—ফাইল চিত্র।
কেবল অভয়ারণ্য নয়, এ বার তৈরি হচ্ছে ‘অভয় পুকুর’, বাংলার ছোট মাছদের বাঁচিয়ে রাখতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবেশ দফতরের অধীনে থাকা জীববৈচিত্র পর্ষদ মাছেদের অভয়াশ্রম নির্মাণের কাজটি শুরু করেছে রাজ্য জুড়ে। নদিয়ার কৃষ্ণনগর ১ নম্বর ব্লকে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। লক্ষ্য, প্রতিটি ব্লকে একটি করে পুকুর তৈরি। উদ্দেশ্য, নদী ও পুকুরে বাঁচতে পারে এই রকম হারিয়ে যাওয়া মাছ— যেমন পুঁটি, ফলুই, বাঁশপাতি, চিকলা প্রভৃতি পুকুরে সংরক্ষণ করা। ওই সব পুকুরে মাছ চাষ করবেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা। তাঁরা স্থানীয় মৎস্যজীবীদের মাছের চারা বিক্রিও করতে পারবেন। তা থেকে লাভের তিন ভাগের এক ভাগ পাবে পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় জীববৈচিত্র রক্ষণাবেক্ষণ কমিটি, বাকিটা পাবেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা।
বাণিজ্যিক ভাবে ছোট মাছ লাভজনক ব্যবসা দিতে পারে না, এমন ধারণা প্রচার করা হয়েছিল, ‘কার্প’ অর্থাৎ রুই-কাতলা জাতীয় মাছের বাণিজ্যিক উৎপাদন যখন শুরু হয়, তখন থেকে। কারণ, কার্প চাষ করার সময় পুকুরগুলোতে ছোট মাছকে মেরে ফেলা হত। ছোট মাছকে বলা হত ‘উইড ফিশ’ বা ‘আমাছ’। অথচ, বহু প্রজন্ম ধরে মৎস্যজীবীরা ছোট মাছদের বলতেন ‘রানি মাছ’। কারণ, ছোট মাছগুলো জল যেমন ভাল রাখে, তেমন ছোট মাছ যেখানে থাকে, সেখানে বড় মাছেদেরও ভিড় হয়।
মাছ চাষের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী, নালা, জলাভূমি থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল ছোট মাছ। আগে দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলোতে তেলটুপি, পাথরকাটা, ক্যাচকেচি, মেদি, ক্যাকচেরা, ধানিয়া, ডানকিনা, খড়কুটি, চিকরা, চাদা, কাজলি, চ্যাং-এর মতো প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন এগুলো একেবারেই পাওয়া যায় না। প্রায় চৌষট্টি রকমের মাছ বাজার থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বলছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি তথ্য। তিস্তার বোরোলি মাছ, আত্রেয়ীর রাইখর উত্তরবঙ্গে এখন প্রায় বিরল।
এর প্রধান কারণ নদীর জলের দূষণ, এ বিষয়ে একমত বিশেষজ্ঞরা এবং মৎস্যজীবীরাও। এ ছাড়াও নদীতে মশারি জালের ব্যবহার, নদীর বুক অবৈধ ভাবে আটকে রেখে মাছের চলাচলের পথ নষ্ট করা, নদীর জলে বিষ মিশিয়ে, কার্বাইড ফেলে মাছ ধরা, আবার উত্তরবঙ্গের নদীতে জলের ভিতর ব্যাটারির ইলেকট্রিক শক দিয়ে মাছ ধরা— এ সবের কারণে ছোট মাছের সংখ্যা হুহু করে কমছে। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার ভারত সরকারের প্রকাশিত ‘হ্যান্ডবুক অব ফিশারিজ় স্ট্যাটিস্টিক্স’ (২০২০) থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৫-১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে মাছের উৎপাদন ছিল ১৪.৯৩ লক্ষ টন। আর ২০১৯-২০ সালে উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ১৬.১৯ লক্ষ টন। কিন্তু এই বৃদ্ধির প্রায় সবটাই ঘটেছে পুকুরে চাষ-করা বড় মাছের জন্য।
বাঘ বা হাতির সংখ্যার বাড়ল না কমল, তা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। কিন্তু জলের প্রাণীর মরা-বাঁচা সম্পর্কে খবর আমরা কম রাখি। গঙ্গায় শুশুকের সমীক্ষা বিভিন্ন রাজ্য নিজেদের মতো করে করেছে। তবে সারা দেশ জুড়ে শুশুকের সমীক্ষার কাজ কেবলমাত্র গত বছর শেষ হয়েছে। কাজটি হয়েছে ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া, দেহরাদূনের অধীনে। তবে রিপোর্ট এখনও প্রকাশ হয়নি। নদীর ছোট মাছ শুশুকের খাদ্য। যেখানে ছোট মাছের অভাব, সেখানে শুশুক থাকতে পারে না।
ছোট মাছের পরিস্থিতি কী, তা আমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি বাজার থেকে। ছোট মাছ বাজারে কম এলে, দাম বেশি হলে আমরা বুঝতে পারি, মাছের উৎপাদন কমছে। অথচ, মাছও বাস্তুতন্ত্রের একটা বড় অঙ্গ। অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রকে নিয়ে আমরা যতটা ওয়াকিবহাল, জলের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি নিয়ে ততটা কি?
স্বাধীনতা সংগ্রামী পান্নালাল দাশগুপ্ত তাঁর অনুগামীদের বুঝিয়েছিলেন, জলের ফসল মাছ। তাই জল ভাল রাখতে নদীতে মাছ ছাড়তে হবে। এই দর্শনকে সামনে রেখে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে শুরু করেছিলেন ‘মীন মঙ্গল উৎসব’। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে মৎস্য দফতর এই ধারণাটি নিয়ে, পয়লা আষাঢ় দিনটিকে ‘জলাভূমি দিবস’ চিহ্নিত করে, বিভিন্ন নদী ও জলাভূমিতে মাছ ছাড়ত। এখন সেই উদ্যাপনের গরিমা কমেছে। তবে বেসরকারি ভাবে বর্ধমান জেলাতে ‘খালবিল চুনোমাছ’ উৎসব পালন করা হয় প্রায় এক দশক ধরে।
কৃত্রিম ভাবে ছোট মাছ উৎপাদনের চেষ্টা হয়েছে। ২০১৭ সালে রাজ্যের মৎস্য দফতর মুর্শিদাবাদে ডালগাঙ্গির বিলে, নদিয়ার মদনপুরে বৈশর বিলে, মালদহের হরিশচন্দ্রপুরের কাপাইচণ্ডী বিলে ছোট মাছের চাষ শুরু করে। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়— চলে রুই, কাতলা, মৃগেল, পাবদা মাছের চাষ। কাঁচরাপাড়ার মথুরা বিলেই শুধুমাত্র ছোট মাছের চাষ হত। বাজারের চাহিদার সামনে ছোট মাছের অল্প উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। কাজেই ছোট মাছকে বাঁচাতে গেলে দরকার ছোট মাছ চাষে সাধারণ মৎস্যজীবীদের আরও উৎসাহিত করা, জলাভূমিগুলো সংস্কার করে তাদের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনা। ছোট মাছ চাষে সরকারি অনুদান দেওয়া। ছোট মাছের গণনা করে বর্তমান পরিস্থিতি বুঝে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা দরকার। তবেই বাঁচানো যাবে ছোট মাছের বংশধরদের।