—প্রতীকী ছবি।
পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়ুদূষণের মতো বিষয়গুলি এ বছর লোকসভা নির্বাচনে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু এগুলি কি কোনও দল বা প্রার্থীর অগ্রাধিকার বা নিশ্চয়তা প্রদানের বিষয় হয়ে উঠেছে? গণ আন্দোলন বা রাজনৈতিক প্রশ্ন না হয়েও কি আমরা কখনও দেখতে পাব যে, বায়ুর গুণমানের উন্নতি ঘটছে?
দীর্ঘকাল ধরে জনগণ যা চায়, ইস্তাহারগুলি সেইমতো তৈরি হয়। সেই বিষয়ই গুরুত্ব পায় যা ভোট আনবে। কয়েক দশক আগের রোটি-কপড়া-মকান তাই হয়ে ওঠে বিজলি-পানি-সড়ক; সাম্প্রতিক অতীতে তা চাকরির সুযোগ, দুর্নীতি-রোধ। কিন্তু বায়ুর গুণমান জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলির অগ্রাধিকার-তালিকায় আসেনি এখনও। অপর্যাপ্ত তথ্য, বায়ুদূষণের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা প্রচারে স্থানীয় সরকারি সংস্থার দুর্বল প্রচেষ্টা বায়ুদূষণকে করে তুলেছে অনাগ্রহ ও অবহেলার বিষয়।
অধিকাংশ মানুষের কাছে বায়ুর খারাপ গুণমান এক ‘অনস্বীকার্য পরিবেশগত অবস্থা’। সমাজের উপরতলার মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা একে দেখেন এক ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল জাতির ইঙ্গিত হিসেবে। তাঁরা বিশ্বাস করেন, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গুণমান যা-ই হোক, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা যে পরিবেশই রেখে যাই না কেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে আপস করা যায় না। অনগ্রসর শ্রেণির মানুষেরা বায়ুদূষণ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। আমরা তখনই বায়ুদূষণকে সমস্যা বলে দেখি যখন গাড়ির ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে, ধুলোয় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়। ২০১৯-এর এক সমীক্ষামতে, বায়ুদূষণের জন্য বার্ষিক মৃত্যুর অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ২.৭ লক্ষ কোটি টাকা, যা দেশের জিডিপি-র প্রায় ১.৩৬%। আর এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর বায়ুদূষণ ৫০% ধীর গতিতে বৃদ্ধি পেলে ভারতের জিডিপি ৪.৫% বেশি হত।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন স্মিথ কুজ়নেটস-এর তত্ত্ব অনুসরণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশগত ক্ষতির মধ্যে সম্পর্কের এক লেখচিত্র-উপস্থাপনায় দেখানো যায় যে, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ক্ষতি বাড়তে থাকে, এক সময় তা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের (মাথাপিছু আয়) একটি ‘স্তর’-এ পৌঁছনোর পরে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি পরিবেশগত উন্নতির দিকে পরিচালিত করে। তখন ধীরে ধীরে পরিবেশের ক্ষতি কমতে থাকে। ফলে কেউ বলতে পারেন, রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের অবস্থান তো কুজ়নেটস-এর তত্ত্বানুসারী— এমন এক দিন আসবে যখন আরও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিবেশের ক্ষতি করবে না, তাকে উন্নত করতে সাহায্য করবে। সমস্যা হল, অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই ‘স্তর’ বা চৌকাঠকে আমরা কী ভাবে চিহ্নিত করব? আমাদের ঠিক কত দূর যেতে হবে? এবং, কতটা দেরি মানে ‘খুব দেরি’?
বায়ুদূষণকে মূলধারার সমস্যা হিসেবে দেখতে গেলে, তাকে রাজনৈতিক বিষয়, ভোটের প্রশ্ন হয়ে উঠতে হবে। তাকে নিয়মিত কাগজের প্রথম পাতায়, ‘প্রাইম টাইম’ আলোচনায় স্থান পেতে হবে। কিন্তু তা ঘটতে হলে মানুষকে সত্যিকার অর্থে বায়ুদূষণ সম্পর্কে যত্নশীল হতে হবে। এ কঠিন কাজ, কিন্তু অসম্ভব নয়। প্রয়োজন প্রকৃত জনসচেতনতা। সরকারি সংস্থার পাশাপাশি শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ ও আমলাদের কাজ হবে মানুষের মধ্যে এই বোধ আনা যে, বিশুদ্ধ বায়ুও এক মৌলিক অধিকার।
২০১৯-এ চালু হওয়ার পর থেকে ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম (এনসিএপি)-র বাস্তবায়নে সরকার ১০০০ কোটি টাকারও বেশি দিয়েছে, উন্নত বায়ুর গুণমান অর্জনে যা প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। এরও ফাঁকফোকর আছে, তবু এনসিএপি-র লক্ষ্য অর্জনের যথেষ্ট সুযোগও রয়েছে। সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলির একটি: মূল গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ ছাড়াও তহবিলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দূষণ হ্রাসের লক্ষ্যে ‘অন-গ্রাউন্ড’ কাজের জন্য বরাদ্দ করা। এই কাজের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত কেন্দ্রীয় পরিকাঠামো-সহ এক বায়ুদূষণ কর্মসূচি, নীতি ও কৌশলগুলির বিকেন্দ্রীকরণ, জেলা ও স্থানীয় সংস্থার মাধ্যমে তাদের প্রসার।
পুরসভার প্রতিটি ওয়র্ড, ব্লকের প্রতিটি গ্রামের সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সংস্থার উচিত আশপাশে দূষণের উৎস ও সেই সঙ্গে বায়ুর গুণমান উন্নত করার সুযোগ সন্ধানে অনুপুঙ্খ সমীক্ষা করা। এই তথ্য এলাকাবাসীকে জানানো দরকার; দরকার তৃণমূল স্তরে ‘হটস্পট’ চিহ্নিত করার গুরুত্ব বোঝানো, বৃহৎ-স্তরের দূষণ কমাতে যা খুব জরুরি। বায়ু চলাচলের অনুকূল উন্মুক্ত এলাকা চিহ্নিত করতেও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত। চিহ্নিত করতে হবে দূষণের কারণ। উন্মুক্ত জলাশয়, শহরের প্রতি ওয়র্ডে সবুজের পরিমাণ, অবিলম্বে ‘গ্রিন জ়োন’ চিহ্নিত করে তাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে। বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকদের সহায়তায় পুরসভা বা ব্লক স্তরে নিয়মিত প্রচার করা উচিত। লক্ষ্য হবে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা প্রসার, যে কাজ করণীয় ও যা করা উচিত নয় তার নির্দেশিকা প্রদান।
এ ভাবেই বিশুদ্ধ বাতাসের চাহিদা ছড়িয়ে দিতে হবে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট, জল সরবরাহে বিঘ্ন, বেহাল রাস্তাঘাট যদি আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের সামনে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে শামিল করাতে পারে, বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য আমরা তা করতে পারব না কেন?