জুন-এর ১৫ তারিখে লকডাউন শিথিল হয়ে গণপরিবহণ চালু হবে এই আশায় পল গুনছিলেন যে অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ, ছোট কারখানা বা দোকানের কর্মী, যাঁরা কলকাতার বাইরে ও আশপাশ থেকে আসেন, তাঁদের মুখের সামনে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজাটা খুলল না। শপিং মল, বার, রেস্তরাঁ খোলার অনুমতি পেল, পেল বেসরকারি অফিসও। কর্মীরা আসতে পারছেন না বলে বন্ধ শুটিং ফ্লোর, কারখানা, বইপাড়া, অধিকাংশ দোকানপাট।
বাংলার অর্থনীতি বহুলাংশ কলকাতা-নির্ভর। এ শহর অসংখ্য মানুষকে জীবিকা ও রোজগারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বহু দিন ধরে। কেবল কাজের জায়গা নয়, কাঁচামালের পাইকারি বাজারও কলকাতায়। যাঁরা ছোট ব্যবসা করেন এখান থেকেই জিনিস কিনে নিয়ে যান। তাঁদের সবাই গাড়ি বা ট্যাক্সি চড়েন না। শহরের চৌহদ্দির মধ্যেও থাকেন না। আজ পনেরো মাস হল তাঁদের জীবন ও জীবিকা দুটোই সঙ্কটে। অনুমান করতে অসুবিধে নেই, এঁদের একটা বড় অংশ সরকারি দলকে জিতিয়ে এনেছেন।
কোভিড-জনিত সংক্রমণ এক বাস্তব অবস্থা, কিন্তু করোনা যেন এমন এক দানো, যার সামনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা মুখ থুবড়ে পড়ছে। তথ্য কিন্তু ছিল। সরকারের তথ্যই দেখিয়ে দিচ্ছে, নির্বাচনের বেপরোয়া জমায়েতগুলির পর কী ভাবে হুহু করে সংক্রমণ বেড়েছে। আমরা এও দেখেছি, গণপরিবহণ পুরোপুরি চালু থাকলেও ভিড় উপচে পড়ে না। বরং সীমিত ব্যবস্থায় যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি।
চলতি বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে ৭ শতাংশ। দারিদ্রসীমার কাছাকাছি যারা আছেন তাঁদের কী অবস্থা, ভাবতে ভয় হয়। একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা স্থবির হয়ে আছে। শুকিয়ে কুঁকড়ে গিয়েছে দেড় বছরেরও বেশি।
গত বছরও অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা প্রাণপণে জীবিকা বদল করে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। খবরের কাগজ যিনি দিতেন, মাছ-বিক্রেতা হয়ে গেলেন তিনি। আনাজ-ফেরিতে লেগে গেলেন কারখানার মজদুর। সেই জায়গাটা এখন আরও ছোট হয়ে গিয়েছে। এখন নাভিশ্বাস চটকল, কারখানা, গ্রামে না-কাজ-পাওয়া ছোট দোকানের কর্মীর। এঁরা সবাই বসেছিলেন শহরের চাকাগুলি নড়ে ওঠার জন্য। তা পিছিয়ে গেল। আমরা কি জানি, এঁদের কত জন আত্মহত্যা করেছেন, অনাহারে-অপুষ্টিতে মারা গিয়েছেন, কাদের স্ত্রীরা গৃহসেবিকার বৃত্তি নিলেন? কী হল যৌনকর্মীদের, তাঁদের সন্তানদের, যখন স্পর্শের বৃত্তে আর এলেন না খরিদ্দাররা?
অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সরকারের পক্ষে এই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। গণপরিবহণ চালু করলে ‘কেস’-এর সংখ্যা যদি বাড়ে, তবে সমালোচনা হবে সরকারেরই। তাই সিদ্ধান্তে দেখা যাচ্ছে রক্ষণশীল সতর্কতা। কিন্তু এর ফলে শহরে সৃষ্টি হচ্ছে গভীরতর বৈষম্যের। গত দেড় বছর ও তারও আগে থেকে মন্দার সঙ্গে লড়তে লড়তে অল্পবিত্তের পিঠ ঠেকে গিয়েছে নিরুপায়তার দেওয়ালে, হতাশ্বাস হয়ে পড়ছে মানুষ। এই অবস্থা যেন সংক্রমণের মতোই ভয়ানক, এবং সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। তরুণ সাহিত্যিক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পেশা বদলে ব্যবসায়ী-হওয়া বন্ধু জানালেন, ‘সম্মিলিত অবসাদ’ দেখতে পাচ্ছেন চার দিকে। এ অবসাদ ব্যক্তির নয়, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে-যাওয়া সমাজের।
বেকার হয়ে কম রোজগারের পেশায় গেলেন পরিবারের কর্তাটি। গৃহিণী গৃহসেবিকা। কাজ বন্ধ। পরিবারে স্মার্টফোন আছে বা নেই। এ বার টান পড়ল ইন্টারনেট ডেটা কেনার টাকায়। অনলাইন পড়া বন্ধ হল। কারখানার শ্রমিক ছোটখাটো ইংরেজি স্কুল থেকে মেয়েকে তুলে নিলেন। কী হল এই ছেলেমেয়েদের? কত শিশু অনাথ হয়েছে, কী হারে বেড়েছে কাজ খোঁজা, অথবা বিয়ের নামে পাচার? কেমন আছে সেই সব মা ও শিশুরা, যাঁদের টিকাকরণ স্থগিত ছিল করোনার জন্য? বন্ধ অঙ্গনওয়াড়ির অপুষ্টিগ্রস্ত শিশুরা কি আজ আরও বিপন্ন?
রাজ্য সরকারের কাছে এই খবরগুলি থাকত, যদি গত দেড় বছরে একটা স্যাম্পল সার্ভে করা যেত, বাংলার অর্থনীতিতে এবং সামাজিক জীবনে অতিমারির প্রভাব নিয়ে। এই কাজে স্বাস্থ্যকর্মী দরকার ছিল না। শিক্ষাকর্মী ও পঞ্চায়েত-কর্মীরা, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির তত্ত্বাবধানে করতে পারতেন। সার্ভে ও কনট্যাক্ট ট্রেসিং-এর কাজ একই সঙ্গে করা যেত। সেটা হয়নি বলে আজ আমাদের হাতে অন্তত সরকারি ভাবে প্রকাশিত তথ্য নেই।
পরীক্ষা নিয়ে ঝুঁকি নেওয়ার বিরুদ্ধে জনমত সঙ্গত। ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকদের অধিকাংশই আতঙ্কিত। নির্বাচিত সরকার পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন অতি দ্রুত। এটাও কিন্তু বাস্তব যে, শিক্ষা নিয়ে গত দেড় বছর কোনও আলোচনা বা পরামর্শও আহ্বান করা হয়নি। স্কুলে না গিয়েও পড়াশোনা চালু রাখা যেত। যতটুকু চালু রইল, তা পুরোপুরি ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন-নির্ভর। সারা দেশে সচ্ছল অভিভাবকরা এটা মেনে নিলেন, শিশুরা পড়ার জন্য ‘হাতে গরম’ অ্যাপ ব্যবহার করবে, নিজেরা অ্যাপ তৈরি করবে। এটাই হয়ে গেল অতিমারির এক ঝকঝকে পরিণাম।
কাঁথার উল্টোপিঠটা কেউ উল্টে দেখলেন কি? গত দুই বছরে স্কুল না-যাওয়া ছোটদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কী অবনমন হল, তাদের মনের কী অবস্থা হল সহপাঠীদের সঙ্গ না পেয়ে— তার কোনও পরিমাপ রাজ্য-স্তরে হয়নি। শিক্ষকদের সহায়তা কি এই সব কাজে নেওয়া যেতে পারত না, দূরত্ববিধি বজায় রেখে? আমরা ফোনের খরচ দিই পকেট থেকে। রেডিয়ো এবং টেলিভিশন, এই দুই গণমাধ্যমকে জনস্বার্থে ব্যবহার করার বড় সুযোগ ছিল— আমরা তা হারালাম।
খুবই সেকেলে কথা, তবে আজ থেকে ষোলো-সতেরো বছর আগে কিন্তু ইসরোর স্যাটেলাইট ব্যবস্থা ব্যবহার করে বাংলার সব পঞ্চায়েতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রূপকলা কেন্দ্র। রেডিয়ো মারফত শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের হাজার হাজার শিক্ষকের ট্রেনিং হত এখান থেকে। তুলনীয় কিছু কি করা সম্ভব ছিল না গত দেড় বছরে? আসলে নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং অতিমারি ঠেকানোর একমুখী উদ্যোগ আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে অনেকটা মন্থর করে দিল। সেই ফাঁকে ঢুকে এল বৈষম্য, সর্বস্তরে। এই রাক্ষস সহজে ঘর থেকে বেরোবে বলে মনে হয় না।
অতিমারির মোকাবিলা মানে কি জনসংখ্যার দুর্বলতম অংশকে ঘরে বন্দি করে রেখে দেওয়া? যে দিন তালা খোলা হবে জীবন অবশিষ্ট থাকবে তো? এখন অনেক বেশি জরুরি টিকাকরণ, যার গতি নষ্ট করে দিল কেন্দ্রীয় সরকারের অস্বচ্ছ নীতি। শহরতলি আর গ্রামে টেস্টিং এখনও অপ্রতুল। কনট্যাক্ট ট্রেসিং-এর ব্যবস্থা নেই। অনেক জেলা হাসপাতালে করোনা ও অন্য রোগীদের আলাদা করার ব্যবস্থা নেই। বাড়িতে থেকে প্রতিবেশীর ভয়ে ডাক্তার না দেখিয়ে মারা যাচ্ছেন মানুষ। এর একটা পরিমাপ দরকার।
রাজ্য সরকার স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প বিস্তৃত করেছে, মেয়েদের হাতে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা এসেছে। কিন্তু এগুলি চাহিদার দিকের সুবন্দোবস্ত। স্বাস্থ্য পরিষেবার জোগান কিন্তু এখনও অতি দুর্বল। প্রাথমিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের ৩০ শতাংশ, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অত্যন্ত অভাব। জেলা হাসপাতালে, কলকাতায় করোনার চিকিৎসার জন্য ছুটে আসছেন রোগীর পরিবার। সেখানে চিকিৎসা হয় বিনামূল্যে কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়ার টাকা লাগে, সেটা হাতে নেই তাঁদের। ওষুধ, ইঞ্জেকশন, অক্সিজেনের কালোবাজারি চলেছে পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনে। বৈষম্য তাতে আরও বাড়ছে।
মানুষকে কাজে ফেরানো দরকার; এখনই। আর্থিক সাহায্য পৌঁছতে হবে অসংগঠিত শ্রমিকদের হাতে। প্রলম্বিত লকডাউন হয়তো করোনা কিছু দিনের জন্য রুখবে, কিন্তু ইতিমধ্যে অনাহারে, হতাশায় নষ্ট হবে অসংখ্য জীবন।