World Happiness index 2023

সবাই তো সুখী হতে চায়

প্রতিটি মানুষেরই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা, লক্ষ্য, প্রত্যাশা থাকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্ব বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ভিন্ন ভিন্ন হয়।

Advertisement

চিরদীপ মজুমদার

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৫১
Share:

কেউ কেউ আকাঙ্ক্ষা না মিটলেও তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন। প্রতীকী ছবি।

গত মাসে প্রকাশিত হল ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইন্ডেক্স ২০২৩’। গড় সুখের মানের ক্রমপর্যায়ে ১৩৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১২৬। তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান ১০৮তম, বাংলাদেশ ১১৮তম, নেপাল ৭৮তম। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান যথাক্রমে ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ডের।

Advertisement

প্রতিটি মানুষেরই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা, লক্ষ্য, প্রত্যাশা থাকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্ব বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ভিন্ন ভিন্ন হয়। আশা-আকাঙ্ক্ষা না মিটলে মানুষ অসুখী, মিটে গেলে সুখী। কেউ কেউ আকাঙ্ক্ষা না মিটলেও তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন। তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম অসুখী। অর্থনৈতিক অবস্থান, পারিবারিক সম্পর্ক, নিজের বা পরিবারের অন্য কারও স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা দুঃখের প্রধানতম কারণ। আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল না হলে মানুষ অসুখী হন। পারিবারিক সমস্যায় পড়লেও। দেখা যাচ্ছে যে, বেকাররা অসুখী, বিবাহবিচ্ছিন্নরা বিবাহিতদের চেয়ে অসুখী, সন্তানহীনরা অপেক্ষাকৃত অসুখী। যে দেশে দারিদ্র বা বেকারত্ব বেশি, মূল্যস্ফীতির হার বেশি, ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কম, দুর্নীতি, অপরাধপ্রবণতা বেশি, সে দেশের মানুষ অপেক্ষাকৃত অসুখী। আবার সামাজিক সুরক্ষা, পারস্পরিক বিশ্বাস, প্রত্যাশিত আয়ু যে দেশে বেশি, সে দেশে মানুষ সুখী।

সমীক্ষার তথ্য বলছে যে, একই সময়কালে গড়পড়তায় যাঁদের আয় বেশি, তাঁরা বেশি সুখী। তবে আয়ের সঙ্গে সুখের সম্পর্ক এত সরল নয়। শুধু নিজের আর্থিক অবস্থান নয়, পারিপার্শ্বিকের তুলনায় কারও আর্থিক অবস্থান কী রকম, তার উপর সুখ নির্ভর করে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের তুলনায় কারও আয় বেশি হলে, তিনি বেশি সুখী। আপনার চার পাশের মানুষেরা আপনার চেয়েও খারাপ আর্থিক অবস্থানে থাকলে, কম আয়েও আপনি সুখী। অন্যদের তুলনায় এক জনের আয় কত বেশি, তার উপরেও সুখ নির্ভর করে। ধরা যাক, তিন বন্ধুর ২০২২ সালে বাৎসরিক আয় যা ছিল, ২০২৩ সালে প্রত্যেকের আয় বেড়ে দ্বিগুণ হল। এ ক্ষেত্রে তিন জনই আগের তুলনায় বেশি সুখ অনুভব করবেন। কিন্তু যদি ২০২৩ সালেও দুই বন্ধুর আয় একই থাকে ও তৃতীয় বন্ধুর আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়, তবে তৃতীয় বন্ধুটি আরও বেশি সুখ অনুভব করেন! আবার আয় বাড়লে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাড়ে, তা না-মেটার সম্ভাবনাও বাড়ে। অসুখী হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে।

Advertisement

জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন আয়, স্বাস্থ্য, পারিবারিক সম্পর্ক থেকে মানুষ সুখ লাভ করেন। কিন্তু আরও বেশি আয় প্রাপ্তির লক্ষ্যে মানুষ জীবনের অন্য ক্ষেত্রগুলোকে কম গুরুত্ব দেন। আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। বাড়ির আশা মিটলে গাড়ি কেনার আশায় আরও উপার্জনের চেষ্টা করেন। উপার্জন না বাড়লে গাড়ির প্রত্যাশা মেটে না, দুঃখ হয়। যাঁদের উপার্জন বাড়ে, তাঁদের গাড়ির প্রত্যাশা মেটে। গাড়ির প্রত্যাশা মিটলে একটা ফ্ল্যাট কেনার জন্য তাঁরা আরও বেশি আয়ের চেষ্টা করেন। আয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাশা বাড়ে, আরও জাগতিক বস্তু লাভের পিছনে মানুষ ছোটেন। এ বাঘের পিঠে এক বার সওয়ার হলে পরিবারের জন্য সময় থাকে না, নিজের বা পরিবারের অন্য সদস্যের অন্যান্য চাহিদার দিকে খেয়াল থাকে না। জাগতিক বস্তু লাভের ফলে যে সুখ, তা স্বভাবতই ক্ষণস্থায়ী। বরং জীবনের অন্য ক্ষেত্রগুলো অবহেলিত হওয়ার কারণে স্থায়ী দুঃখ নেমে আসে। একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার ইঁদুর দৌড়ে সবাই ছোটেন, সবাই আরও অসুখী হন।

জীবনের যে সব ক্ষেত্রে তুলনামূলক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ, যেমন আয়, সেই ক্ষেত্রগুলো বাদ দিয়ে যে সব ক্ষেত্রে তুলনামূলক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ নয়, যেমন স্বাস্থ্য, সেই সব ক্ষেত্রে অধিক মনোযোগ সুখ বাড়ায়। নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সীমিত রাখা, প্রত্যাশা না মিটলে বা জীবনের কঠিন সময়ের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারার মধ্যেই আছে সুখের চাবিকাঠি। আর্থিক ক্ষেত্রগুলো থেকে মন সরিয়ে অন্য ক্ষেত্রে বেশি সময় বিনিয়োগ করলে সুখানুভূতি বাড়ে। একটি রাষ্ট্রে বেশির ভাগ মানুষ যদি এই ইঁদুর দৌড়ে শামিল না হন, রাষ্ট্রও সামগ্রিক ভাবে সুখী হয়।

অতিমারির বছরগুলো সুখের অন্য একটা দিক স্পষ্ট করে দিল। ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইন্ডেক্স’-এর প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, যাঁরা ভেবেছেন যে সঙ্কটের সময় সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাওয়া যাবে, তাঁরা অতিমারির সময় অপেক্ষাকৃত সুখী থেকেছেন। পারস্পরিক বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ, দান, অনুগ্রহ, বদান্যতা, পরার্থপরতা কোভিডের সময় জীবন বাঁচিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মানুষকে সুখীও করেছে। অতিমারির সময় মানুষ অকৃপণ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাহায্যদাতা ও সাহায্যগ্রহীতা উভয়েই সুখী হয়েছেন। সুখী মানুষেরা আরও পরহিতৈষী কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। সাহায্য প্রাপকরাও সুখী হয়েছেন, পরার্থপরতায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন। পরার্থপরতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ পালনের মাধ্যমে সুখের খোঁজ মেলে, শিখিয়ে দিয়ে গেল অতিমারি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement