—প্রতীকী চিত্র।
ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’ এই কবিতায় ধর্মমোহের মোকাবিলা করতে রবীন্দ্রনাথ ‘বুদ্ধির আলো’ জ্বালানোর, ‘জ্ঞানের আলোক’ আনার আবেদন রেখেছিলেন। তাঁকে নিছক উদ্ধৃত না করে বরং তাঁর আবেদনে সাড়া দেওয়ার সামান্য প্রয়াস করা যাক।
এই প্রয়াসে প্রথম যে প্রশ্ন তুলতে হবে তা হল— ধর্ম ব্যাপারটা কী? ইদানীং শুনছি ধর্ম আমাদের দেশে ইতিহাসের দরজা খুলতে সাহায্য করছে; কিন্তু প্রশ্নটির উত্তর পেতে হলে আমাদের গভীরতর ইতিহাসের দরজায় কড়া নাড়তে হবে, যে ইতিহাসচর্চার ভিত্তি মানবপ্রকৃতির অনুধাবন। ধর্ম একটা শক্তিশালী ‘সাইকোট্রপিক’ প্রক্রিয়া যা আমাদের শরীরে সুখানুভূতির হরমোনগুলির নিঃসরণ ঘটায়। জীবন ও জগতের যা কিছু মানুষের বোধবুদ্ধির বাইরে, উপরন্তু তাকে নিয়ত জ্বালাযন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা, অস্থিরতায় ভোগায়, ধর্ম সে সবের ব্যাখ্যা দেয়। বিশ্বসংসারের একটা গভীর অন্তর্লীন অর্থ খুঁজে দিয়ে সেখানে মানুষের অবস্থান নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। সব রকম সমস্যার মোকাবিলায় ভরসা জোগায়। ধর্মের এই ভূমিকা ব্যক্তিমানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও। আবেগ আর মনন দু’দিক থেকেই ধর্ম মানুষের বিরাট অবলম্বন, কখনও জাদুশক্তির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে, কখনও দার্শনিক চিন্তার পথ প্রশস্ত করে। আবার ‘ফাংশনালিস্ট’ সমাজতত্ত্ববিদরা ধর্মকে গুরুত্বপূর্ণ সমাজবন্ধন হিসাবে দেখেন। একই ধর্মীয় প্রতীকের অংশীদারি করতে গিয়ে অনেক মানুষ একটি ধর্মের ছাতার তলায় ঐক্যবদ্ধ হয়। ধর্মের সামাজিক জায়গাটায় ধর্মলালিত নৈতিকতারও বড় ভূমিকা। সত্যি, মরা আর মারা তো ধর্মের প্রাথমিক ‘ফাংশন’ নয়, বরং তা হল বাঁচা আর বাঁচানো, যার জন্য চাই সংবেদনশীলতা, ভালবাসা, ঔদার্য আর সে সবের সঙ্গে জড়িত নৈতিকতা। সভ্যতার গোড়ার দিকে মানুষ যখন বড়ই অসহায়, তখন ধর্মের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল খুব বেশি করে। এক-এক জায়গার এক-একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতীক-সম্বলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিকশিত হতে থাকে। কিন্তু সমরূপ তাগিদই ছিল সব ক’টির উৎস। সে দিক থেকে কৃষ্ণ-খ্রিস্ট, রাম-রহিম মূলত একই।
শতাধিক বছর আগে নৃতত্ত্ববিদ জেমস ফ্রেজ়ার বলেছিলেন, সভ্যতার যাত্রা ম্যাজিক থেকে ধর্ম, ধর্ম থেকে বিজ্ঞানের দিকে। কথাটা বলেছিলেন অপ্রতিরোধ্য বলে প্রতিভাত ‘আধুনিকতা’র আবহে— ধর্ম থেকে যুক্তিবুদ্ধি ও ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে যাত্রাকে কিনা আধুনিকতার বড় উপাদান মনে করা হয়! ফ্রেজ়ারের ভবিষ্যদ্বাণী, বলা বাহুল্য, মেলেনি। বরং গত কয়েক দশক ধরে ধর্মের পুনরুজ্জীবন দুনিয়া জুড়ে। কারণ মানুষের অসহায়তা, অনিশ্চয়তা, জীবনযন্ত্রণা অব্যাহত। আর প্রাক্-আধুনিক কৌমগুলির ভাঙনের মুখে নতুন রকম সমাজবন্ধনের তাগিদও প্রবল— অসহায় ব্যক্তিমানুষের সমষ্টির আশ্বাস চাই যে! মুশকিল হল, মানুষের সামাজিকতায় নৈতিকতার বোধ প্রায়ক্ষেত্রেই বিভাজিত। যাকে ‘আমাদের লোক’ মনে করি, তার সম্পর্কে আমার নৈতিক মূল্যবোধ সক্রিয়, ‘অপর’-এর ক্ষেত্রে কিন্তু নয়। আর ধর্ম যেমন সমাজবন্ধনের কাজ করে, তেমনই মানুষকে সঙ্কীর্ণ অস্মিতার বাক্সে বন্দি করে অপরায়ণের হাতিয়ারও হয়ে ওঠে। তাই ধর্মের নামে হানাহানি ইতিহাসে কম হয়নি— বিভিন্ন ধর্ম, এমনকি একই ধর্মের ভিতরেও। হিন্দু-মুসলমান, মুসলমান-খ্রিস্টান, শৈব-বৌদ্ধ, শাক্ত-বৈষ্ণব, শিয়া-সুন্নি উদাহরণ সুপরিচিত। ইউক্যারিস্ট অর্থাৎ গির্জায় বিতরিত রুটি আর মদ সত্যি জিশুর মাংস আর রক্ত কি না, এমন বিষয়কে কেন্দ্র করে একদা ইউরোপে রক্তগঙ্গা বয়েছে। আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া ধর্মীয় সংঘাত-সংঘর্ষকে আরও উস্কে দেয়। কারণ, একদা নাহয় যারা প্রতিবেশী হিসাবে পাশাপাশি বাস করত, তারা মোটামুটি একই ধর্মীয় প্রতীকে বিশ্বাসী ছিল; আধুনিক যুগে কিন্তু হরেক প্রতীকে বিশ্বাসী মানুষ কাছাকাছি থাকে। আজকে তাই ধর্মমোহের বিপদ খুব বেশি। সুতরাং ধর্ম দু’দিকে-কাটা তরোয়াল।
তাই সাইকোট্রপি হিসাবে ধর্মের ভূমিকাও জটিল, যা আরও জটিল করে তোলে ধর্মের নিয়ন্ত্রক তথা শাসকবর্গ। শ্রেণিবিভাজিত বৈষম্যভিত্তিক সমাজের শাসকরা মানুষের মনে ধর্মমোহ জাগিয়ে নিজেদের ক্ষমতা সুরক্ষিত করে। কথাটা সর্বকালে, সর্বদেশে সত্যি— সে রাজতন্ত্রই হোক, বা গণতন্ত্র। শাসকশ্রেণির পোষিত ধর্মে শামিল হয়ে বঞ্চনা-নিপীড়নকে সহ্য করে নেয় মানুষ। তাই যে কালো মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়ে পীড়ন করা হয়, তাদের আবার খ্রিস্টীয় ভগবানের ভক্তও করে তোলা হয়। এ সবই হল সাইকোট্রপির খেলা।
এই প্রসঙ্গে সাইকোট্রপি সম্পর্কে দু’চার কথা। সাইকোট্রপি দুই রকমের, অটোট্রপি আর টেলিট্রপি। কেউ নিজের শরীরে কোনও হরমোনের ক্ষরণ ঘটালে সেটা অটোট্রপি; যা সচরাচর ডোপামাইন, অক্সিটোসিন বা সেরোটোনিনের মতো সুখদায়ক হরমোনই হয়। ভাল বই পড়ে, গান শুনেও এটা হতে পারে, আবার আফিম খেয়েও হতে পারে। সব অটোট্রপিই কিন্তু কমবেশি নেশা ধরাতে পারে। টেলিট্রপি হল অন্যের শরীরে কোনও হরমোনের ক্ষরণ ঘটানো। এটা আবার দু’রকমের, শোষণমূলক আর মিথস্ক্রিয়ামূলক। অন্যকে আতঙ্কিত করে হরমোনের ক্ষরণ ঘটালে তা শোষণমূলক। আবার দুই বন্ধু যখন গল্প করে, মা যখন সন্তানকে আদর করে, দু’জনেরই আরাম হয়— সেটা মিথস্ক্রিয়ার উদাহরণ। শোষণ আর মিথস্ক্রিয়া কিন্তু গুলিয়ে যেতে পারে, যেমন ধর্মের ক্ষেত্রে। ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মীয় আচার মানুষকে নিঃসন্দেহে আরাম দেয়— সে নিজেই তাই দু’হাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করে (অটোট্রপি)। সেই সুযোগে কিন্তু শাসকশ্রেণি তাকে শোষণও করে থাকে (টেলিট্রপি)। আজ উন্নত প্রযুক্তির দৌলতে শাসকের পক্ষে মানুষকে ধর্মমোহে মজানোর সুযোগ অনেক বেশি; কিন্তু যখন এত প্রযুক্তি ছিল না তখনও অটোট্রপির তাগিদে মানুষ সহজেই ধর্মমোহে আচ্ছন্ন হত। এমন দৃষ্টান্ত আছে যে, ধর্মপ্রচারক হয়তো বড় সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন, পিছন দিকে অধিকাংশ মানুষের কানেই পৌঁছচ্ছে না। তবু তারা আপ্লুত— হাসছে, কাঁদছে, মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সাধে কি আর মার্ক্স ধর্মকে আফিম বলেছিলেন!
অল্ডাস হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড-এ এক রাজ্যের কথা আছে, যেখানে শাসকরা ল্যাবে শিশু উৎপাদন করে, তার পর তাদের মগজ ধোলাই করে; আর দেদার বিতরণ করে এক ড্রাগ, যা মানুষকে বোঝায় তারা কত সুখী! এই ভাবে আলফা-বিটা-গামা ইত্যাদি শ্রেণিতে বিভক্ত সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শাসকের সুবিধা হয়। বাহুবলভিত্তিক শাসনের চেয়ে অনেক সহজ আর নিশ্চিত উপায়। আজকে আমাদের দেশে শাসকরা ধর্মকে ব্যবহার করছেন এ রকমই মাদকদ্রব্যের মতো, যাবতীয় অভাব-অভিযোগের তির ঘুরিয়ে দিতেও সক্ষম হয়েছেন। ফলে একেবারে বাজিমাত। মানুষের শারীর-রসায়নে বিরাট উদ্দীপনার সঞ্চার!
মজার কথা, রাজনীতি বা সমাজে কোনও প্রতিপক্ষই এই চালাকিটা অনাবৃত করে দিয়ে সেটাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখাচ্ছে না। বড় জোর ইতিহাস থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ দেওয়া আর সর্বধর্ম সমন্বয়ের সরল আহ্বান। অনেক রাজনীতিক প্রবল ভাবে ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে ধর্মের মোকাবিলার চেষ্টায় আছেন। পা ঠুকে যুক্তিবুদ্ধির বিকল্প পথ বাতলানো মার্ক্সবাদীদের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না। তাঁদের রুটি-রুজির পন্থা বিকল্প হিসাবে যথেষ্ট নয়, মানুষের আত্মারও কিছু চাহিদা আছে। আসলে মার্ক্সবাদীরা তো অন্যের রাজনীতিই করে এসেছেন বরাবর; উপরন্তু মতাদর্শটি যেন তাঁদের মোহের মতো, ‘অভ্রান্ত বিজ্ঞান’ মোড়কে ধর্মীয় সংস্কার। মোহ দিয়ে কি মোহের মোকাবিলা সম্ভব? মোহমুদ্গর চাই যে!
আগ্রাসনের জন্য নখদন্ত তো নয়, মানুষ নামে প্রাণীটির বল নাকি মগজাস্ত্র। তা এটুকু তো তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা যায় যে, ১) ধর্মীয় প্রতীকগুলি কিন্তু বাস্তব নয়, পুরাণও নয় ইতিহাস। এটা ঠিক যে, মানুষ কল্পনাপ্রবণ প্রাণী এবং তার কল্পনায় প্রতীকের বড় স্থান। প্রতীক বাস্তবকে বুঝতে, তার গভীর অর্থ খুঁজে পেতে আমাদের সাহায্য করে। তবু আজকের দিনে এক জন প্রকৃতিস্থ মানুষের প্রতীক আর বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য করা দরকার। যে সেটা করতে পারে না, তাকে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলেন ‘স্কিটজ়োফ্রেনিক’। ২) ধর্ম ছাড়াও মানুষের আত্মাকে আরাম-আনন্দ দেওয়ার মতো আরও অনেক সাইকোট্রপি আছে— যা জ্ঞানবিজ্ঞান, সৃজনশীলতার মধ্যে লভ্য। ৩) অতীত যতই প্রেরণার উৎস হোক, ‘আমরা কারা?’ ‘কোথায় আমাদের শিকড়?’ গোছের অতীতমুখী প্রশ্ন যেন ‘আমরা কেমন পৃথিবী তৈরি করতে চাই?’ এই ভবিষ্যৎমুখী প্রশ্নটাকে প্রতিস্থাপন না করে, কারণ দ্বিতীয়টাই আসলে আমাদের জীবনমরণের প্রশ্ন।