Krishnanagar

লোককল্পনার অলীক বিস্তার

এক দিকে দাবি, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, তাই তিনি বিশ্বাসঘাতক। অন্য দিকের দাবি, কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলান অত্যাচারী নবাব সিরাজকে মসনদ থেকে হটাতে, কারণ তা না করলে ‘সনাতন ধর্ম’ শেষ হয়ে যেত।

Advertisement

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:২৯
Share:

— ফাইল চিত্র।

আজকাল সমস্ত নির্বাচনের ঠিক আগে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারে জনপরিসরে যখন ধর্মীয় মেরুকরণ প্রবলতর হয়, আরও একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অন্যায় অবধারিত ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে— ইতিহাসের দেদার বিকৃতি। এ বারও তার ব্যতিক্রম হল না। ইতিহাসের অপব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় স্তরে পর্যন্ত সংবাদ-শিরোনামে উঠে এল মধ্যবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি লোকসভা কেন্দ্র, কৃষ্ণনগর। এই ভোটে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসাবে নদিয়া রাজপরিবারের এক জন সদস্যার নাম ঘোষণা হওয়ার পর থেকে একটি ‘বিতর্ক’ নতুন করে বাতাসে ছাড়া পেয়েছে— পলাশির যুদ্ধ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা-কে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের (১৭১০-১৭৮৩) ভূমিকা প্রসঙ্গ। যুযুধান প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিষয়টি নিয়ে তাদের নিজ নিজ কায়েমি স্বার্থ অনুযায়ী যুক্তি সাজিয়ে নেমে পড়েছে রণাঙ্গনে। রাজনীতি তাতে জয়ী, পরাজিত পক্ষ— ইতিহাস।

Advertisement

এক দিকে দাবি, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, তাই তিনি বিশ্বাসঘাতক। অন্য দিকের দাবি, কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলান অত্যাচারী নবাব সিরাজকে মসনদ থেকে হটাতে, কারণ তা না করলে ‘সনাতন ধর্ম’ শেষ হয়ে যেত। এক জন ইতিহাস-আগ্রহী পাঠক হিসাবে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এই দুই পক্ষের মতামতই সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক, তথ্যপ্রমাণ নয়, দুই বক্তব্যই অগভীর লোক-কল্পনা বা মিথের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। আর কিছু কল্পনাবিলাসী গদ্য ও কাব্য সাহিত্যের উপর।

তেমন সাহিত্যের উদাহরণ, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় লিখিত কল্পনাবিলাসী চরিতকথা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রম্ (রচনাকাল ১৮০৫, প্রকাশিত হয় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে), যাতে দেখানো হয়েছে কৃষ্ণচন্দ্র কলকাতায় গিয়ে সাহেবদের সঙ্গে যোগসাজশ করলেন এবং তার ফলে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হয়ে মীরজাফরকে মসনদে স্থাপন করল। আবার আমরা পাচ্ছি নবীনচন্দ্র সেনের ১৮৭৫ সালে লিখিত কাব্য ‘পলাশীর যুদ্ধ’, যেখানে কাল্পনিক সংলাপে রানি ভবানীর মুখে শোনা যায় “এ চক্রান্ত কৃষ্ণনগরাধিপের উপযুক্ত নয়”। নবীনচন্দ্রের কাব্যে নায়ক হলেন সিরাজের সেনাপতি মোহনলাল আর নায়িকা রানি ভবানী আর খলনায়ক হলেন রায় দুর্লভ, মীরজাফর, জগৎ শেঠ, ঢাকার দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ ও নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। সাহিত্যিক ও সিরাজউদ্দৌলার জীবনীকার অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-র গ্রন্থ সিরাজদ্দৌলা-য় সিরাজ হলেন হিরো আর তাঁর প্রতিপক্ষরা ভিলেন। এখানে রানি ভবানীকে দেখা যাচ্ছে সিরাজের বিরুদ্ধে জগৎশেঠদের গুপ্ত মন্ত্রণাকক্ষের তথাকথিত ষড়যন্ত্রীদের বিরোধিতা করতে। মৈত্রেয়র ‘সিরাজদ্দৌলা’-তে বলা হয়েছে যে, চক্রান্তকারীদের কাপুরুষোচিত আচরণে রানি নাকি এতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন, তিনি নদিয়ারাজকে পুরুষ হয়েও নারীর মতো আচরণ করার জন্য তাঁকে বিদ্রুপছলে শাঁখাসিঁদুর পাঠিয়েছিলেন। সাহিত্যের এই সব ঘটনা কিন্তু ইতিহাস-নির্ভর নয়, বরং একেবারেই কল্পনার অলীক উদ্ভাবন।

Advertisement

পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ গ্রন্থে রজতকান্ত রায় যে দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা হল সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে লোককল্পনাশ্রিত সাহিত্যের গতিপ্রকৃতিতে বদল আসে। রাজীবলোচন উনিশ শতকের শুরুতে (১৮০৫) কৃষ্ণচন্দ্রের চক্রান্ত নিয়ে গর্বভরে কাহিনি-সঞ্চার করছেন যখন, সে সময়ে ইংরেজ-সহায় হওয়া ছিল গর্বের বিষয়, তাই সেখানে কৃষ্ণচন্দ্র ‘হিরো’। কিন্তু আবার যখন নবীনচন্দ্র সেন বা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-রা উনিশ শতকের শেষ দিকে লিখছেন, তখন দেশাত্মবোধমূলক সাহিত্যের যুগ বলে সাহিত্যের মূল সুরটাই ইংরেজ বিরোধিতা, সুতরাং কৃষ্ণচন্দ্র ‘ভিলেন’।

সাহিত্যের নাহয় কল্পনার পাখাবিস্তারে লাইসেন্স ও স্বাধীনতা আছে, কিন্তু ইতিহাসের তো তা নেই। ইতিহাস দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলছে, পলাশির যুদ্ধের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে নদিয়ার জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের কোনও যোগই নেই। ইতিহাসবিদ জন মার্শম্যান হিস্ট্রি অব বেঙ্গল-এ লিখেছেন, “এদেশে সেরাজদ্দৌলার হস্ত হইতে পরিত্রাণ লাভের জন্য হিন্দু জমিদারগণেরা ইঙ্গরেজদিগকে আহ্বান করিয়া আনিবার যে কথা আছে তাহা সম্পূর্ণ অমূলক। বর্দ্ধমান, নদীয়া, রাজশাহী প্রভৃতি কোনও প্রদেশের জমিদার নিশ্চয় এই রাজবিপ্লবের কোনও সংস্রবে ছিলেন না, তাঁহারা কর-সংগ্রাহকমাত্র ছিলেন; সুতরাং এ বিষয়ে তাঁহাদের হস্তার্পণ করিবার কোনও অধিকার ছিল না।” আধুনিক যুগে ক্রিস্টোফার বেলি, পিটার জেমস মার্শাল প্রমুখ কেমব্রিজ ইতিহাসবিদদের মতামত পলাশির চক্রান্ত নিয়ে ইংরেজদের কোনও পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না, মুর্শিদাবাদ দরবারের অন্তর্দ্বন্দ্বই ইংরেজদের অনিবার্য ভাবে বাংলার রাজনীতিতে টেনে এনেছিল। ইতিহাসবিদ সুশীল চৌধুরীর অভিমত, “পলাশির প্রাক্‌কালে যে সব ঘটনাবলী এবং আমাদের কাছে যে সব নতুন তথ্যপ্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে স্পষ্টত দেখা যাবে, ইংরেজরাই মূল ষড়যন্ত্রকারী।”

যাবতীয় প্রাসঙ্গিক নথি ও প্রামাণিক ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় সিরাজের বিরুদ্ধে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্র বা হিন্দু জমিদারদের কোনও যোগাযোগের ইঙ্গিত ইতিহাস দেয় না। বরং কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে ইংরেজদের যোগাযোগের নথি পাওয়া যায়। ক্লাইভ যখন পলাশির অভিমুখে যাচ্ছেন, তখন ব্রিটিশ প্রশাসক রজার ড্রেক চিঠিতে জানাচ্ছেন যে, কৃষ্ণচন্দ্রের মতো রাজপুরুষদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছে। কিন্তু এই জাতীয় উল্লেখ পলাশির ষড়যন্ত্রে নদিয়া রাজের যুক্ত থাকার প্রমাণ হিসাবে গণ্য হতে পারে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement