বিদ্রোহ: সংসদের প্রবেশমুখে রাহুল গান্ধী, দিল্লি, ২৫ জুলাই। পিটিআই।
মুকেশ অম্বানীর পুত্রের বিবাহ উপলক্ষে সম্প্রতি যে চাঁদের হাট বসেছিল, তা নিছক বৈভবের প্রদর্শন বলে গ্রহণ করলে দু’টি মস্ত ভুল হবে। এক, অম্বানীরা ধনবান বলে এতই সর্বস্বীকৃত যে তাঁরা যখনই কিছু ‘প্রদর্শন’ করেন তা শুধু বিত্ত নয়, কারণ কে না জানে মুম্বই শহরে তাঁদের ১৫,০০০ কোটি টাকায় নির্মিত গৃহ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁদের সম্পত্তি, গাড়ি ও বিমানবহরের কথা? তাই অম্বানী গৃহের অনুষ্ঠানটি ছিল আসলে বিত্তের ফোয়ারামাত্র নয়— ক্ষমতার প্রদর্শশালা। এই বিবাহসভার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক অভ্যাগতদের মধ্যে উপস্থিত ও অনুপস্থিতদের বিভাজন ফুটিয়ে তোলার ব্যবস্থা, যাতে ধরা পড়ছে ভারতীয় রাজনীতির মূল দ্বান্দ্বিকতা। উপরে উপরে তা হিন্দুত্ব বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার দ্বন্দ্ব বলে মনে হলেও সেটা বাইরের মোড়ক। ভিতরে তা হল ‘শেঠতন্ত্র’, অর্থাৎ ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম’ বনাম সাংবিধানিক গণতন্ত্রের দ্বন্দ্ব।
অর্থাৎ, অম্বানী পরিবারের চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিবাহ উৎসব শুধু ‘বড়লোক বাড়ির বিয়ে’, বা ‘দেখনাই’ বা ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে ‘টক্কর’ নয়। এর অন্যতম নিহিতার্থ— মুকেশ অম্বানী শুধু ভারতের ধনাঢ্যতম ব্যক্তিই নন (মোট বিত্ত ১২৪.২ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার, ফোর্বস পত্রিকা অনুসারে), বিয়েবাড়িতে তাঁর আমন্ত্রণে সাড়া দেবেন না এমন কেউই প্রায় নেই ক্রীড়া, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ব্যবসা জগতে। তবে রাজনীতির কেকের একটি বড় অংশ অম্বানী কেটে নিলেও— স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর ‘বিরোধী’ বলে অভিহিত অনেকেই, যেমন তৃণমূল কংগ্রেস কর্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সমাজবাদী পার্টি প্রধান অখিলেশ যাদব, সপরিবার লালুপ্রসাদ যাদব— কেকের যে অংশটি গৃহকর্তার আয়ত্তের বাইরে রয়ে গেল, তা হল সনিয়া গান্ধী, তাঁর পুত্রকন্যা রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা, এবং তাঁর দল কংগ্রেসের প্রায় সব সক্রিয় নেতাকর্মী। অবশ্য কোনও কোনও কংগ্রেস নেতাকে দেখা গেছে অনুষ্ঠানে, যেমন অস্তসূর্য কমল নাথ ও বিষাদগ্রস্ত সচিন পাইলট— তবে হয়তো অনুমান করা যেতে পারে যে, দল হিসেবে কংগ্রেস বর্জন করেছে রাজনীতিতে শেঠতন্ত্রের অত্যধিক হস্তক্ষেপ।
এখানে বলে রাখা ভাল, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে মোদীর অভিষেকের পর দু’বার কংগ্রেসের পতন দেখে যাঁরা দলটির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, সে তালিকায় কখনও থাকতে পারেন না মুকেশ অম্বানীর মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবসায়ী। তা ছাড়া স্বর্গত ইন্দিরার স্নেহস্পর্শ ছাড়া যে ভারতের টাটা-বিড়লা-পোষিত, বাবুতন্ত্র-অধ্যুষিত ব্যবসায়িক আকাশে ধীরুভাই অম্বানী (মৃত্যু ২০০২) নামক ধূমকেতুটির হয়তো উদয়ই হতে পারত না, এ কথা তাঁর পুত্র মুকেশের চেয়ে কে-ই বা বেশি জানে? তাই সপুত্র ১০ জনপথ সনিয়ার বাসভবনে এসে তিনি বিলি করেছিলেন নিমন্ত্রণপত্র। কিন্তু রাহুল তার আগেই হাওয়া। তাঁর সময় বরাদ্দ ছিল অন্য কাজে। কিন্তু রাজনীতিতে রাহুল যে সুতীব্র শেঠতন্ত্র-বিরোধী পথ বেছে নিয়েছেন, তা নতুন ও অপরীক্ষিত বলা চলে (বাবার মাতামহ জওহরলাল নেহরু সন্দিগ্ধ ছিলেন দেশীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি)। রাহুলের নেতৃত্বের উপর তাঁর পরিবার ও কংগ্রেসের এক বিপুল অংশের অটুট বিশ্বাস। সুতরাং, শুরুতেই জানা ছিল, রাহুল-পর্বে কংগ্রেস ব্যবসায়-বিরোধিতা না করলেও শেঠতন্ত্রের পথ মাড়াবে না।
এই বিরোধিতার পথ রাহুল বেছে নিয়েছেন বহু দিন যাবৎ। তাঁর বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী মোদী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রকৃত অর্থে তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শ বা কর্মক্ষমতার বলে জনমত জয় করে যে বারংবার সরকার দখল করেন, তা নয়। বরং তাঁদের জয়ের কারণ অম্বানী, গৌতম আদানি প্রমুখ ‘মাল্টি-বিলিয়ন’পতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দাক্ষিণ্য। মোদী ও তাঁর গোষ্ঠী গুজরাত থেকে এসে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার জন্য পায় শেঠতন্ত্রের অকুণ্ঠ সমর্থন।
বিভিন্ন জনসভায় কথিত রাহুলের মত হল, মোদী সরকার “অম্বানী, আদানি-সহ প্রায় ২০-২২ বিলিয়নপতির স্বার্থবাহী”। কথাটি যাঁরা নিছক বামপন্থী বুকনি বলে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছুক, তাঁদের খাটো করে দেখানো এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তবে এও সত্য যে, ২০১৪-২৪ দশকে মাত্র ২২টি ব্যবসায় গোষ্ঠীর সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে না-মেটানো ঋণের পরিমাণ ১৬ লক্ষ কোটি টাকা। গত নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জনসভায় রাহুলের একটিই কড়া বার্তা, “মোদী বাইশ জন ‘আমির’-এর জন্য যদি দশ বছরে ১৬ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মাফ করতে পারেন, তবে তার অন্তত একটি অংশ কেন পাবে না সাধারণ মানুষ?” সংসদে দাঁড়িয়ে মোদীর বিমানে আদানির ছবি দেখিয়ে শেঠতন্ত্রে বারংবার তীক্ষ্ণ সুচ বিঁধিয়েছেন রাহুল।
ধনীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে অতীতের সব সরকারেরই বিরুদ্ধে। কিন্তু মোদীর আমলে চালু হয়েছে সামান্য কয়েকটি গোষ্ঠীর একচেটিয়া কর্তৃত্ব, বা ‘মনোপলি’। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য, বর্তমানে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক, গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউট-এ সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন ভারতের ‘পাঁচ প্রধান গোষ্ঠী’র কথা— অম্বানীর রিলায়েন্স, আদানি গ্রুপ, টাটা গোষ্ঠী, আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠী এবং এয়ারটেল ভারতী। আচার্যের হিসাব অনুসারে, ১৯৯১ সালে যখন নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে শুরু হয় একচেটিয়া ফাঁদ (সরকারি ও বেসরকারি) থেকে অর্থনীতির উন্মোচন, তখন আর্থিক সেক্টর ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে উপরোক্ত ‘পাঁচ প্রধান’-এর কর্তৃত্ব ছিল ১০ শতাংশ। কিন্তু ২০২১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশে। আচার্যের হিসাব ২০২১ পর্যন্তই, কিন্তু ভারতীয় অর্থশাস্ত্রীদের একাংশের অনুমান তা এত দিনে সম্ভবত ২৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
মোদীর দশকে তাঁর জন্মভূমি গুজরাতের সন্তান এই ‘ডাবল এ’ (অম্বানী ও আদানি) দেশের অর্থনীতিতে বহু দূর বিস্তৃত করেছেন তাঁদের কায়েমি প্রভাব। এ কথা সত্য যে, ইন্দিরা গান্ধীর যুগে ধীরুভাই অম্বানী ছিলেন সম্ভবত সবচেয়ে রাজনৈতিক প্রভাবশালী শিল্পপতি। কিন্তু তখন ছিল অন্য যুগ, এতটা সোজা ছিল না একচেটিয়া বাজারের পত্তন; সেই প্রসঙ্গে অম্বানী বনাম নাসলি ওয়াদিয়া লড়াইটিকে প্রবাদপ্রতিম বলতেই হয়।
মোদী দশকের কল্যাণে আজ আর কোথাও প্রতিযোগিতা নেই। বিমানবন্দর পরিচালনায় পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও এক লপ্তে এয়ারপোর্ট অথরিটির টেন্ডারে আদানি গোষ্ঠী পেয়ে যান ছ’টি বিমানবন্দর— লখনউ, জয়পুর, গুয়াহাটি, আমদাবাদ, তিরুঅনন্তপুরম ও মেঙ্গালুরু। কী এক আশ্চর্য উপায়ে ওই গোষ্ঠীর হাতে এসে যায় মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ এয়ারপোর্টেরও ভার। তার উপর এসেছে নভি মুম্বই আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট নির্মাণ ও পরিচালনার বরাত। এক বেসরকারি সংস্থার হাতে দেশের আট-আটটি বিমানবন্দরের ভার মোটেই ভাল সংবাদ নয় বিমানযাত্রী বা বিমান সংস্থার পক্ষে। আর এর উপর আছে সমুদ্র বন্দর নির্মাণে মৌরসিপাট্টা। এবং কয়লা ব্যবসায়ে প্রভুত্ব। এবং মোবাইল ফোন, পেট্রলিয়াম রিফাইনারি, পেট্রপণ্য, রিটেল ইত্যাদি ক্ষেত্রে অম্বানী প্রভুত্ব।
ঊনবিংশ শতকের শেষে ও বিংশ শতকের শুরুতে আমেরিকান বাজারে প্রভুত্ব বিস্তার করেন সে কালের কিছু শিল্পপতি, যেমন— জন ডি রকেফেলার (স্ট্যান্ডার্ড অয়েল), কার্নেগি (ইস্পাত), ভ্যান্ডারবিল্ট (রেলশিল্প) প্রমুখ। সেই যুগটি ইতিহাসে অভিহিত হয়েছে ‘স্বর্ণিল যুগ’ বা দ্য গিল্ডেড এজ বলে; নামটির জনক লেখক মার্ক টোয়েন, তাঁর ওই নামের উপন্যাস থেকে এই নামকরণ। এই সময়ে আমেরিকার অর্থনীতি তরতরিয়ে এগিয়ে গেলেও এসেছিল ঘোর অসাম্য, বেড়েছিল দারিদ্র। তবে কিছুই আটকাতে পারেনি রকেফেলার সাহেবের ক্ষমতার দৌড়— কোথায় তেলকূপ খোঁড়া হবে, কত কম হবে শ্রমিকের মজুরি, এ সব ঠিক করার সঙ্গে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাতেও তাঁর প্রভাব ছিল সুগভীর।
পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল মানুষ। ১৯০১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতলেন রিপাবলিকান দলের থিয়োডর রুজ়ভেল্ট। একচেটিয়া ব্যবসার বিরোধী ‘ট্রাস্ট বাস্টার’ আইন এল তখন। স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ভাগ হয়ে গেল ৩২ টুকরোয়।
রাহুল গান্ধীর বিদ্রোহ যদি এই ধরনের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে হয়ে থাকে, তবে তাঁকে কাছে টানতে হবে এক বিপুল জনসমষ্টিকে— যেটা করতে থিয়োডর রুজ়ভেল্ট সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু যে-হেতু রাহুলের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের এত নেতা হাজির হয়েছিলেন সে দিনের বিবাহসভায়— সপরিবার বা সপার্ষদ— রাহুলকে হয়তো নতুন করে ভাবতে হবে ভবিষ্যৎ রণকৌশল।