কথোপকথনে অচিন চক্রবর্তী ও অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
language

ভাষার নীতি ও রাজনীতি

ভাষা নিয়ে মাঝেমাঝেই যে বাক্যবিনিময় শুনতে পাই তাকে ঠিক তর্ক বলব কি না নিশ্চিত নই, কারণ তার মধ্যে আবেগ যতটা থাকে যুক্তি ততটা নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৩ ০৫:৩৭
Share:

প্রশ্ন: প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি শেখার দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মিছিল, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫।

অনির্বাণ: মার্চ মাসের মাঝামাঝি পৌঁছে গিয়েছি। বলাই যায় যে, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অতীত, নববর্ষ আমাদের ভবিষ্যৎ। প্রতি বছর এই দুটো দিন আর তার আশেপাশের কয়েক দিন জুড়ে বাংলা ভাষার দৈন্য আর তার প্রতি অবহেলা নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়— হা-হুতাশ, রাগ-দুঃখ, আত্মসমালোচনা চলে। তর্কও জমে। তার পর আবার সব যে-কে সেই। যথা অতীত, তথা ভবিষ্যৎ।

Advertisement

অচিন: ভাষা নিয়ে মাঝেমাঝেই যে বাক্যবিনিময় শুনতে পাই তাকে ঠিক তর্ক বলব কি না নিশ্চিত নই, কারণ তার মধ্যে আবেগ যতটা থাকে যুক্তি ততটা নয়। আবেগের সঙ্গে খানিক স্বার্থগন্ধ কিংবা খণ্ডিত সমাজদর্শনও মিশে থাকে। মাতৃভাষাকে ভালবেসে আবেগে আপ্লুত হওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই, কিন্তু সে ভালবাসা থেকে যদি এক লাফে, শুধু আবেগ বা ব্যক্তিস্বার্থ সর্বস্ব করে, ভাষানীতির প্রশ্নে ঢুকে পড়ি তা হলে বিপদের সম্ভাবনা যথেষ্ট।

অনির্বাণ: ঠিকই। যুক্তি মস্তিষ্কের পরিশ্রম দাবি করে, অলস আবেগের সেই দায় নেই, বাঁধা গতে কতকগুলো লব্জ আওড়ালেই হল। বিশেষ করে, ইংরেজি বনাম বাংলা— এই রকম একটা ছকে বাঁধা চিন্তার খুব প্রচলন এখন। সমস্যাটা নতুন নয়, কিন্তু ইদানীং তার মাত্রা বেড়েছে। সামাজিক অসাম্য এবং বিশেষ করে শিক্ষার অসাম্য বৃদ্ধি তার একটা কারণ হতে পারে। ইংরেজির জ্ঞানটা এক দিকে সেই অসাম্যের একটা পরিণাম এবং অন্য দিকে একটা সূচক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ফলে হয়তো একটা ব্যাপার ঘটছে। ‘ইংরেজি না জানলে কিছু হবে না’ থেকে শুরু করে অনেকেই ‘বাংলা জেনে কিছু হবে না’ গোছের একটা ধারণায় পৌঁছে যাচ্ছেন। আবার এর প্রতিক্রিয়ায় একটা বড় অংশের মনে ইংরেজির প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে, যা নিজেকে বাংলার প্রতি অনুরাগ হিসেবে প্রকাশ করতে চাইছে। তাতে ইংরেজির ভাঁড়ার খালি হচ্ছে, বাংলারও কোনও উপকার হচ্ছে বলে তো মনে হয় না।

Advertisement

অচিন: মানতেই হবে ইংরেজি ভাষা এ দেশে বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির ভাষা হয়ে রয়ে গেছে, তাই সে ভাষা সবাই খুব ভাল ভাবে শিখুক, তা এই শ্রেণি নাও চাইতে পারে। সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, এই সমস্যা দূর করতে দু’রকম নীতিপথ হতে পারে। এক, ইংরেজি ভাষা জানার জন্যে যে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায় তা কমিয়ে ফেলা। যেমন, সরকারি কাজ বাংলা ভাষায় করা, উচ্চশিক্ষায় বাংলায় পঠনপাঠন। দুই, ইংরেজি ভাষাকেই সকলের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসা, অর্থাৎ সবাইকে ভাষার ব্যাপারে সমান সক্ষমতায় উন্নীত করা। দ্বিতীয় পথটি কঠিন বলেই প্রথমটির প্রতি ঝোঁক বেশি। কিন্তু প্রথমটির সমর্থনে যে যুক্তিগুলি দেওয়া হয় তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নড়বড়ে এবং ঘোলাটে, বিশেষত বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে।

অনির্বাণ: আমরা কি দু’দিক দিয়েই ভুল পথে চলেছি? এক দিকে, বাংলা ভাষায় সরকারি কাজ এবং উচ্চশিক্ষা— এই দু’টি ক্ষেত্রেই যতটা এগোনো সম্ভব ছিল, তার যথেষ্ট ব্যবস্থা হয়নি। রাজ্য সরকারের নথিপত্র, নানা নির্দেশিকা, চিঠিচাপাটি, এ-সবের জন্য বাংলা ভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ সেই আশির দশকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু কাজ কতটুকু হল? সরকারি কাজে ইংরেজির সেই দাপট সমানে চলছে। তেমনই, এত সব অ্যাকাডেমি-ট্যাকাডেমি চতুর্দিকে বিরাজমান, অথচ শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে সুচারু বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক এবং অন্য নানা সহায়ক বইপত্র তৈরি করবার একটা বড় রকমের চেষ্টা আজও হল না। এটা একটা দিক। অন্য দিকে, ইংরেজি শেখার ব্যাপারে যে জোরটা আগে ছিল— তার জন্য ইংলিশ মিডিয়ামের দরকার হত না, বাংলা স্কুলেও রীতিমতো গুরুত্ব দিয়ে ইংরেজির চর্চা হত— সেটাও আমরা হারিয়ে ফেললাম, আবার হারিয়ে ফেলার পক্ষে উল্টোপাল্টা কুযুক্তি দেখালাম।

অচিন: মাতৃভাষা ছাড়াও অন্তত আর একটি ভাষা জানা বিশ্বের প্রায় সব জনগোষ্ঠীর মধ্যেই কমবেশি দেখা যায়, বিশেষত দেশগুলির মধ্যে আর্থনীতিক আদানপ্রদান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতাটি বেড়েছে। শুধু ভারতেই দেখি (পশ্চিমবঙ্গ তার ব্যতিক্রম নয়) মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার অজুহাতে ইংরেজি শেখার গুরুত্বকে লঘু করে দেখা হচ্ছে। মাতৃভাষা যেমন মাতৃদুগ্ধের মতোই অপরিহার্য, কিন্তু শৈশব পেরোলেই অন্য আহার্যের প্রয়োজন হয়, অন্য ভাষা শিক্ষাও তেমন প্রয়োজন থেকেই আসে। যাঁরা সুযোগের বা উদ্যোগের অভাবে ইংরেজি শিখে উঠতে পারেননি তাঁদের দিক থেকে উচ্চশিক্ষায় বাংলা ব্যবহারের পক্ষে জোরালো দাবি ওঠাই স্বাভাবিক। পরীক্ষায় উত্তর লেখা থেকে পিএইচ ডি-র থিসিস সবই যদি বাংলায় হয় তা হলে অনেকেই উচ্চশিক্ষায় আরও এগোতে পারবেন, ডিগ্রি নিয়ে বেরোতে পারবেন, ফলে ডিগ্রি অর্জনের বণ্টনে আর্থসামাজিক বৈষম্য কমবে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, তিনি যদি থিসিসটি ইংরেজিতে লেখেন তাঁর কাছে কাজের বাজারটা যতটা প্রশস্ত, যিনি থিসিসটি বাংলায় লিখেছেন তাঁর জন্যে ততটা নয়। সম্প্রতি জানলাম প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ করছে এঞ্জিনিয়ারিং-এর পাঠ্যপুস্তকগুলি বাংলায় তর্জমা করার। উদ্যোগটি আপাতদৃষ্টিতে সাধু হলেও তা ঠিক কোন উদ্দেশ্য সাধন করবে তা জানা যাচ্ছে না। একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে অসরকারি এঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলি থেকে তাঁরাই প্রথম চাকরি পাচ্ছেন যাঁরা ইংরেজি, বিশেষত সফ্ট স্কিল-এ দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছেন। আর সে জন্যেই কলেজগুলিকেও দেখা গেছে সফ্ট স্কিল শেখানোর উদ্যোগ করতে।

অনির্বাণ: এ ভাবেও বলা যায় যে, যেটা বাংলায় করা দরকার সেটা ঠিক ভাবে করা হচ্ছে না, আর যেটা বাংলায় করবার নয় সেটা কোনও রকমে করবার চেষ্টা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাংলা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই কোনও রকমে কাজ চালিয়ে নেওয়ার উপায়। বাংলাকে ইংরেজির ‘সহজ’ বিকল্প না ভেবে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা দরকার ছিল। স্কুলে তো বটেই, উচ্চতর শিক্ষাতেও লেখাপড়ার বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীদের প্রাঞ্জল করে তোলার কাজে মাতৃভাষা হতে পারত একটি বড় সহায়। হয়েছে তার উল্টো। বাংলায় বিজ্ঞান প্রযুক্তি, এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই সমাজবিজ্ঞানের বইপত্রের ভাষাও বই দুর্বল, ইংরেজি থেকে আড়ষ্ট অনুবাদ। এখানেই আবার ওই ‘বনাম’-এর কথাটা ফিরে আসে।

অচিন: হ্যাঁ। আজকাল অনেকের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ দেখি। তাঁরা মনে করেন ইংরেজিতে শিক্ষিত হলে বাংলা ক্রমশ অবহেলিত হবে। তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় দুইয়ের মধ্যে এমন দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ভাবনাটি ভিত্তিহীন। অতীতে বাংলার প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক। ইংরেজিটা আয়ত্ত করতে গিয়ে তাঁদের বাংলা ভুলতে হয়নি। যাঁরা মনে করেন ইংরেজি শিখতে গেলে বাংলা পরিত্যাগ করতেই হবে, তাঁদের শিক্ষায় ঘাটতি আছে বলে মনে হয়।

অনির্বাণ: আমাদের বিদ্যাচর্চায় এবং লেখালিখি ও সামাজিক আলোচনার পরিসরে দ্বিভাষিকতা একটা মস্ত হাতিয়ার ছিল। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে একই সঙ্গে ইংরেজি এবং বাংলা, দুই ভাষার উপরে জোর দেওয়া দরকার ছিল, তাতে পশ্চিমবঙ্গের যাকে মানবসম্পদ বলে তার একটা জোরের জায়গা তৈরি হত। কিন্তু আমরা ইংরেজি আর বাংলার লড়াই বাধিয়ে দুই ফ্রন্টেই হেরে গেলাম।

অচিন: আসল সমস্যাটি বোধ হয় উদ্দেশ্য এবং উপায়ের মধ্যে বিভ্রান্তি। লক্ষ্যটি যদি হয় সক্ষমতার সাম্য তা হলে তা ডিগ্রি অর্জনের সুযোগের সাম্য দিয়ে পৌঁছনো যাবে না, কারণ ডিগ্রি বস্তুটি কোনও সমসত্ত্ব পদার্থ নয়। তাই সমস্যাটির মূলে কতটা সঠিক নীতিচিন্তার অভাব আর কতটা রাজনীতি, সেই প্রশ্ন চলে আসে। রাজনীতি সব সময়ে শিক্ষকতাকে বেকার সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখেছে, শিক্ষার প্রসার ও গুণমানের উন্নয়নের দিক দিয়ে দেখেনি। তাই শিক্ষকের সক্ষমতার কথাটি বিশেষ ভাবা হয়নি। প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়ায় কী সর্বনাশ হল— এই ভাবনাকে জনমানসে এমন চারিয়ে দেওয়া হল যে প্রাথমিক-উত্তর শ্রেণিতেও যে ইংরেজি ভাল করে শেখানো হচ্ছে না সেই সমস্যাটি আলোচনায় এল না। খানিক ঘোলাটে যুক্তি আর অনেক আবেগ নিয়ে সে লড়াইটা অর্থহীন তরজায় শেষ হল। ইংরেজি শিক্ষা বিদ্যালয়ে তার হৃত আসন আবার ফিরে পেল বটে, কিন্তু ইংরেজি শিক্ষার কী হল সে খবর কে নেবেন? বাংলা ভাষাটিই কেমন শিখছে ছেলেমেয়েরা সে খবরই বা কে রাখবেন? আর কত দিন শিক্ষক সমাজ ‘প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী’র পুরনো রেকর্ডটি চালিয়ে যাবেন? সক্ষম শিক্ষকরা এই অন্ধকার দূর করতে এগিয়ে না এলে অক্ষম প্রাইভেট টিউটররা সে শূন্যতা পূরণ করতে আছেন। ফল ভয়াবহ। কেরলের স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটি কথা বলা হত— গুড হেলথ অ্যাট লো কস্ট। এখন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা সম্পর্কে বলতে হয়— ব্যাড এডুকেশন অ্যাট হাই কস্ট।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement