ঘটে, সেই সম্পর্কিত ধারণা জ়েনোফেনের মতো নিজের সময় থেকে অনেক এগিয়ে থাকা কেউ কেউ প্রকাশ করেছেন বহু পূর্বে। ডারউইনের সাফল্য ছিল, জৈব-বিবর্তনের কারণ হিসাবে প্রাচীন জীবাশ্মের মতো যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণের মাধ্যমে একটা বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার প্রবর্তন, যা বিবর্তন সংক্রান্ত সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। ডারউইনের মূল তত্ত্ব এবং তার পরিবর্ধিত আধুনিক রূপ (যাকে অনেকে নিয়ো-ডারউইনিজ়ম বলে থাকেন) ঘোষণা করে যে, কোনও এক খামখেয়ালি ঈশ্বরের সময় কাটানোর অজুহাত বা ‘লীলা’ হিসাবে হঠাৎ এক দিন গোটা জীবজগৎ সৃষ্টি হয়নি— বরং রাসায়নিক বিবর্তন, অভিব্যক্তি ও অভিযোজনের চেষ্টা থেকে ভাইরাস, প্রোটোজ়োয়া, এককোষী, বহুকোষী, এ রকম বহু ধাপ পেরিয়ে কোটি কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হতে হতে আজকের মানুষ এবং পৃথিবীর অন্যান্য বাসিন্দার সৃষ্টি হয়েছে। আর জীবসৃষ্টির এই মূল প্রক্রিয়া যে ভাবে শুরু হয়েছে, তাকেও অনেকটা কাকতালীয় বলা যায়।
কিন্তু নিজেদের উৎসকেই কতকগুলো আকস্মিক ঘটনার সমাপতন হিসাবে ভাবতে নারাজ ছিলেন দেশ-কাল-নির্বিশেষে বহু মানুষ, বিশেষত যেখানে বিন্দুমাত্র মাথা না খাটিয়েই অনির্দিষ্টতার হাত থেকে বাঁচার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের উদার আশ্রয়। বিবর্তনবাদের যে কট্টর বিরোধিতা তথাকথিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রাণকেন্দ্র আমেরিকা থেকে সৌদি আরব, মরক্কো, লেবানন, বা পাকিস্তানের মতো রক্ষণশীল দেশে এত কাল দেখা গিয়েছে, ২০১৮-তে তাতে উঁচু গলায় সুর মেলালেন তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী সত্যপাল সিংহ। স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচি থেকে বিবর্তনবাদ বাদ দিতে হবে বলে তিনি যখন শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন, তখনও কোভিড আসেনি। মন্ত্রিবর তখন তাঁর মতের স্বপক্ষে এই রকম যুক্তি সাজিয়েছিলেন— কেউ কি কখনও কোনও বাঁদরকে মানুষ হতে দেখেছে? যদি কেউ সেটা না দেখে থাকে, তা হলে মানুষ একেবারে আধুনিক মূর্তিতেই পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয়েছে, কোথাও কোনও বিবর্তন ঘটেনি!
সত্যপাল সিংহ আর শিক্ষা মন্ত্রকে না থাকলেও, এত দিন পরে কোভিড-এর অজুহাতে এনসিইআরটি তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেছে। সরকারি বিশেষজ্ঞরা সম্ভবত নেচার বা সায়েন্স-এর মতো সেরা বিজ্ঞান-পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন মাত্রার বিবর্তনের পরীক্ষাগার রূপায়ণের খবর রাখেননি; বা আধুনিকতম জিনতত্ত্ব কী ভাবে বিবর্তনবাদকে সমর্থন করেছে, জানার চেষ্টা করেননি সেটুকুও। অবশ্য সেই সব জানতে প্রৌঢ় বয়সে নতুন করে লেখাপড়া করতে হবে, সে বড় খাটুনির কাজ। তার থেকে অনেক সোজা হল বড়কর্তাদের তালে তাল দিয়ে চলা।
স্কুলের পাঠ্যসূচিকে নিজেদের মর্জিমাফিক পাল্টে নেওয়াটা ইতিহাসের নিরিখে নতুন কোনও ঘটনা নয়। ফ্যাসিস্ট ইটালি থেকে নাৎসি জার্মানি কিংবা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া, চিন— সর্বত্রই অপ্রাসঙ্গিক এবং অযৌক্তিক ভাবে শাসকের মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে নবীন প্রজন্মের পাঠ্যবিষয়ে। মজার কথা হচ্ছে, হিটলারের সময়ে নাৎসিরা কিন্তু ডারউইনের যথেষ্ট ভক্ত ছিল। তারা নিজেদের মতো করে সামাজিক ডারউইনবাদের প্রবর্তন করেছিল— সেখানে যোগ্যতমের উদ্বর্তনও ছিল— শুধু ‘যোগ্যতম’-এর সংজ্ঞা কী, সেটা ঠিক করতেন মহামান্য ফুয়েরার ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা। তাঁরা মনে করতেন যে, ডারউইন সাহেবের পথেই প্রকৃতির ইচ্ছাকে সামনে রেখে মার্ক্সীয় সাম্যবাদের ধারণাটিকে খণ্ডন করা যাবে। সঙ্ঘের প্রাণপুরুষ, ‘গুরুজি’ মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর নাৎসি ভাবাদর্শে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত ছিলেন— জানি না, তাঁর উত্তরসূরিরা এগুলো ভেবে দেখেছেন কি না।
পৃথিবীর বৃহত্তম এই গণতন্ত্রে সাম্প্রতিক অতীতে ইতিহাস বা জীববিদ্যার সিলেবাসে চমকে দেওয়া সব বদল ঘটল অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক উপায়ে, দেশের সবচেয়ে খ্যাতনামা শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আদৌ কোনও আলোচনা না করেই। প্রাইম টাইমে চ্যানেলে চ্যানেলে স্থানীয় রাজনীতির সার্কাস ছাড়িয়ে বৃহত্তর গণমাধ্যমগুলোতে এই সব পরিবর্তন তেমন কোনও অশনিসঙ্কেত জাগাল না, অধিকাংশ অভিভাবক এই ঘটনাগুলোর সুদূরপ্রসারী ফল তলিয়ে ভাবলেন না। আর, ডারউইন-এর তত্ত্ব আনুষ্ঠানিক ভাবে বাদ পড়ার অনেক আগে থেকেই আমরা যেটা ভুলে বসে রইলাম, তা হল, হিটলারও হঠাৎ এক দিনে তৈরি হননি— তিনিও বিবর্তিতই হয়েছিলেন প্রায় এক দশক ধরে। সেই বিবর্তনে অন্যতম অনুঘটক ছিল গরিষ্ঠ সংখ্যক জার্মান নাগরিকের নীরবতা।