ধরুন, আপনি কপালে হাত দিয়ে দেখলেন গা গরম, কিন্তু থার্মোমিটার দেখাল জ্বর নেই। আপনি নিজের হাতটিকে বিশ্বাস করবেন, না তাপমাপক যন্ত্রকে!
দেশে মেয়েদের বর্তমান অবস্থা ঠাহর করতে গেলেও এই বিহ্বলতারই সৃষ্টি হয়। মহিলাদের উপর নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ দেখি আমরা। অথচ লিঙ্গবৈষম্য পরিমাপক দণ্ডগুলির হিসেব বলে, দেশের মেয়েদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে দিব্য উন্নতি হয়েছে।
স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে জানানো হয় যে, গত দশকগুলিতে দেশে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার ও মহিলাপ্রতি সন্তান উৎপাদন হার কমেছে। নারীস্বাস্থ্য পরিমাপে দু’টি বিষয়ই জরুরি, আন্তর্জাতিক মান্যতাপ্রাপ্ত লিঙ্গবৈষম্য মাপকসূচির অংশ। কিন্তু দেশের নারীস্বাস্থ্য উন্নয়ন প্রসঙ্গে শুধু এই দু’টি মাপকাঠিকেই ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখালে বিভ্রান্তিকর, অসম্পূর্ণ তথ্য পেশ করা হয়। স্বাস্থ্যের পরিধি বিরাট ও বহুমুখী। সেটি পরিমাপের সময় মনে রাখা দরকার, ভারতের মহিলাদের প্রতি দু’জনে এক জন রক্তাল্পতার, তিন জনে এক জন মানসিক অবসাদের শিকার। চার জনে এক জন অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছেন, পাঁচ জনে এক জনের ওজন যথাযথ মাত্রার তুলনায় কম। মহিলাদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ছায়াও স্বাস্থ্যে পড়ে। শুধুমাত্র মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার ও গড় সন্তান উৎপাদন হারের মাপকাঠিতে বিচার হয় কি? এতে মনে হয়, ভারতে নারীস্বাস্থ্য বলতে শুধু মায়েদের স্বাস্থ্যকেই বোঝায়। দেশের প্রায় ১৬% নিঃসন্তান বিবাহিত মহিলা এবং অবিবাহিতাদের গুরুভাগই রাষ্ট্রের নারীস্বাস্থ্যের প্রতিভূ নন।
মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়েছে, এই হিসেবের মাপদণ্ড প্রতি দশক অন্তর বিদ্যালয়ে ছাত্রী-সংখ্যা বৃদ্ধির হার ও ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সি মেয়েদের সাক্ষরতা বৃদ্ধির হার। অথচ স্কুলের খাতায় নাম লেখালেই যেমন শিক্ষিত হওয়া যায় না, তেমন নাম সই করতে জানলেই সাক্ষর হওয়া যায় না। ফলে শিক্ষার এই লক্ষ্যভিত্তিক মাপদণ্ডের নীচে চাপা থাকে আসল সত্য। তা হল, দেশের ১৫-১৮ বছরের ৪০% মেয়েই স্কুলের খাতায় নাম লিখিয়েও আদৌ স্কুলে যায় না। ছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করতে ‘মিড-ডে মিল’ রয়েছে। কিন্তু স্কুলে না গিয়ে খেতে খাটলে বা উপার্জনশীল বাবা-দাদাদের রেঁধে দিলে সারা দিনের ‘মিল’-এর সংস্থান হয়। স্কুলের খাতায় কেবল নামটুকু তোলা থাকলেও অনেকগুলি সুবিধে। রাজ্যভিত্তিক ছাত্রী-উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়, করোনার মতো পরিস্থিতিতে বাড়িতে বসেই মাসে মাসে চাল, ডাল, সয়াবিন ইত্যাদি মেলে। পরিবারের সকলেরই কাজে লাগে। উদ্বৃত্ত অংশ বিক্রিও হয়।
নারীর ক্ষমতায়নের পরিমাপক হল প্রধানমন্ত্রী পদে, সংসদে বা অনুরূপ রাজনৈতিক পদে মেয়েদের সংখ্যা। তবে, আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত এই মাপকাঠির উপাদান ও গঠনের উদ্দেশ্যও জানা জরুরি। এ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ছিল, দেশগুলি কেন্দ্রীয় নীতির মাধ্যমে পারিবারিক ক্ষেত্র থেকে আর্থিক, সামাজিক সকল ক্ষেত্রে মেয়েদের স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়াবে। তারই প্রতিফলন থাকবে রাজনীতিতে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। অর্থাৎ নারী ক্ষমতায়নের মূল উদ্দেশ্য হবে তাঁদের সার্বিক সিদ্ধান্ত-গ্রহণ ক্ষমতার বৃদ্ধি। এই পদ্ধতির উপজাত ফল মেয়েদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। সহজেই গোনা যায় বলে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সংখ্যার মাধ্যমেই দেশে মহিলাদের সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের উন্নতি তথা ক্ষমতায়নের হিসেব হওয়ার কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে হল ঠিক উল্টো। গোঁজামিলের অঙ্ক মেলানোর মতোই, এ ক্ষেত্রেও শেষ থেকে শুরু করা হল। প্রথমেই, মেয়েদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ‘সংখ্যা’ বাড়ানোটুকুই লক্ষ্যমাত্রা হল। লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের মাধ্যমে লক্ষ্যটি পূরণও হল। স্কুলে নামটুকু লেখানোর মতোই, দেশের বেশ কিছু মহিলার নামটুকুই রাজনৈতিক দলিলে নথিভুক্ত হল। পদগুলির প্রকৃত পরিচালক হলেন স্বামীরা। অনুন্নত অঞ্চলগুলিতে, এমনকি শহরেও এই নিদর্শন বহু। এই পদ্ধতিতে নারী ক্ষমতায়নের মূল উপজীব্যগুলি, অর্থাৎ নানা স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি, উপার্জন, ব্যয়, বিনিয়োগ ইত্যাদিতে স্বনির্ভরশীলতার মতো ক্ষেত্রগুলি অধরাই থাকল। অথচ, পরিমাপক যন্ত্রের ফলাফলে মেয়েদের ক্ষমতায়নের অগ্রগতি হল!
একটু চেষ্টা করলে, নারী উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরগুলিকে লক্ষ্যবিন্দু করলে, নারীস্বাস্থ্য উন্নয়নের প্রত্যেকটি আঙ্গিকই এই আলোচনার অংশ হত। খিচুড়ির লোভ ছাড়াই ছাত্রীরা বিদ্যালয়মুখী হত, সংরক্ষণের বেড়াজাল ছাড়াই মেয়েদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রস্ফুটিত হত। সে চেষ্টা হয়নি। নারী উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলিকেই এমন ভাবে স্থির করা হচ্ছে, যাতে পরিমাপের উদ্দেশ্য আর উপাদানই গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি চাপা পড়ছে। আমরাও সূচক দেখে বাস্তব ভুলে থাকছি।
বিষয়টা কপালে হাত ঠেকিয়ে জ্বর আছে দেখার পরেও, ভুল থার্মোমিটারে ৯৮ জ্বর মেপে সুস্থ থাকার ভান করার মতো। এর দীর্ঘকালীন পরিণতি ভয়ানক।