—ফাইল চিত্র।
ছোট্ট ছেলেটি ভিজে পোশাকে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁপছিল। তত ক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে, বেশি ক্ষণ ও ভাবে থাকলে জ্বর হতে পারে, আশঙ্কায় শিক্ষকরা তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছিলেন। অযাচিত ছুটি পেলে শিশুরা খুশি হয়, অথচ বাড়ি যাওয়ার কথা শুনেই সে কাঁদতে শুরু করল। তার মা দিনের বেলা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন, বাবা ভিন্ রাজ্যে, মিড-ডে মিলের আশায় সে স্কুলে এসেছে, বাড়ি গেলে খাওয়া জুটবে না।
রেশন দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান বনমন্ত্রীর গ্রেফতার নিয়ে চলন্ত বাসে যাত্রীদের কথার মাঝে ঘটনাটি বলছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার এক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। বলছিলেন, ছোট শিশুকে মিড-ডে মিলের ভাত খাইয়ে দেওয়ার সময় ক্ষুধার তাড়নায় সন্তানের থালা থেকে মা ভাত খেয়ে নিচ্ছেন, এমন দৃশ্যও চোখে পড়ে। চোখ সরিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তাই স্কুলে ছুটি পড়লে শিশুদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মায়েদেরও মন খারাপ হয়।
স্কুলগুলোতে মিড-ডে মিলের অনিয়ম নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। কখনও তা খাবারের গুণমান নিয়ে, কখনও সরকারি নিয়ম অনুযায়ী শিশুদের পুষ্টির জন্যে যে তালিকা মেনে খাবার দেওয়ার কথা, সেই তালিকা না মানা নিয়ে। এ বছরই জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকেরা এ রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে মিড-ডে মিলের হাল-হকিকত দেখতে এসেছিলেন, তখন দেখা গিয়েছিল, বিভিন্ন স্কুলের মিড-ডে মিলের খাদ্যতালিকা, খাদ্যের গুণগত মান, রন্ধনশালা ও তার কর্মীদের পোশাক ও পরিচ্ছন্নতার রাতারাতি পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যাপারটা যে কৃত্রিম ও ক্ষণস্থায়ী, তা অবশ্য অচিরেই বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনা এ-ও দেখিয়েছিল, সদিচ্ছা থাকলে, দুর্নীতিমুক্ত পরিস্থিতিতে অবস্থার উন্নতি অসম্ভব নয়।
বিদ্যালয়ের শিশুদের মতোই— অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, স্তন্যদাত্রী প্রসূতি ও অনূর্ধ্ব-ছয় বয়সি শিশুর পরিপূরক পুষ্টির জন্যে সুসংহত শিশুবিকাশ প্রকল্প (আইসিডিএস)-এর আওতায় চলা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি থেকে দেওয়া খাবারের উপর নির্ভরশীল, এ রাজ্যে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। সেখানেও সেই এক সমস্যা, প্রয়োজনের তুলনায় মাথাপিছু বরাদ্দ খুব কম। উপরন্তু পচা বা পোকা-ধরা চাল, নিম্নমানের ডাল ও প্রাপ্যের চাইতে কম পাওয়ার অভিযোগ ভূরি ভূরি। এর নেপথ্যে প্রধান কারণটি হল খাদ্যশস্য বণ্টনে সীমাহীন দুর্নীতি। তবে অপুষ্টি বা খাবারের অভাব যে এ দেশে শুধু শিশু, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, স্তন্যদাত্রী প্রসূতিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সেই সত্যটি ২০২৩-এর বিশ্ব ক্ষুধা সূচক বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জনসমক্ষে এসেছে: ১২৫টি দেশের মধ্যে ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবস্থান ১১১-তে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে এলেও, সমস্যা যে শুধু এ রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, রিপোর্টে সেই সত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে ভারত বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। গত বছর ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) আয়োজিত ‘লিডস-২০২২’ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, ভারত খাদ্য উৎপাদনে শুধু স্বয়ম্ভরই নয়, বিশ্বের এক বিরাট অংশের খাদ্যের চাহিদা মেটানোরও ক্ষমতা রাখে। এই দাবি সত্যি হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ক্ষুধা সূচকে ভারতের এই শোচনীয় অবস্থানের কারণ অনুসন্ধান এবং উন্নতির লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ।
কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, সে পথে না হেঁটে সম্প্রতি ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’র মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছর দেশের আশি কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। চার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের পাশাপাশি লোকসভা নির্বাচনও দুয়ারে, এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াকে বিরোধীরা ভোট কেনার কৌশল বলে কটাক্ষ করছেন বটে, তবে যে সব রাজ্যে বিরোধীরা ক্ষমতায়, সেখানেও ভোটমুখী দান-খয়রাতির ঘোষণা কিছু কম হয় না। আসলে সবাই জানেন, ক্ষুধার্ত মানুষ অতশত নিয়ে মাথা ঘামান না। হোক না জনসাধারণের করের টাকায় শাসকের নামাঙ্কিত বদান্যতা, পেট না ভরলেও মুফতে পাওয়ার কৃতজ্ঞতা বা বাধ্যবাধকতায় তাঁরা প্রশ্ন তুলতে সাহস করেন না— তাঁদের কতটুকু পাওয়ার কথা এবং কতটুকু পাচ্ছেন তা নিয়ে। নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা যে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ, এ সত্যও অনেকে ঠেকে শিখেছেন। যোগ্য প্রাপকের অসহায়তাকে কাজে লাগিয়ে আত্মসাৎ হচ্ছে গরিবের জন্য বরাদ্দের একটা মোটা অংশ। ফুলেফেঁপে উঠছে মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্বভোগী, বণ্টন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি স্তরের কুশীলব।
সরকারি প্রকল্পের সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রেও এই সার্বিক দুর্নীতি রোধে বণ্টন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, সর্বাত্মক নজরদারি এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোরতম পদক্ষেপ করা দরকার। খাদ্যই হোক কিংবা ভাতা বা অনুদান, প্রকৃত প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেওয়া নিশ্চিত না করতে পারলে গরিব কল্যাণের নামে নতুন নতুন প্রকল্প যে ক্ষুধার্ত মানুষের কোনও কাজে আসবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য নীতি-নির্ধারকরা এ নিয়ে কতটা আন্তরিক, সেই সন্দেহ থেকেই যায়।