পাশাপাশি: অষ্টাদশ শতকে তৈরি জ্ঞানবাপী মসজিদ, মন্দির পরিবৃত ভূমিতে, বারাণসী। ছবি: পিটিআই।
কয়েক দিন আগে, শ্রীরাম জন্মভূমি ট্রাস্টের কোষাধ্যক্ষ গোবিন্দদেব গিরি বলেছিলেন, আর দু’টি মন্দির পেলেই আর কোনও মসজিদ চাওয়া হবে না। এর একটি হল বারাণসীর জ্ঞানবাপী যা আদি বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে অষ্টাদশ শতকে তৈরি করা হয়েছিল বলে দাবি করা হচ্ছে। বর্তমানে এটি কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সংলগ্ন স্থানে রয়েছে। অপরটি মথুরার কৃষ্ণ জন্মস্থান চত্বর, যেখানে শাহি ইদগা রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও বলেছেন, হিন্দুদের মাত্র তিনটি পবিত্র স্থান ছাড়তে আপত্তি কোথায়?
এই দাবি মেনে নিলে কি মসজিদ সরানো শেষ হবে? কেউ বলতেই পারেন, উত্তরটা হল— না। কেন বলতে পারেন? একটু গভীরে যাওয়া যাক। সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ গবেষক শ্রীধর দামলে ১৯৮৭ সালে একটি বই লেখেন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে নিয়ে। আমেরিকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ওয়াল্টার অ্যান্ডারসনের সঙ্গে লেখা বই ব্রাদারহুড ইন স্যাফ্রন-এ বলেন: মথুরার কৃষ্ণ জন্মভূমি এবং বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ ছাড়াও “বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ২৫টি অন্যান্য মসজিদ ধর্মান্তরিত (কনভার্ট) করার জন্য চিহ্নিত করেছে।” অতএব এটি একটি প্রকল্প, থামবে না।
দ্বিতীয়ত, সুপ্রিম কোর্টের রামজন্মভূমি নিয়ে রায়ের (২০১৯) পরে আইনজীবী বিষ্ণুশঙ্কর জৈন এই লেখককে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বর্তমানে ভারতে “মোটামুটি ভাবে ৫০টি এমন মসজিদ ও নির্মাণ রয়েছে যার নীচে মন্দির আছে।” হিন্দু মহাসভার সমর্থক বিষ্ণুশঙ্কর এবং তাঁর পিতা আইনজীবী হরিশঙ্কর জৈন ধর্মীয় স্থানের চরিত্র পরিবর্তনের বেশ কয়েকটি দাবি নিয়ে আদালতে গিয়েছেন। তাঁরা রামজন্মভূমি মামলায় হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তাঁদের আবেদনের ভিত্তিতে সম্প্রতি ইলাহাবাদ হাই কোর্ট জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভেকে অনুসন্ধানের অনুমতি দেয়। এই গোত্রের মামলা আরও উঠবে বলে আশা করে বিষ্ণুশঙ্কর বলেছিলেন, আদালতের উচিত সংখ্যাগুরু সমাজের আবেগের মর্যাদা দেওয়া। “না হলে মানুষ আইন নিজের হাতে নেবেন কি না তা ভক্তরাই বলবেন, আমি নয়।”
হিন্দু পক্ষ কথাটা বলতে পারছেন সুপ্রিম কোর্টের রামজন্মভূমি রায়ের উপর ভিত্তি করে। রায়ের সংযোজন অংশের (অ্যাডেন্ডাম) ১১৬ পৃষ্ঠায় (অনুচ্ছেদ ১৭০) বলা হয়েছে, “মসজিদ নির্মাণের আগে এবং তার পরেও বাবরি মসজিদের জায়গাতেই প্রভু রামের জন্মস্থান ছিল বলে বরাবরই হিন্দুরা বিশ্বাস করতেন।” অর্থাৎ, বিশ্বাসকে সিদ্ধান্তের অন্যতম ভিত্তি হিসাবে উপস্থাপিত করেছে সর্বোচ্চ আদালত। এই রায়ের ফলে এখন বলা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে আদালত সংখ্যাগুরুর বিশ্বাসের মর্যাদা না দিলে, তাঁরা আইন ‘হাতে তুলে নিতে পারেন’।
প্রসঙ্গত, এখানে এক বাঙালি ইতিহাসবিদের ভূমিকা বেশ বড় মাপের। মসজিদের নীচে মন্দির থাকার আইনি যুক্তি যাঁর গবেষণার উপরে অনেকটাই দাঁড়িয়ে, তিনি হলেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার। বিষ্ণুশঙ্কর জৈন বলেছিলেন, তিনি স্যর যদুনাথকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। মথুরার শাহি ইদগা মামলার আবেদনপত্রে জৈনরা উদ্ধৃতি দিয়েছেন যদুনাথের লেখা থেকে। আগরার জামা মসজিদ খুঁড়ে দেখার আবেদনেও উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে তাঁর বই থেকে। ঔরঙ্গজেবের শাসন নিয়ে লেখা বই মাসির-ই-আলমগিরি (১৬৫৮-১৭০৭) তাঁর মৃত্যুর বছরে (১৭০৭) প্রকাশ করেন জীবনীকার সাকি মুস্তাদ খান। ফারসিতে লেখা বইটি গত শতকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন যদুনাথ।
তিনি লিখছেন, ১৬৭০-এর গ্রীষ্মে ঔরঙ্গজেব “মথুরায় কেশব রাই-এর মন্দির ভাঙার নির্দেশ দেন।” ওই অনুবাদের ভিত্তিতে হিন্দুপক্ষ দাবি করেছেন অযোধ্যায় যেমন বাবরের মসজিদ রামের জন্মস্থান, তেমনই মথুরায় ঔরঙ্গজেবের শাহি ইদগা কৃষ্ণের জন্মস্থান। এই আবেদনের জেরে এএসআই জানুয়ারিতে জানিয়েছে শাহি ইদগার নীচে ‘হিন্দু মন্দির ছিল’, যেমন ২০০৩ সালের ৫ মার্চ এএসআই জানিয়েছিল যে, বাবরি মসজিদের নীচে একটি দ্বাদশ শতকের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
যদুনাথের আরও একটি বই অ্যানেকডোটস অব ঔরঙ্গজ়িব অ্যান্ড হিস্টরিক্যাল এসেজ় (১৯১৭) থেকে উদ্ধৃত করে মসজিদ সরানোর দাবি বিভিন্ন আদালতে উঠেছে, যদিও বইয়ের নামেই আছে ‘অ্যানেকডোটস’ শব্দটি, যার অর্থ প্রচলিত গল্পগাথা। এই বইয়ে কাশী বিশ্বনাথ, কৃষ্ণ জন্মস্থান অর্থাৎ শাহি ইদগা এবং জাহানারা মসজিদের কথা যদুনাথ লিখছেন। “১৬৬৯-র সেপ্টেম্বরে বিশ্বনাথ মন্দির ভাঙা হল। মথুরার সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণ কেশব রাই মন্দির ৩৩ লাখ টাকা খরচ করে তৈরি করেছিলেন বুন্দেলার রাজা বীরসিংহ দেব। সেটিকে ১৬৭০-এ ধ্বংস করে মসজিদ বানানো হল। মূর্তিগুলিকে আগরায় নিয়ে গিয়ে জাহানারা মসজিদের সিঁড়িতে পোঁতা হল।” যদুনাথ হিন্দু মহাসভার সঙ্গেও এক সময় যুক্ত ছিলেন, সে কারণে তাঁর কাজ নিয়ে কংগ্রেস বা বামপন্থীরা বিশেষ উৎসাহ দেখাননি।
তবে তিনি যে ‘পরিশ্রমী’ গবেষক, স্বীকার করেন ইতিহাসবিদরা। অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর ২০১৫ সালের বই দ্য কলিং অব হিস্ট্রি: স্যর যদুনাথ সরকার অ্যান্ড হিজ় এম্পায়ার অব ট্রুথ-এ যদুনাথের মূল্যায়নে বলেছেন, ইতিহাস রচনায় তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করার ক্ষেত্রে যে মেধা, মনন ও পরিশ্রমের উদাহরণ যদুনাথ রেখেছিলেন তা স্মরণযোগ্য। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “সরকার লিখেছেন, প্রমাণ সংগ্রহ এবং যাচাই ছিল ‘কঠোর পরিশ্রম’-এর কাজ... ‘কঠোর পরিশ্রম’-এর আদর্শ... গবেষণার নতুন ধারণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।” যদুনাথের গবেষণার একটা দিক যেমন দেখাচ্ছে হিন্দু ধর্মীয় স্থানের উপরে মসজিদ নির্মাণের গল্পকাহিনি, তেমনই আবার অন্য দিকও রয়েছে, যার কথা ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলছেন দীপেশ চক্রবর্তী।
“...হিন্দুত্ববাদীদের দাবি খুবই অবাস্তব। আপনি যদি বলেন আমরা বিমান আবিষ্কার করেছি বা মহাভারতে পরমাণু বোমার কথা বলা হয়েছিল তবে তা সত্য নয়... হিন্দু গৌরবের জন্য আপনি যা-ই দাবি করুন না কেন, তা যাচাই যোগ্য সত্য হওয়া প্রয়োজন। সেই কারণেই যদুনাথ সরকার আবারও ফিরে আসছেন।” সাক্ষাৎকারে দীপেশ চক্রবর্তী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, “তাদের রাজা শিবাজির উপরে লেখা বই পড়ে মারাঠারা যদুনাথকে মুসলিমদের প্রতি অনুরক্ত এক ইতিহাসবিদ মনে করতেন। আবার মুসলমানেরা মনে করেন তিনি এক জন হিন্দুবাদী ইতিহাসবিদ।” সামগ্রিক ভাবে যদুনাথের মূল্যায়ন সীমিত। লক্ষণীয়, বর্তমানেও যদুনাথের রচনা অংশত ব্যবহৃত হচ্ছে মামলায়।
এ সব তো গেল ‘অ্যাকাডেমিক’ চর্চা। ওই যে ‘হিন্দুদের বিশ্বাসের’ কথা উঠেছে, তার আবেগকে স্তিমিত করার শক্তি আইনের নেই বলেই মনে হয়। তা ছাড়া এও ঠিক যে, বিভিন্ন সরকারি সংস্থা আইনি নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই এখন ধর্মীয় স্থান ভেঙে ফেলতে পারে।
যেমন জানুয়ারিতে দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ডিডিএ) দক্ষিণ দিল্লির মেহেরৌলিতে একটি মসজিদ এবং মাদ্রাসা ভেঙে দেয় কাঠামো ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে৷ ডিডিএ-র সিদ্ধান্ত অবাক করে
দিল্লি হাই কোর্টকে। আদালত জানতে চায়, কী ভাবে ৬০০ বছরের একটি নির্মাণ ‘অবৈধ’ হতে পারে। অবাক হওয়া যেতেই পারে, তবে এ কোনও ব্যতিক্রম নয়।
তবে কিনা, নির্দ্বিধায় ইসলামি ধর্মীয় স্থান ‘কনভার্ট’ করা এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১৯৯১ সালের ধর্মীয় স্থানের চরিত্র পরিবর্তন বিরোধী আইন। এই আইনের ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট “বিদ্যমান উপাসনালয়ের ধর্মীয় চরিত্র যা ছিল সে ভাবেই থাকবে।” এই আইন চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, পশ্চিমবঙ্গেও একাধিক বিতর্কিত মসজিদ রয়েছে, যেখানে নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হচ্ছে।
স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আইনে দু’চারটি শব্দ এ দিক-ও দিক করলেই অবশ্য রক্ষী মোতায়েনের প্রয়োজন ফুরোবে। আদালত বা স্যর যদুনাথের শরণাপন্ন হওয়ারও আর দরকার পড়বে না।