মৈত্রী কি ফিকে হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে আমেরিকার কঠিন মুখ?
India-USA Relations

বড় সুখের সময় নয়

রাশিয়া, ইউক্রেন আক্রমণ করার পর আমেরিকা এবং পশ্চিমের শত হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও ভারত নিষেধাজ্ঞা মানেনি। রাশিয়া থেকে গ্যালন গ্যালন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে গিয়েছে।

Advertisement

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:০৫
Share:

বিলীয়মান: সৌহার্দের ছবি ফুটেছিল সেই আমেরিকা সফরে, প্রধানমন্ত্রী মোদী ও প্রেসিডেন্ট বাইডেন, জুন ২০২৩। রয়টার্স।

রাজা আসে যায়, রাজা বদলায়, জামার রং বদলায়, কিন্তু বিদেশনীতির বড় বদল হয় না। নতুন বছর শুরু হল রামমন্দির তথা হিন্দুত্বের জোয়ারে ভেসে, তার পরেই শুরু হবে লোকসভা নির্বাচন। বিজেপির ‘চারশো পার’ করার হুঙ্কার সত্ত্বেও এখনও স্পষ্ট নয়, বছরের শেষে কোথাকার তরোয়াল কোথায় রাখা হবে। কিন্তু এই আভাস এখনই পাওয়া যাচ্ছে, চব্বিশের বিশ্ব মানচিত্রে ভারতের সমঝোতা, স্নায়ুযুদ্ধ এবং দর-কষাকষির ক্ষেত্রগুলি বড় সহজ হবে না।

Advertisement

হিংসায় উন্মত্ত হচ্ছে পৃথ্বীর ভূকৌশলগত পরিণতি। বাইশে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের উল্টো দিকের চেয়ারে বসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, “এই সময় খণ্ডযুদ্ধের নয়। বরং সংলাপের, কূটনীতির, জ্বালানি, খাদ্য ও কৃষি সারের নিরাপত্তা সুসংহত করার।” এ যে আর্ষবাক্য, তাতে তিলার্ধ সন্দেহ নেই। কোন সময়েই বা যুদ্ধের ঔচিত্য আমরা দাগিয়ে দিতে পারি আধুনিক বিশ্বে? কিন্তু ব্যাপার হল, ওই সব বাক্যে মস্কোর চিঁড়ে ভেজেনি। পশ্চিমি দেশগুলির প্রচ্ছন্ন করে-রাখা চিঁড়েও ভিজেছিল কি? জানুয়ারির কুয়াশাঘেরা সাউথ ব্লক আরও বেশি করে টের পাচ্ছে, এই সময়খণ্ড আসলে আরও গভীরতর যুদ্ধের ভিতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ভারসাম্য টিকিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়।

কাজটা আরও কঠিন হয়ে গিয়েছে বছরের শেষার্ধে জোড়া ষড়যন্ত্রের খর অভিযোগ ভারতের দিকে ওঠার পর। বিশ্ব-বাণিজ্যে ভারতের দুই বড় খুঁটি আমেরিকা এবং কানাডার সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ক্রমশ ফাটল হচ্ছে। কানাডা বলছে, ভারতের পাশার দানে খুন হয়েছেন সে দেশের নাগরিক হরদীপ সিংহ নিজ্জর। অন্য দিকে আমেরিকা বলছে, শেষ পর্যন্ত না পারলেও ভারত চেষ্টা করেছিল আমেরিকার নাগরিক গুরপতবন্ত সিংহ পান্নুনকে খুন করতে। ঘটনা হল, পাকিস্তান, বালুচিস্তানে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে এই ধরনের গোপন মিশন চালানোর অভিযোগ অহরহ তোলে। কিন্তু পাকিস্তানের অভিযোগের যা দম, তা রাষ্ট্রপুঞ্জের বিখ্যাত টেবিল পর্যন্ত পৌঁছনোর ঢের আগেই বুদবুদ হয়ে মিলিয়ে যায়। কিন্তু আমেরিকা এবং কানাডা যে পাকিস্তান নয়, সে কথা ভারতীয় কূটনীতিকদের চেয়ে ভাল আর কে বোঝেন!

Advertisement

রাশিয়া, ইউক্রেন আক্রমণ করার পর আমেরিকা এবং পশ্চিমের শত হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও ভারত নিষেধাজ্ঞা মানেনি। রাশিয়া থেকে গ্যালন গ্যালন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দূত হয়ে এস জয়শঙ্কর পশ্চিম বিশ্বকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, সবার উপরে জাতীয় নিরাপত্তা সত্য, তাহার উপরে নাই। বলেছেন, “যা আমরা রাশিয়া থেকে একমাসে কিনি, ইউরোপ কেনে এক বিকেলে।” গোটা দু’হাজার তেইশ-ই এ ভাবে রাজার মেজাজে কূটনীতির রথ চালনা করে জি২০-র রাজসূয় পর্যন্ত পৌঁছেছিল ‘বিশ্বগুরু’র রথের ঘর্ঘর। আর তার পরই বর্ষশেষে তালগোল পাকিয়ে গেল, যা এ বছর নয়াদিল্লিকে ভোগাবেই, সে মোদী চারশো পার করে আসুন বা না আসুন।

দৃশ্য তৈরির কূটনীতি এখন দূর অস্ত্। তাই পাঠক থুড়ি দর্শকের সামনে প্রথমে একটি ছবি সাজিয়ে দেওয়া যাক, যা গত বছরের মধ্যযামের। রাশিয়ার তেল আমদানি সত্ত্বেও, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে বার বার আমেরিকার চাপ কাটিয়ে মস্কোবিরোধী ভোটাভুটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পরেও মোদী তথা ভারতকে তখনও কৌশলগত মিত্র হিসাবে ভ্লাদিমির পুতিনের ‘বাঁকা ঘাড় সিধে করা’-র কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মনে করছিল বাইডেন প্রশাসন। সেই ছবি ছিল ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসের। সে এক বর্ণাঢ্য নৈশভোজ, যার মধ্যমণি ছিলেন মোদী। প্রোটোকলের ধার না ধেরে ভারতীয় কায়দায় তিনি বজ্র আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিলেন বাইডেনকে। ভিন্ন শরীরী-ভাষার কূটনীতিতে অভ্যস্ত বাইডেনও প্রতি-আলিঙ্গনে কার্পণ্য করেননি সেই রাতে। জয়পুরের শিল্পীর তৈরি চন্দনকাঠের বাক্সে রুপোর নারকেল, মাইসুরু-র চন্দনকাঠ, তামিলনাড়ুর সাদা তিল, গুজরাতের লবণ, পঞ্জাবের ঘি, ঝাড়খণ্ডের সিল্ক, উত্তরাখণ্ডের চাল, মহারাষ্ট্রের গুড়— এক কথায় ভারতাত্মার এক মালাই উপহার দিয়েছিলেন মোদী সেই রাতে জো বাইডেনকে। অন্য দিকে, বাইডেনও হাতে তৈরি প্রাচীন আমেরিকার পুঁথি, ভিন্টেজ ক্যামেরা, ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফির বই, কবিতার বই উপহার দেন মোদীকে। এই উপহার বিনিময়ের সাংস্কৃতিক গভীরতায় নয়াদিল্লির বিদেশ মন্ত্রকের একটি বড় অংশ তখন আকুল হয়ে এটাই প্রচার করেছিলেন, ভারত তার নিজের শর্তে বিদেশনীতি পরিচালনা করেও খোদ আমেরিকার কাছ থেকে এই সম্মান কেড়ে নিতে সক্ষম— প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জোরে।

এই মুহূর্তে বাইডেন প্রশাসনই আমেরিকান কংগ্রেসের পাঁচ ভারতীয় বংশোদ্ভূত সদস্যকে নিয়ে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক সেরেছে পান্নুন খুন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নিয়ে। তার পরে কড়া ভাষায় যৌথ বিবৃতি দিয়ে ওই পাঁচ জন জানিয়েছেন, দিল্লির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা খুবই উদ্বেগজনক এবং বিষয়টির যদি সমাধান না করা হয় তবে আমেরিকা-ভারত সম্পর্কের ‘উল্লেখযোগ্য ক্ষতি’ হতে পারে। এখানেই না থেমে আমেরিকার অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতর নিউ ইয়র্কের এক আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে নিখিল গুপ্তা নামে এক ভারতীয় নাগরিক ও নাম উল্লেখ না-করা এক ভারতীয় অফিসারকে পান্নুন হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হিসাবে চেক প্রজাতন্ত্রে গ্রেফতার করিয়েছে। নিখিল গুপ্তার পরিবার সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে, বিদেশ মন্ত্রক চেষ্টা করছে তাকে ফিরিয়ে আনার, কিন্তু আমেরিকার মুষ্টি ক্রমশ বজ্র হতে দেখছি আমরা।

এহ বাহ্য। গত সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসাবে ভারত আমন্ত্রণ জানিয়েছে জো বাইডেনকে। গারসেটি-র এই স্বতঃপ্রণোদিত ঘোষণার দু’সপ্তাহ আগেই ভারতমণ্ডপম্-এ হয়ে গিয়েছে জি২০-র মহাসম্মেলন। জো বাইডেনের সঙ্গে আলিঙ্গনের ছবি তখনও ফিকে হয়নি। তদুপরি জি২০-র দিল্লি ঘোষণাপত্র প্রকাশের গৌরবে ভারত তখনও জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনে। কিন্তু এ বছরের শুরুতেই ভারতকে রূঢ় প্রত্যাখ্যানটি হজম করতে হল। মোদীর ডাক ফিরিয়ে দিলেন বাইডেন। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের কৌশল ছিল, ভারতে ওই সময় কোয়াড (ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান)-এর আরও একটি (জি২০-র পর) মহাযজ্ঞ করে সেই হাওয়াকে সঙ্গে নিয়ে লোকসভায় ঝাঁপানোর। কিন্তু বাইডেন না বলে দেওয়ায়, কোয়াডের অন্য রাষ্ট্রগুলিও আমেরিকাকেই অনুগমন করল, যেমনটা তারা করে থাকে।

প্রবল ভাবে মুখ পুড়ল সরকারের, রামমন্দিরের বিরাট ছায়ায় যাকে আড়াল করা হচ্ছে। ঘটনা হল, মোদী সরকারের এ-হেন অস্বস্তিটি তৈরি করল কে? বিদেশ মন্ত্রক বা মোদী সরকারের পক্ষ থেকে তো এক বারও বলা হয়নি, বাইডেন আমন্ত্রিত। তা হলে দেখা যাচ্ছে, খোদ বাইডেন প্রশাসনই খুঁচিয়ে ক্ষত তৈরি করল এ ক্ষেত্রে। বাইডেনের দূত গারসেটি যদি প্রকাশ্যে বিষয়টি ফাঁস না করে দিতেন যে, প্রজাতন্ত্র দিবসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আমন্ত্রিত, এই বিড়ম্বনা হত না নয়াদিল্লির।

সর্বশেষে আমেরিকা এবং কানাডার এই অভিনব সাঁড়াশি অভিযোগের মুখে, আত্মপক্ষকৌশল রচনায় ব্যস্ত সাউথ ব্লক এবং নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে চিনের সরকারি মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস-এ। এই ঘটনা নেহাতই সমাপতন নয়। আমেরিকার এই মুহূর্তে সর্বাধিক বৈরী-রাষ্ট্র চিন, দাবার আগাম দশ চাল না ভেবে নিজের একটি বোড়েকেও সামনে ঠেলে না। হঠাৎই দু’হাজার চব্বিশের গোড়ায় শি জিনপিং-এর করা মোদীর উপর পুষ্পবৃষ্টি আমেরিকা, কানাডা তথা পশ্চিম বিশ্বকে সন্দিগ্ধতর করে তুলবে কি না, এই প্রশ্ন উঠছে অনেক দেশের অন্দরেই। এমনিতেই আমেরিকার নাগরিক হত্যায় সন্দেহে জর্জরিত হয়ে রয়েছে এই দু’টি দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক।

গত বছরে যে কবিতার বই হোয়াইট হাউসের উজ্জ্বল ঝাড়বাতির তলায় মোদীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বাইডেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল রবার্ট ফ্রস্ট সঙ্কলন। ফ্রস্টের সেই কবিতাগুলি মোদী পড়েছেন কি না, জানা নেই। তবে নতুন বছরে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক সুস্থির করে, হারানো আস্থা অর্জন করে, দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছতে বহু মাইল হাঁটতে হবে ভারতকে। গভীর এবং জটিল আজকের এই ভূকৌশলগত অরণ্যের মধ্যে— কাঁটা ও কাঁকর বাঁচিয়ে। ফ্রস্টের ওই বিশ্বখ্যাত কবিতার পঙ্‌ক্তির মতোই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement