প্র-দর্শন: কলকাতায় রেড রোডে বিসর্জনের কার্নিভাল, ৮ অক্টোবর। ছবি: সুমন বল্লভ।
ফেলিনির লা দলচে ভিতা-য়, ধনী তথা বিখ্যাত লোকেদের ছবি তুলে বেড়ানো পাপারাৎজ়ো’র থেকে যেমন ‘পাপারাৎজ়ি’ নামটা চালু হয়ে গিয়েছিল একদল ফোটোগ্রাফারের জন্য, বিগত কয়েক বছরে ‘থিম’ শব্দটা সে ভাবেই খাপে খাপ হয়ে গেল শহুরে বাঙালির দুর্গাপূজার সঙ্গে। জীবনধারণের জন্যই যেমন কখনও-সখনও পাপারাৎজ়ি হতে হয় আজকের ফোটোগ্রাফারকে, স্রেফ টিকে থাকার জন্যই ‘থিম’-এর ডালা নিয়ে ঘুরতে হয় অনেক পূজার আয়োজকদের। আর আগমনী থেকে বিজয়ায়, ‘থিম’ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, আমাদের যাবতীয় আবেগ। সফট ড্রিঙ্ক-এর বিজ্ঞাপনের ভিতর দিয়ে পূজা-প্রেমকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা দেখতে দেখতে আমরা হয়তো টের পাই না যে, ইদানীং ক্ষেত্রবিশেষে ‘প্রতিবাদ’ও একটি থিম। তাতে শামিল হওয়ার জন্য যাপনের উপর ঘূর্ণিঝড় টেনে আনতে হয় না, হাতে একটি স্মার্ট-ফোন লাগে কেবল।
মালবাজারে যে ভাবে দশ জন মানুষ হড়পা বানে ভেসে গেলেন তার পিছনের কারণ, প্রশাসন কিংবা মিডিয়া কেউই স্পষ্ট ভাবে দিতে পারল না। ‘প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা’ বললেন কেউ, কেউ বা বললেন ‘নদীর চর দখল করে দিনরাত বালি আর পাথর তোলার ফল’। কিন্তু একটি ছোট নদীর বিশেষ একটি জায়গায় একই সময়ে অনেক প্রতিমা বিসর্জন দিতে হবে কেন, তা নিয়ে কথা শোনা গেল না বেশি।
আবাহন অথবা বিসর্জন, প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তিগত বেদনার অনুভূতি। প্রতি বার বোধনের সময় মনে পড়ে, আগের বছর কারা কারা ছিল যারা এ বারে নেই। বিসর্জনের সময় প্রতিমা যখন ভেসে যান, তখন পলকের জন্য মনে হয়, পরের বার বিসর্জনের সময় আমি থাকব তো?
দোটানা আর সংশয়ের মধ্যে পাক খাওয়া ব্যক্তিহৃদয়কে সমষ্টির কোলাহলে নিয়ে গিয়ে ফেলা, একক অনুভূতির সঙ্গে আরও আরও একক অনুভূতিকে মুড়ে (জুড়ে নয়) এক বাক্সের ভিতর বন্দি করে যা তৈরি করা হয়, তাকেই বোধ হয় ‘স্পেক্টাকল’ বলে। ল্যাটিন ‘স্পেক্টাকুলাম’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি, যার মানে ‘পাবলিক শো’। এ-বার পাবলিক শো-এ পারফর্মার থাকবেই। মা দুর্গাকেও অবতীর্ণ হতে হয়েছে সেই পারফর্মারের ভূমিকায়; যে পূজা যত লোক টানবে সেই প্যান্ডেলের প্রতিমাকে তত বেশি সময় দেখানো হবে টিভির পর্দায়। এই নিয়ে কথা বলতে গেলেই শুনবেন, ‘খারাপটা কী হচ্ছে?’
চুপ করে থাকলেই যে শান্তি তা নয়, কারণ শান্তিরও তো ‘স্পেস’ চাই। ‘নয় সুইনহো লেন’, ‘পনেরো গড়িয়াহাট রোড’, এই রকম নাম দিয়ে যে হোটেলগুলো খুব চলছে এখন, সেগুলো আদতে তো কারও-না-কারও বাড়ি। এ-বার বাড়ির এক জন শরিক যদি হোটেল ব্যবসায় সম্মত না হয়ে চুপ করে দোতলার বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে থাকতে চান? কিছুতেই অ্যালাও করা হবে না তাঁকে কারণ হোটেলে কোনও বাসিন্দা থাকতে পারে না, নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে গেস্ট(পেয়িং) থাকতে পারে কেবল। চ্যানেল, বিজ্ঞাপনদাতা, দর্শনার্থীদের ত্রিফলায় আলোকিত পূজাগুলোও শেষ বিচারে কোনও না কোনও পাড়ারই। কিন্তু তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেকার পূজাতে আমরা শিবনাথকাকু কিংবা মীরাপিসিমাদের পেতাম; তাঁরা কারও সঙ্গে বিশেষ কথা না বলে দিনে ষোলো ঘণ্টা মাতৃমূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতেন একটা নড়বড়ে চেয়ারে বসে। সে রকম কেউ আজ আর নেই। মণ্ডপ টুরিস্টের দখলে চলে গেছে, অন্তরে পূজার প্রদীপটুকু জ্বালিয়ে রাখা কারও ঠাঁই নেই সেখানে।
উৎসব-প্রাধান্যের কারণে দেবী দুর্গার সঙ্গে সাধকদের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক সে ভাবে স্থাপিত হয়নি, শশিভূষণ দাশগুপ্ত-এর কলমে এমন পড়েছি আমরা। কিন্তু শশিভূষণের একটি তত প্রচার না পাওয়া বই নিরীক্ষা-য় ‘শিব-দর্শনে’ নামক প্রবন্ধে পাই বক্সা পাহাড়ের নিম্নদেশে লেখকের আশ্চর্য দেবী-দর্শনের বর্ণনা। শশিভূষণ লিখছেন, “ …হঠাৎ দেখিলাম, পাহাড়ের কোন ফাঁক দিয়া প্রভাত-সূর্যের খানিকটা আলো আসিয়া পড়িয়াছে সেই মাঠের উপরে। এইবার স্পষ্ট চিনিতে পারিলাম; যোগিবর ধ্যানস্থ মহাদেবের পাদদেশে মা পার্বতীর হাসি। …যাহাকে কাল ঝড়ের অন্ধকার সন্ধ্যায় ভৈরবী কালী মূর্তিতে দেখিয়াছিলাম, এই তো সেই মায়ের কাঞ্চন-বিভা! ...জীবধাত্রী অন্নপূর্ণা গৌরী। …নিত্য তাহার প্রকাশ, অন্নে ও প্রাণে!”
অল্প কয়েকটি শব্দে পরিষ্কার হয়ে যায় একটি অমোঘ সত্য, সাধনার চাইতে বেশি করে আরাধনার দেবী দুর্গা। সেই আরাধনা, কলাবৌকে স্নান করানোয়, ভোগের ফল বানানোয়, ধুনুচি-নাচে কিংবা ভাসান দিতে গিয়ে কাঠামোয় পা ঠেকে গেলে, প্রণামের জন্য এক বছর অপেক্ষা করার মধ্যেও। মহতী বীজ ভিতরে ধারণ করা প্রত্যেকটি ঘটনা নীরবে মুখর হয়ে জানিয়ে যায়, ক্ষুদ্র হলেও তুচ্ছ নয় কেউ। কিন্তু এখন ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’র মূল্য কোথায়? তাই অবলীলায় আমরা মেনে নিয়েছি এই নতুন আমদানি হওয়া ‘মহা’সংস্কৃতি। চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, সব এখন, ‘মহা-চতুর্থী’, ‘মহা-পঞ্চমী’, ‘মহা-ষষ্ঠী’, ‘মহা-সপ্তমী’ নামে খ্যাতি লাভ করেছে। অথচ যে পূজায়, স্নান, ষোলোটি নিবেদন, যজ্ঞ ও বলি থাকে না সেই পূজা ‘মহা’ হয় না। কিন্তু কেবলমাত্র ‘মহা-অষ্টমী’ এবং ‘মহা-নবমী’র স্বল্পতায়, মহল্লায়-মহল্লায় ‘দামোদর শেঠ’রা খুশি হবে কী করে? তারা যে অনুদানের সঙ্গে কিঞ্চিৎ অনুপানও মিশিয়েছে। বিগত কয়েক বছরে, চাকরি-জীবিকা-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অভাবনীয় কোনও উন্নতি না ঘটিয়ে রাষ্ট্র আচমকাই ‘মহা’ রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে প্রচারে-প্রচারে; তেমন ভাবেই ‘ব্যক্তি-রাষ্ট্র’ আমাদের মধ্যে গভীর সুপ্তিতে থাকা ‘মহা’ জেগে উঠেছে যেন বা। পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ির তলা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলেও তাঁদের ঘরে ডেকে এক গেলাস জল আর দুটো বাতাসা দেওয়ার ইচ্ছা হয় না, কিন্তু ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ নিয়ে কয়েক ছত্র কিংবা অনুচ্ছেদ নামিয়ে লাইক আর শেয়ার জুটিয়ে নিতে পারি দিব্যি! অলিতে-গলিতে এলাকার মহা-রূপকাররাও অপেক্ষা করেন বালি আর সিমেন্ট সমেত, কোথায় কোন বাড়ির আঙিনায় এখনও মাচা থেকে শিম কিংবা লাউ খিলখিলিয়ে হাসছে! নিয়ে এসো তাকে ‘মহা’ প্রমোটিং যজ্ঞের বৃহত্তর পরিসরে!
এই ‘খেলা’ হবে বলেই বোধ হয়, পৃথিবীতে কোনও ধর্মের, কোনও পূজা নিয়ে যা হয় না সেই ‘ছেলেখেলা’ আরম্ভ হয়েছে বাঙালির দুর্গাপূজা নিয়ে। ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা পেয়ে কি আরও দুটো হাত গজিয়েছে কলকাতার মা দুর্গার যে পিতৃপক্ষে পূজা শুরু হবে? তকমার জন্য পূজা করতেন আমাদের পূর্বপুরুষ আর পূর্বনারীরা?
এই প্রশ্নগুলো থাকছে। আর তার পরও এটা স্বীকার করতে কোনও বাধা নেই যে, ইউনেস্কোর ওই স্বীকৃতিকে হাইলাইট করার জন্য যদি কার্নিভাল হয় তবে তার কিছু প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। যখন খোদ আমেরিকায় শাড়ি-পরা চোদ্দো জন ভদ্রমহিলার উপর আক্রমণ হচ্ছে বলে খবরে দেখাচ্ছে, তখন কলকাতার দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে কোনও সেলিব্রেশন যদি বিশ্বের অল্প কিছু কর্তাব্যক্তির নজরও টানে, তবে কুমিল্লা কিংবা কানাডায় দুর্গাপূজা করা মানুষগুলো একটু নিরাপদ বোধ করতে পারেন।
প্রতিবাদও যখন ‘থিম’ তখন প্রতিবাদ ভাঙিয়ে যে রাজনীতিবিদের ভোট এবং উকিলের মক্কেল আসবে, তা বলা বাহুল্য। তাই বলে, ভাল-খারাপ বিচার করতে বসে ‘ভাল’টাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা কোনও পদ্ধতি হতে পারে না। কিন্তু খারাপের ভিতরে থাকলে ‘ভাল’কে আমরা গ্রহণ করবই বা কী করে? কলঘরের শেওলা পরিষ্কারের ঝাঁটা যে বালতিতে থাকে তাতে তো আর ভোগের খিচুড়ি ঢালা যায় না, তার জন্য অন্য বালতি লাগে। অতএব, রাজনৈতিক বিরোধীর উদ্যোগে যে পূজা হচ্ছে, মানুষের ভালবাসা পেলে, তারও জায়গা পাওয়া উচিত কার্নিভালে। যেমন উচিত গান্ধীজিকে অবমাননা করা ইতরদের, কিংবা ভিন্ন রাজনীতির বইয়ের স্টল আক্রমণ করা গুন্ডাদের হাজতে ঢোকানো।
দেবীমূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা যে কোনও সময়েই হতে পারে, তা টিভির পর্দায় বা সামনাসামনি দেখে আনন্দও পেতে পারেন অনেকে, তবে বিসর্জন হয়ে যাওয়া মায়ের গায়ে ফুল ছোড়া, কিংবা তার সামনে চামর দোলানো ঠিক নয়। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক বন্ধু বলছিলেন, ‘মায়ের প্ল্যানচেট হচ্ছে’। মা প্ল্যানচেটে আসেন না, তাঁর পুনরাগমন হয়। সেই পুনরাগমন যখন হবে, তখন হবে। আপাতত যারা পয়সা না পেলে পরে দুর্গাপূজার মণ্ডপেও যায় না সেই গ্ল্যামার-গ্লানিদের মঞ্চ থেকে নামিয়ে প্রায় ছ’শো দিন যে ছেলেমেয়েগুলো রাস্তায় বসে আছে তাদের এক বার মঞ্চে তুলে নেওয়া যেত না? বোধনের আনন্দ বিলোতে না পারলেও, এই দশমীতে বিসর্জনের বেদনা অন্তত তাঁদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া দরকার ছিল, যাঁরা সত্যিই বেদনার্ত!