গৌরব গগৈ। —ফাইল চিত্র।
হেরেও যে জিতে যায়, তাকেই নাকি বাজিগর বলে! নির্বাচন কমিশনের হিসাব দেখাচ্ছে, অসমে ন’টি আসনে জয়ী বিজেপি যেখানে ৩৭.৪৩% ভোট পেয়েছে, সেখানেই তিনটি আসনে জেতা কংগ্রেস পেয়েছে ৩৭.৪৮% ভোট। উজানি অসমের ভোটযুদ্ধে আপাতত সেই বাজিগরের নাম গৌরব গগৈ। অসমে কংগ্রেসের পতনের মূল কারণ হিসেবে এক সময় যে যুবককে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আজ তাঁর হাত ধরেই দলের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
বাবা তরুণ গগৈ ২০০১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত টানা তিন দফা অসমের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর হাত ধরে গৌরব যখন রাজ্য রাজনীতিতে এসেছিলেন, তখন তিনি অহমিয়া ভাষা বলতে হোঁচট খান, আরও বেশি হোঁচট খান রাজ্যের গ্রামাঞ্চলের রকমসকম বুঝতে। তাঁর স্ত্রী ব্রিটিশ। সব মিলিয়ে তাঁর দেশোয়ালিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল দলেই। ২০১৪ সালে কাকা দীপ গগৈয়ের ছেড়ে দেওয়া কলিয়াবরে গৌরবকে সাংসদ করতে তেমন বেগ পায়নি গগৈ পরিবার। কিন্তু, নিজের ‘ডান হাত’ হিমন্তবিশ্ব শর্মার বদলে তরুণ গগৈ ছেলেকেই উত্তরসূরি বানাতে চাইছেন, আঁচ করে বিদ্রোহী হন হিমন্ত। কংগ্রেস ছাড়েন তিনি, সঙ্গে টানেন একের পর এক অনুগামী বিধায়ককেও।
গৌরব দু’বার কলিয়াবরে জিতলেও মূূলত হিমন্তবিশ্ব শর্মার দৌলতে ২০১৬ সালে রাজ্যে তিন দফার কংগ্রেস শাসন শেষ করে জয়ী হয় বিজেপি। ২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত হিমন্ত নাগাড়ে নেতা-বিধায়কদের বে‘হাত’ করে বিজেপিতে টেনেছেন। সেই শত্রুতার উৎস হিসেবে গৌরবকে চিহ্নিত করে, প্রদেশ কংগ্রেসের ভগ্নদশার জন্য তাঁকেই দায়ী করা হচ্ছিল। তাই ২০২৪ সালের ভোটে গৌরবকে ঘরে-বাইরের দ্বৈত চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যুঝতে হয়েছে। এবং এই প্রথম তাঁকে লড়তে হল বটবৃক্ষের ছত্রছায়া ছাড়াই— ২০২০ সালে প্রয়াত হয়েছেন তরুণ গগৈ।
যোরহাটে কার্যত পূর্ণ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ে তাঁর ১,৪৪,৩৯৩ ভোটের জয়ের মধ্যে ‘হিমন্ত অ্যান্ড কোম্পানি’কে হারানোর গৌরবই বেশি দেখছেন জুনিয়র গগৈ। ভোটের আগেই সীমানা পুনর্বিন্যাসের ফলে কলিয়াবর কেন্দ্রটি বিলুপ্ত হয়, ফলে সেখানকার সংখ্যালঘু ভোটও হাতছাড়া হল গৌরবের। তিনি নগাঁওতে লড়বেন না যোরহাটে, সেই দ্বন্দ্বে জেরবার কংগ্রেস ভোটের মাত্র মাসখানেক আগে গৌরবের জন্য দ্বিতীয় কেন্দ্রটি বেছে নেয়। যোরহাট তাঁদের আদি বাড়ি হলেও নতুন কেন্দ্র। সেখানে প্রস্তুতির সময়ই পাননি গৌরব।
অবশ্য রাজনীতিতে অনভিজ্ঞতা, স্থানীয় সমাজের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা, অসমিয়া ভাষণের দুর্বলতাকে কাটিয়ে গৌরব এত দিনে নিজেকে নতুন রূপে সামনে এনেছেন। সংসদে দলের ডেপুটি লিডার গৌরব মণিপুর, রামমন্দির, আলফায় যোগদান, সিএএ, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে ভাষণে দাগ কেটেছেন। সংসদে ৭৮টি বিতর্কে যোগ দিয়েছেন, সভায় তাঁর উপস্থিতির হার ৭৬%। দিন কাটিয়েছেন অসমিয়া সমাজে। অসমিয়া ভাষায় রীতিমতো চোস্ত এখন। এবং, বাবার পথেই হেঁটে পরিবারকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছেন। মা ডলি গগৈকে যেমন কখনওই রাজনৈতিক পরিসরে দেখা যায়নি, গৌরবও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের পারতপক্ষে জনসমক্ষে আনেননি।
তাঁর বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বড় অভিযোগ নেই; নামে-বেনামে সম্পত্তি, ব্যবসা, চা বাগান, বা জমিও নেই। এই না-থাকাই রাজনীতিতে গৌরবের সবচেয়ে বড় ইউএসপি। তাই হিমন্ত ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অজস্র দুর্নীতির অভিযোগকে অস্ত্র করতে পেরেছেন তিনি। অসমে ইন্ডিয়া জোট সফল না হলেও বিরোধী জোটের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করে সব প্রচারে সঙ্গে রেখেছেন গগৈ। এই জয়ে অন্তঃকলহ ও দলত্যাগে জর্জরিত কংগ্রেসকে পাল্টা লড়াইয়ের অক্সিজেন জোগানোর পাশাপাশি গৌরব এই বিশ্বাসটিও প্রতিষ্ঠা করলেন যে, বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হলে বিজেপিকে হারানো সম্ভব।
যুব ভোট টানতে গৌরব তাঁদের ভাষা, তাঁদের মাধ্যম বেছে নিয়েছিলেন প্রচারে। ইউটিউবার, ভ্লগার, আরজে-দের সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ইনস্টাগ্রামে চালিয়েছেন নতুন স্বাদের প্রচার। আবার পুরনো মানুষরাও বলছিলেন, হেম বরুয়া, দীনেশ গোস্বামীর পরে জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অসমের কণ্ঠ হয়ে উঠতে পারা, সুবক্তা নেতা অনেক দিন পরে এসেছেন। উল্টো দিকে, গত পাঁচ বছরে বিজেপির সাংসদ তপন গগৈয়ের নীরবতা তাঁকে বিস্মৃতপ্রায় করে তুলেছিল। অবশ্য যোরহাটে তপন ছিলেন নিমিত্তমাত্র— আসলে লড়ছিলেন হিমন্ত। বিরোধী জোটের দাবি, প্রাক্তন রাজনৈতিক গুরুর সন্তানকে হারাতে শুধু একটি কেন্দ্রেই খরচ করা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা! আনা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। উদ্বোধন হয়েছে আহোম সেনাপতি লাচিত বরফুকনের বিরাট মূর্তি। কিন্তু যোরহাটে হিমন্ত-ব্রিগেড যখন গৌরবকে হারাতে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, তখনই গগৈ বনাম গগৈয়ের যুদ্ধে গৌরব আহোম সমাজের নেতাদের সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন। দিনের পর দিন প্রচার চালিয়ে চা বাগানে কংগ্রেসের হারানো জমিও পুনরুদ্ধার করেছেন।
গৌরব আপাতত কর্মীদের সতর্ক করে বলছেন, ‘উৎসব নয়, এখন আসল লড়াইয়ের সময় এসেছে’। বলছেন, “রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী জনমত বাড়ছে ও অন্য দিকে ইউডিএফকে শূন্য হাতে ফিরিয়েছেন সংখ্যালঘুরা— সব মিলিয়ে অসমে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিন শেষ হতে চলেছে। লোকসভা ছিল সেমিফাইনাল। আমাদের লক্ষ্য ২০২৬।”