এক আশ্চর্য পুরুষ ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ! তাঁর প্রতিষ্ঠা সত্যে, স্থিতি অনন্ত করুণায়। তিনি বিত্তবান ছিলেন না, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী বা দার্শনিকও ছিলেন না; সামাজিক প্রতিষ্ঠার বিচারে তাঁর কোনও পরিচয় ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দময় পুরুষ, আনন্দই তাঁর স্বরূপ। তাঁর উপস্থিতিতে বসে ‘আনন্দের হাট’। সে হাটে বিনামূল্যে মেলে অমূল্য প্রেম ও করুণা; যার স্বাদ নিতে অগণিত মানুষের সমাগম হয় তাঁর কাছে।
তাঁর দীর্ঘ অধ্যাত্মসাধনার উপলব্ধির আলোকে এ জীব-জগৎ চৈতন্যময়। এক পরম সত্য অনুস্যূত হয়ে আছে বিশ্বব্যাপী, যার স্বরূপ সৎ-চিৎ-আনন্দ। প্রতি মানুষের অন্তরে রয়েছে সেই পরম সত্যের অমৃতকুম্ভ, যা যাবতীয় আনন্দের উৎস। এই পরম সত্যের উপলব্ধিতেই মানুষের জীবন আনন্দময় হয়। মানুষের অসীম সম্ভাবনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল শ্রীরামকৃষ্ণের আশা-জাগানিয়া উক্তি: ‘মানুষ কি কম গা? ঈশ্বর চিন্তা করতে পারে, অনন্তকে চিন্তা করতে পারে, অন্য জীবজন্তু পারে না।’ মানুষের সুপ্ত চৈতন্যের জাগরণ ঘটিয়ে তাকে ‘মানহুঁস’ করাই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই চেতনার বিকাশ যখন হয়, তখন মানুষ শুধু বাইরের সম্পদ নয়, অন্তরসম্পদে দীপ্তিমান হয়। অনন্ত সম্ভাবনাময় এই মানুষদের শান্তি ও আনন্দের সন্ধান দেওয়াই কল্যাণাকাঙ্ক্ষী তাঁর জীবনসাধনা। বলেছিলেন, ‘মাটির প্রতিমায় তাঁর পূজা হয়— আর মানুষে হয় না?’ মানবপ্রতিমাকে কেন্দ্র করেই তাঁর জীবনপূজা।
বিশ্বভুবনকে চৈতন্যময় দেখা শুধু নয়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর এক গভীর একাত্মতা বোধ। কালীবাড়ির গঙ্গাঘাটে দাঁড়িয়ে এক দিন ভাবাবিষ্ট হয়ে গঙ্গাদর্শন করছেন। ঘাটে মাঝিরা ঝগড়া করছিল, সহসা এক দুর্বলের পিঠে ভীষণ চপেটাঘাত করে বসল সবল এক মাঝি। শ্রীরামকৃষ্ণ চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। পিঠ আরক্তিম হয়ে ফুলে উঠল। মাঝিদের বিবাদ থেকেই তাঁর পিঠে আঘাতজনিত বেদনাচিহ্ন দেখা দিয়েছে! এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণের অনন্যতা। ব্যথিতের সঙ্গে একাত্মতাবোধ থেকে এহেন অনুভূতির ঘটনা ইতিহাসে বিরল।
শ্রীরামকৃষ্ণের অনুভবে সাধারণ মানুষ চলমান সাকার বিগ্রহ, অমৃতের সন্তান। আনন্দ তাঁর সহজাত স্বভাব। তিনি মানুষকে ভালবেসেছিলেন অন্তরের প্রেরণায়। কারণ, জগৎসমুদয়ে যখন তাঁর নিজের শরীরবোধ মূর্ত, তখন মানুষকে না ভালবেসে তাঁর আর উপায় নেই; জগতের দুঃখে বেদনার্ত না হয়ে পরিত্রাণ নেই। আবার একই সঙ্গে বেদনার নিবৃত্তিতেও তিনি সদা সচেষ্ট। রানি রাসমণির জামাই মথুরবাবুর সঙ্গে তীর্থদর্শনে চলেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। পথে দেওঘরে দেখলেন, গরিব লোকেরা খেতে পায় না, জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা। মথুরবাবুকে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, ‘এদের একমাথা করে তেল ও একখানা করে নতুন কাপড় দাও, আর পেটটা ভরে একদিন খাইয়ে দাও।’ এখানেই এত খরচ হলে তীর্থদর্শন হবে কী করে, হিসেবি মথুরবাবু গররাজি। শ্রীরামকৃষ্ণও নাছোড়বান্দা, জীবন্ত মানবদেবতার সেবাপূজা না করে তিনি নড়বেন না। অবশেষে মথুরবাবু তাঁর ইচ্ছাপূরণ করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের এই নিষ্কাম প্রেমের অতুল গভীরতাই সাধারণ মানুষকে তাঁর দিকে আকৃষ্ট করেছে। কাউকে তিনি ঘৃণা করেননি, অস্পৃশ্য জেনে দূরে রাখেননি, মানুষের দুঃখ তাঁর সমুদ্রসমান হৃদয়কে উদ্বেল করে তুলেছে। তাদের পরম আনন্দের আস্বাদ দিতে তিনি কাতর হয়েছেন।
বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে যখন শান্তি আর আনন্দ আমাদের বড় প্রয়োজন, তখন সে প্রয়োজন মেটাতে শ্রীরামকৃষ্ণের মতো মহামানবের তাৎপর্য আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। তাঁর জীবন মানবতার এক অনন্য ভাষ্য— অহিংসা, প্রেম, সমমর্মিতার জয়গান সেখানে। অকপট, সহজ-সরল সাদাসিধে জীবনচর্যায় অগণিত পথশ্রান্তের জীবনে তিনি হয়ে উঠেছেন চির-আশ্রয়। আনন্দঘন, করুণাময় তাঁর এই রূপ চির-আকর্ষণের।
কথামৃতে পাই, অবতারের স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ‘যেমন ঠিক সূর্যোদয়ের সময়ে সূর্য’। মধ্যাহ্নের রৌদ্রের প্রখরতায় চোখ ঝলসে যায়, সূর্যের দিকে দৃষ্টি রাখা যায় না। সূর্যোদয়ের সূর্যে সে দীপ্তির প্রখরতা নেই, কিন্তু কোমলতা আছে। তাই সে সূর্যকে সহজে দেখতে পারা যায়, চোখ ঝলসায় না, বরং চোখের তৃপ্তি হয়। তিনি এমনই কোমল। আশা-সমুজ্জ্বল, প্রেম-টলমল। স্নিগ্ধতায় ভরা তাঁর দুই চোখ নিরন্তর শুনিয়ে চলেছে, জাগো, শিবময় হও, আনন্দময় হও। তাঁর অনন্ত আশ্বাসে ভরা চাহনি দৃঢ় প্রত্যয় জাগায় মনে। মনুষ্যত্ব থেকে শিবত্বে উত্তরণের দীপশিখাটি তিনি জ্বালিয়ে রাখেন আমাদের অন্তর্লোকে।