—ফাইল চিত্র।
আবারও দূষণ নিয়ে বিচলিত হওয়ার বাৎসরিক সময়টি এসে গিয়েছে। এ বছরও এই কাহিনির খলনায়ক সাব্যস্ত হয়েছে খেতেই ফসলের গোড়া পুড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাস। তথ্য অবশ্য অন্য কথা বলে। বায়ুদূষণের মাত্র ১৫-২০% ফসল পোড়ানোর ফল। গাড়ি থেকে আসে দূষণের ২৫-৩০%— শুধু দিল্লিতেই গাড়ির সংখ্যা ১.২ কোটি। এর উপরে রয়েছে নির্মাণ শিল্পের অবদান— প্রায় ৩০%— যার বেশির ভাগটাই আসে নির্মীয়মাণ বা অসমাপ্ত নির্মাণ থেকে, যেমন বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, সেতু, মেট্রোরেল ইত্যাদি নানাবিধ পরিকাঠামো। আছে দেওয়ালির বাজি পোড়ানো। রয়েছে শহরের বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়া। এবং, কার্যত সব দূষণের পিছনেই আছে প্রশাসনের ব্যর্থতা— ক্ষেত্রবিশেষে তার চরিত্র আলাদা, কিন্তু মূল কারণ অভিন্ন।
চাষিদের ফসলের গোড়া পোড়ানোর প্রয়োজন হয় কেন? ফসল কাটার পর বাকি গাছের গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে হয় পরবর্তী বীজ বপনের জন্য। তার জন্য যে যন্ত্রের প্রয়োজন, তা শুধু অত্যন্ত দামি তা-ই নয়, ছোট খেতে তা চলেও না। পঞ্জাব আর হরিয়ানার সরকার কয়েক বছর আগে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, রাজ্যের সব কৃষককে এই যন্ত্র বিনামূল্যে বা ন্যূনতম ভাড়ায় সরবরাহ করা হবে। প্রচুর অর্থব্যয়ে কিছু যন্ত্র কেনাও হয়, কিন্তু কৃষকদের সিংহভাগই তার নাগাল পাননি। এই দুই রাজ্যে আবার সেচের জলের উপরে নিষেধাজ্ঞা আছে— বর্ষা শেষ হলে তবেই চাষিরা সেচের জল তুলতে পারবেন, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের পর; এবং, জল তোলা যাবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এর ফলে দুই ফসলের মধ্যে ব্যবধান কমেছে; তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় ফসল না লাগালে তা আর জল পাবে না। এ দিকে, সব উচ্চফলনশীল ফসলেই প্রচুর পরিমাণে জল লাগে, যা পারম্পরিক ফসলে লাগত না। ফলে, মাঠেই ফসলের গোড়া পুড়িয়ে দেওয়া ছাড়া চাষিদের উপায় নেই।
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা, কেন্দ্রীয় সরকার আর রাজ্য প্রশাসনগুলি দূষণ রোধে তুঘলকি ব্যবস্থার পক্ষপাতী। দুটো উদাহরণ: দিল্লিতে তৈরি হচ্ছে বিশালায়তন বায়ু পরিশোধক গম্বুজ, যেগুলির ক্ষমতার পরিধি বড় জোর এক কিলোমিটার। যন্ত্রগুলি খুব ভাল কাজ করলেও তাদের কার্যক্ষমতার পরিধিতে থাকা মোট দূষণের ২৫-৩০% কমাতে পারে। প্রতিটি গম্বুজ নির্মাণে খরচ প্রায় ২৫ কোটি, এর পরে আছে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ। প্রায় ১,৫০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত দিল্লিকে দূষণমুক্ত করতে লাগবে আড়াই হাজারের বেশি গম্বুজ। এ দিকে বেশ কিছু পরিশোধক যন্ত্র ইতিমধ্যেই খারাপ হয়ে গিয়েছে, এবং তা আর সারানো যাচ্ছে না। দ্বিতীয় উদাহরণটি হল, বিশাল বিশাল গাড়িতে সারা শহরে জল ছেটানো হচ্ছে। দিল্লিতে এই পদ্ধতি হাস্যকর ও মারাত্মক। বিশালাকৃতি গাড়িগুলি প্রভূত যানজট সৃষ্টি করে, যার অবশ্যম্ভাবী ফল দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ধোঁয়া। আর বায়বীয় ধুলো ভিজে মাটিতে এসে খানিক ক্ষণ বাতাসকে আপেক্ষিক ভাবে দূষণমুক্ত করে বটে, কিন্তু মাটি শুকিয়ে গেলেই— যা দিল্লির মতো শুষ্ক আবহাওয়ায় খুব তাড়াতাড়িই হয়— ধূলিকণা আবার বাতাসে ভেসে ওঠে।
২০২২ সালে পৃথিবীর ১০০টি দূষিততম শহরের সারণিতে ভারতের রয়েছে ৬৫টি শহর। দেশের ২০২টি সমীক্ষিত শহরের মধ্যে মাত্র চারটির বায়ু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। লক্ষণীয় যে, দিল্লি বাদে দেশের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলি প্রায় সবই ছোট বা মধ্যম আয়তনের শহর। স্বাস্থ্যের পক্ষে সবচেয়ে মারাত্মক ২.৫ মাইক্রন বা তার কম ব্যাসার্ধের ভাসমান বস্তুকণার সহনীয় পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে শূন্য থেকে পাঁচ মাইক্রোগ্রাম। ভারতের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলিতে এর পরিমাণ বাৎসরিক গড় ৯০ মাইক্রোগ্রামের উপরে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এই দূষণ গড়ের চেয়ে অনেকখানি বাড়ে।
কেন্দ্রীয় সরকার নগরায়ণের সামগ্রিক সমস্যার মধ্যে বায়ুদূষণকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না, তারা প্রচুর অর্থব্যয়ে স্মার্ট সিটি প্রকল্প তৈরি করার এবং তার বিজ্ঞাপন দেওয়ার পক্ষপাতী। বায়ু আর পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত সমস্যা নগরায়ণের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য, কিন্তু স্মার্ট সিটি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থের অতি সামান্য অংশও এই ভয়াবহ দূষণ সংক্রান্ত গবেষণায়, বা দূষণ প্রতিরোধের কাজে ব্যয় করা হয় না। যেমন, কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে প্রায় ৫০০০ বায়ুদূষণ মাপক কেন্দ্রের প্রয়োজন, যার মধ্যে এখন পর্যন্ত চালু হয়েছে মাত্র ২৬১টি। তার বেশির ভাগই বড় শহরে। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা ও হাওড়া মিলিয়ে রয়েছে সাতটি কেন্দ্র আর বাকি পুরো রাজ্যে মাত্র আর চারটি— আসানসোল, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি আর হলদিয়াতে যথাক্রমে একটি করে, যদিও এই শহরগুলি কলকাতার চেয়ে বেশি দূষিত।
এই প্যান্ডোরার বাক্স খুলে বসলে সরকারের পক্ষে মুখরক্ষা করা মুশকিল। তার চেয়ে অনেক সহজ কাজ, দূষণের সম্পূর্ণ দায় কৃষকের ফসলের গোড়া পোড়ানোর অভ্যাসের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া।